রবীন্দ্রনাথ-মুজিব-সত্যজিৎ: যুগস্রষ্টা তিন বাঙালি

গৌতম কুমার রায়

সময়কে উদরে গিলে মহাকাল চলতেই থাকে। প্রকৃতির হাজারো সৃষ্টির মধ্যে দু-একটি কালের পথে স্মারক সৃষ্টি করে। সে স্মারক নিবেদনে কেউ কেউ কারো কারো মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকেন। আর এ বাঁচাটা হলো অনেকের হূদয় কুসুমের কোমল আস্তরণের মধ্যে বেঁচে থাকা। মহিমান্ব্বিত গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ২০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃতিং পুরুষং চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি। বিকারাংশ্চ গুণাংশ্চৈব বিদ্ধি প্রকৃতিসম্ভবান্।’ অর্থ হলো, প্রকৃতি অনাদি। তাদের বিকার ও সব গুণ এ প্রকৃতি থেকেই উত্পন্ন হয়। ভগবান বলেছেন, যারা জড় জগতের প্রতি আকৃষ্ট, তারা জীবনধারণের জন্য কঠোর সংগ্রাম করে। প্রকৃতি উদ্ভূত জন্ম এবং এ সংগ্রামের সফলতা যখন দিগ্বিদিক ছড়িয়ে যায়, তখন প্রকৃতি তার এ সৃষ্টিকে সৃষ্টিকুলের জন্য মহা আশীর্বাদ হিসেবে উপস্থাপন করে। আর এ সৃষ্টি আসে যুগে যুগে বা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে কখনো কখনো।

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। জলকে জয় করে কৃষি নৈপুণ্যে পৃথিবীতে আপন এক পরিচিতিতে আসে বাঙালি নামের মনুষ্য এক জাতি। সম্পদ আর ভোগ ও বিলাসের লোভে শাসন ও অনুশাসনের ক্রমপুঞ্জিতে বাঙালির ভাগ্য লিখন হয় শোষণ-বঞ্চনা আর নির্লিপ্ততা-নিষ্পেষণের মাধ্যমে দুঃখ ও অনুশোচনা দিয়ে। বিশ্বদরবারে বাঙালির পরিচিতি আসে কৃষিকাজে উৎপাদনের এক কারিগর হিসেবে। জলে ও স্থলে যুদ্ধ করে, শ্রম বিকিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে খাবার তৈরির পারদর্শিতা দিয়ে আমরা পরিচিতি পাই বাঙালি জাতি হিসেবে। পৃথিবীতে সাম্য ও সৃষ্টিতে বাঙালি অবদান রেখেছে, এমন সাক্ষী ও স্মারক অনেক আছে। আবার আত্মপরিচয়কে এগিয়ে নিতে কিংবা তাকে সংরক্ষণ করতে কাজ করে গেছেন এমন বাঙালিও আছেন অনেকে। সৃষ্টি চলকে সাক্ষ্য রেখে যাওয়া এমন বাঙালির কেউ কেউ আমাদের মাঝে রয়ে গেছেন তারই সৃষ্টি দিয়ে।

১৮৬১ সালের ৭ মে, দিনটি ছিল ২৫শে বৈশাখ বাঙালির উদিত আকাশে এক তারার জন্ম হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমাদের পরম দেবতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। মাত্র ১৩ বছর বয়সে কবির প্রথম কবিতা প্রকাশ করে ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ ও প্রকৃতিকে আপন হূদয়ে গ্রহণ করেছেন পরিতৃপ্তভাবে। তিনি ক্রমে জীবনসাহিত্যের খুঁটিনাটিকে বিশ্লেষণ করে বুঝেছেন এবং তার উপলব্ধি দিয়ে বাংলা ও বাঙালিকে উপস্থাপন করে গেছেন বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন ধাপে। তিনি দেশী ও বিদেশী রাজনীতিকে উপলব্ধি করেছেন বিভিন্ন ভাবধারায়। আবার সমাজকে বুঝেছেন আঙিনার কোনা ডিঙিয়ে। তিনি শিল্পকল্প, নাটিকা, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, ভাষা সাহিত্য, ছোটগল্প, লোকসাহিত্য দিয়ে জীবন ও সমাজকে আলোড়িত করে গেছেন। এসব সাহিত্য শিল্পের কারুকার্যে আমাদের আসন বসেছিল বিশ্বসভায়। আমাদের দ্বিজাতি তত্ত্বের বিভাজন কিংবা আর্য-অনার্যের কারুকার্যতায় এক অনগ্রসর অথচ উপায়হীন জাতি হিসেবে যে সীমানা তৈরি করে আবদ্ধ দ্বার তৈরি করে দেয়া হয়েছিল, তাকে ডিঙিয়ে নিতে কাজ করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির জীবনে তাই সাধনা, শ্রম, নিষ্ঠা ও সময়ের সামনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অপরিহার্য আপন মানুষ হিসেবে বিবেচিত সবসময়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা শেখ লুত্ফর রহমান, মা শাহেদা বেগম। যিনি বাঙালির নবজাগরণের প্রাণপুরুষ। ব্রিটিশ থেকে ভারত কিংবা পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। ইতিহাস পড়ে অনেক কারণে বিশেষ এক মানুষের নাম জেনেছিলাম। বিশ্বদরবার কাঁপিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন, তিনি হলেন মহীরুহ পুরুষ ও কালজয়ী ব্যক্তিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি জুলুমবাজের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে নিয়ে কেবল লাঠিসোটার শক্তিকে সম্বল করে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে পৃথিবীতে এনে দিলেন একটি মানচিত্র। সে আমার অহংকারের বাংলাদেশ, সে আমার ভালোবাসার বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ জীবন কাটিয়েছেন বারবার। কখনো জেলে গিয়ে, কখনো অবরুদ্ধ হয়ে। কখনো চোখ রাঙানি দিয়ে, কখনো ধমক দিয়ে। আবার আমাদের বাংলা ও বাঙালির প্রাণপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও  নিষিদ্ধ ছিলেন তার নিজের দেশে। তবে তা ছিলেন শুধু শাসক আর শাসনের সাংস্কৃতিক ভীতির কারণে। লিখিত আর মৌখিক ফরমানে। তবে শেখ মুজিব ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই নিষিদ্ধ হয়েই বিখ্যাত হয়েছেন। দুজনেই কাজ করেছেন বাংলার জন্য, বাঙালির জন্য, সর্বোপরি মানুষের জন্য। একজন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছেন। আরেকজন বাঙালির সৃজনশীল সংস্কৃতিকে তাদের অন্তরে ধারণ করাতে সক্ষম হয়েছেন। মজার বিষয় যেটা তা হলো, মুজিব-রবীন্দ্রনাথ দুজনই বিশ্বসমাদৃত এবং বাঙালি জাতিকে উঁচিয়েছেন দেশের আঙিনা ডিঙিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে। 

১৯৭১ সালে এক অবধারিত ও অনিবার্য কারণে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ এল। পাকিস্তানের ২৪ বছরের বৈষম্য আর বঞ্চনার কারণে বাঙালি উপায় খুঁজছিল তাদের রাজনৈতিক মুক্তি পেতে। শোষণ আর শাসনে পারদর্শী পাকিস্তানি শাসকদের হিংসা আর বিড়ম্বনা আমাদের দ্রুত সংঘটিত হতে কৌশলী করেছিল। কৌশলের সে স্রোতে নাউ ভাসিয়ে তার হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। উপেক্ষার জন্য পাকিস্তানের শাসনের ফ্রেম ভেঙে পড়ে। আর আমাদের জয় এগিয়ে আসে। পরিশেষে পৃথিবী থেকে পূর্ব পাকিস্তান নামটা মুছে গিয়ে অভ্যুদয় হয় বাংলাদেশের। এক নতুন মানচিত্রের।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও আমাদের স্বাধীনতার আশা মুখব্যক্ত হয়ে পরিশিষ্ট হয়, সেই ১৯৫২ সাল বেয়ে ১৯৫৪, অতঃপর ১৯৬৬ সাল এবং ১৯৭১ সাল। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সম্মিলিত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘...আমি সামনে ভয়ংকর দিন দেখতে পাচ্ছি। আমি সবসময় আপনাদের সঙ্গে না-ও থাকতে পারি। মরণের জন্যই মানুষ বেঁচে থাকে। জীবনে বেঁচে থাকাটাই একটা দুর্ঘটনা মাত্র। আমি জানি না আবার কখন আপনাদের সাথে আমার দেখা হবে...।’ তিনি সবার প্রতি দাবি জানিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। স্বাধীনতার প্রতি শেখ মুজিবের এমন আশঙ্কায় বাঙালি জাতির অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত। কেননা মুজিব তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত  নেতা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা এল। তারপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতার মহানায়ককে সপরিবারে হত্যা করা হলো। হত্যাকারীরা ভেবেছিল হয়তো আবারো পাকিস্তানি পতাকায় ফিরে যাওয়া যাবে। কিন্তু সে আশায় ছাই পড়ল। যারা মুজিবের হত্যা বন্ধে আইন করেছিল, তারাও হারিয়ে গেলেন একই ধারায় এক অস্বাভাবিক নিয়তিতে। এভাবে সময় যত গড়িয়েছে, আমাদের কাছে মুজিবের ঋণ দিনে দিনে বেড়েছেই। মুজিব নেই, আমরা তার ব্যাপ্তিকে নিয়ে সামনে এগোতে চাই। কেননা মুজিব মানেই স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকা। মুজিব মানেই মহামুক্তি, মুজিব আমাদের জাতির পিতা।

সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপ্তি ঘটিয়ে যে বাঙালি বিশ্বদরবারে সমাদৃত, তিনি সত্যজিৎ রায়। ১৯২১ সালের ২ মে এই মহান মানুষটির জন্ম কলকাতার গড়পার এলাকায়। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতে পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত মহান পুরুষ। পিতা সুকুমার রায় ও পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় দুজনেই ছিলেন এ সাংস্কৃতিক জগতের কীর্তিমান পুরুষ। পিতা ছিলেন অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টির অমর কারিগর। পিতামহ ছিলেন ইতিহাসখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। বিশ্বকবির স্নেহধন্য সত্যজিৎ রায়ের আরেক পরিচয় তিনি ছিলেন প্রখ্যাত আঁকিয়ে। অনেক চলচ্চিত্রের মধ্যে এ মহান মানুষটির অমর ‘পথের পাঁচালী’ উপমহাদেশের বাংলা ও বাঙালিপনার সৌন্দর্য মিশ্রিত, তুলনাহীন অনুভূতি জাগানো ছবি; যা কিনা আনন্দ-সুখ-দুঃখে মিশ্রিত সাম্য ও সমাজের বিচিত্র চিত্রকে অনুভূতিতে জাগ্রত করে তোলে। সত্যজিৎ এবং তার পূর্বপুরুষরা বাংলা ও বাঙালিপনাকে এগিয়ে দিয়েছেন পথ থেকে প্রান্তরের মুখে। ক্লান্তিহীন গতিময় বাধাহীন এগিয়ে যাওয়া এক চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আবার তিনি জগেজাড়া এক সাহিত্য স্রষ্টাও বটে। গোয়েন্দা গল্প ফেলুদা হলো সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি। এক কথায় বলা চলে, বিশ্বের মহান এক প্রাণপুরুষ সত্যজিৎ রায়; যিনি কিনা সংস্কৃতি ও সাহিত্য আসনে ইতিহাস বর্ণিত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানুষও।

রবীন্দ্রনাথ, মুজিব ও সত্যজিৎ বাংলার অনেক প্রাণপুরুষের মধ্যে এক সমার্থক ব্যক্তিত্ব; যারা নিজের সৃষ্টি দিয়ে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আপন আলয় থেকে বিশ্ব আলয়। আর এ মহিমায় আমি এগিয়েছি যেমন, আবার আমরাও এগিয়েছি তেমন। যে কারণে এ কীর্তিমানরা আমাদের কাছে সবসময় পূজনীয়, স্মরণীয় এমনকি বরণীয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব

SUMMARY

999-1.jpg