বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে কিছু স্মৃতি


তোফায়েল আহমেদ

প্রতিবছর যখন ১৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে ফিরে আসে, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা বেশি করে মনে পড়ে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন এই বাংলার মাটিতে। বঙ্গবন্ধু যদি জন্ম না নিতেন, তাহলে আজও আমরা পাকিস্তানের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতাম। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। আমৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। আমি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য। বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। কাছ থেকে দেখেছি কত বড় মন এই মহান নেতার। কীভাবে তিনি বাংলার মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। বাংলার গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষ ছিল তার প্রাণ, যাদের কল্যাণে তিনি সারাটি জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা যারা রাজনীতি করি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলি, তাদের উচিত বঙ্গবন্ধুর চাল-চলন, আচার-আচরণ, সহকর্মীদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা অনুসরণ করা।


বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে দেখেছি তার কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয়, মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। আকাশের মতো উদার হৃদয় ও জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্বদেশে কিংবা বিদেশে মানুষকে তেজস্বী ব্যক্তিত্বের ছটায় সম্মোহিত করার, উদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি ভাস্বর। তার কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তার একটা তহবিল থাকত আমার কাছে। এই তহবিল থেকে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। এর মধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও বিরোধী দলের লোকজনও ছিলেন; কিন্তু শর্ত ছিল যাদের অর্থ সাহায্য দেয়া হচ্ছে তাদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখতে হবে, প্রকাশ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। তার রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত। কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না। বঙ্গবন্ধুর সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। সময়ের এক চুল হেরফের হতো না, ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানাদিতে যেতেন। দলের নেতাকর্মী সবার প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। তাদের কাজের মর্যাদা দিতেন, ভালোবেসে বুকে টেনে নিতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এক মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তার। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল।

বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা, কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভিড় করে আসে। এমন মহামানবের সান্নিধ্য কেঁদেও আর পাব না কোনোদিন, এমনটা ভাবলেই চোখ ভিজে যায়। মনে পড়ে ’৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না- আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমি তো আমার জীবন বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি।’

মনে পড়ে ’৭০-এ বরিশাল-পটুয়াখালী-ভোলা অঞ্চলে নির্বাচনী সফরের কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ভোলায় নির্বাচনী জনসভা। এদিন ভোলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু আমাকে আমি যা না তার চেয়ে অনেক বড় করে তুলে ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নেতাকর্মীদের এভাবেই সম্বোধন করতেন। যখন যে এলাকায় যেতেন, সে এলাকার সংগঠক বা নেতাকর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য দিতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে নেতা হয়েছেন, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে জাতীয় নেতা থেকে জাতির জনক হয়েছেন। অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে উন্নীত করেছিলেন জাতীয় নেতায়। ফলে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে টিকে আছে। অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রত্যেক নেতাকর্মীর বিপদ-আপদে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী এক ক্ষমতা ছিল তার। আমার একমাত্র কন্যা মুন্নী যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে, টিভিতে ওর অনুষ্ঠান দেখে ওকে স্নেহাশীষ জানিয়েছিলেন। অপরিসীম ভালোবাসা ছিল শিশুদের প্রতি। ফটোজার্নালিস্টরা বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে চাইলে কখনও না করতেন না, বরং এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘ভবিষ্যতের মানুষ যারা, ওরা বড় হয়ে দেখবে কেমন ছিল ওদের নেতা।’ বঙ্গবন্ধু যখন গণভবনে যেতেন, সামনে পেছনে দুটি গাড়ি থাকত। রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ত। তখন স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি ছিল না। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। একবার আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ালে হঠাৎ একটি শিশু, কত বয়স হবে সাত কী আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, মুজিব সাহেব!’ তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি পাশে বসে দেখছি একজন রাষ্ট্রনায়কের, জাতির জনকের শিশুদের প্রতি কী অপার ভালোবাসা, কী অপূর্ব মমত্ববোধ। আর তাই জাতির জনকের জন্মদিন আমরা জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করি।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হয়ে, ১৪ জানুয়ারি আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ২৯ বছর বয়সে রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে ৩২ নম্বরে যেতাম বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। একসঙ্গে অফিসে যেতাম। আবার বঙ্গবন্ধুকে ৩২-এ রেখে নিজের বাসায় ফিরে আসতাম। তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক নেতা। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। যেখানেই গিয়েছিলেন সেখানেই তিনি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরের কথা। বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করলেন, সে কী অভূতপূর্ব দৃশ্য! ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা দুর্গাপ্রসাদ ধর, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে নেয়া যায়নি। কারণ তাকে একনজর দেখার জন্য রাজপথে লাখ লাখ মানুষ। হেলিকপ্টারে করে রাজভবনে নেয়া হয়েছিল। বিকালে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ২০ লক্ষাধিক লোকের মহাসমাবেশে বক্তৃতায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘আপনারা আমার মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। আপনাদের কাছে আমি ঋণী; কিন্তু আমার তো দেবার কিছু নাই। আমি তো রিক্ত, নিঃস্ব!’ কবির ভাষায় হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারণ করলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ তারপর রাজভবনে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমি ভারতের কাছে ঋণী। মুক্তিযুদ্ধে আমাকে অর্থ, অস্ত্র, আশ্রয়সহ সার্বিক সাহায্য দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি ঋণী। আমি আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাই। আপনি যাবেন বাংলাদেশে ১৭ মার্চ,- যেদিন আমার জন্মদিন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি চাই, আপনি বাংলাদেশে যাওয়ার আগে আপনার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়ে আসবেন।’ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৭ মার্চ বাংলাদেশে এসেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমুদ্রে বক্তৃতা করেছেন। তার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভারতে ফিরে গিয়েছিল। তারপর তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ৬ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ’৭২-এর ১ মার্চ গিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেদিন সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পোদগর্নি, কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ক্রেমলিনে বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ’৭৩-এর ২৭ জুলাই মার্শাল টিটোর আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন যুগোশ্লাভিয়া। বেলগ্রেড বিমানবন্দরে যখন অবতরণ করেন, তখন যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী জামাল বিয়েদিস বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানালেন। দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে নিয়ে গেলেন বিরোনী। বিরোনী একটি দ্বীপ। যেখানে মার্শাল টিটো অবস্থান করতেন। সেই দ্বীপে বঙ্গবন্ধুর বিমান যখন অবতরণ করল, মার্শাল টিটো বিমানবন্দরে এসে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে অতিথি ভবনে নিয়ে গেলেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি দেশের রাষ্ট্রপতির অভ্যর্থনা জ্ঞাপন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। জুলাই ৩১ তারিখে আমাদের গন্তব্য ছিল কানাডার রাজধানী অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলন। বাংলাদেশ তখন কমনওয়েলথের নবীনতম সদস্য। সেখানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্র–ডো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। বিশ্বের অনেক বরেণ্য নেতা কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিস্টার হুইটলাম, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, কেনিয়ার রাষ্ট্রনায়ক জুমো কেনিয়াত্তা, উগান্ডার ইদি আমিন, জাম্বিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেনেথ কাউন্ডা, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াকুবুগোয়েন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রাজ্জাক, সিঙ্গাপুরের লি কোয়ানসহ বিশ্ব নেতারা সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আজও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের কথা আমার মনে পড়ে। তিনি বক্তৃতার একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘হোয়েন এলিফ্যান্ট প্লেস, ইট ইজ দ্য গ্রাস হু সাফারস’- বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য সম্মেলনে আলোড়ন তুলেছিল। বৃহৎ শক্তিকে উদ্দেশ করে তিনি এই উক্তি করেছিলেন। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে ’৭৩-এর ৬ সেপ্টেম্বর ৪ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে পৌঁছান। ৯ সেপ্টেম্বর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে।’ একই বছর অক্টোবরের ১৭ তারিখ ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু জাপান গমন করেন। সেখানেও এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়, রাস্তার দু’পাশে লোকজন দাঁড়িয়েছিল তাকে একনজর দেখার জন্য। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে আমরা ঢাকা ত্যাগ করি।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সদ্য সদস্যপদপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা। নিউইয়র্ক সময় বিকাল ৩টায় যখন বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্বনেতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতাদের সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অক্টোবরের ৩ তারিখ বঙ্গবন্ধু ইরাক সফরে যান। ইরাকের প্রেসিডেন্ট হাসান-আল-বাকার এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করেন। সারাক্ষণ সাদ্দাম হোসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারে বুমেদিনের বিশেষ বিমান নিয়ে পাঁচজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ওআইসি সম্মেলনে নেয়ার জন্য। ২৩ ফেব্রুয়ারি যখন আমরা ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করি, সেখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি খুব আত্মমর্যাদাশীল নেতা ছিলেন। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ সৌদি আরবের বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বলেছিলেন, ‘আমি আপনার কাছে স্বীকৃতি চাইতে আসিনি। আমি এসেছি আপনাকে সম্মান জানাতে। স্বীকৃতি না দিয়েও আপনি আমার বাংলাদেশের মানুষকে হজব্রত পালনের সুযোগ দিয়েছেন। এ জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।’

আজ এই মহান নেতার জন্মদিনে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাকে স্মরণ করি।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী

tofailahmed69@gmail.com

SUMMARY

32-1.jpg