বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয়



স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ জেলার ঘাঘোর ও মধুমতি বিধৌত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন। মাতার নাম সায়েরা খাতুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন ইরাক থেকে আগত দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর। বঙ্গবন্ধুর দাদার নাম শেখ আব্দুল হামিদ। তিনি ছিলেন শেখ জাকিরের সন্তান এবং দরবেশ শেখ আউয়ালের কয়েক জন্মের উত্তরাধিকারী। শেখ জাকিরের তিন ছেলে- শেখ আব্দুল মজিদ, শেখ আব্দুল রাসেল ও শেখ আবদুল হামিদ। শেখ আবদুল হামিদের তিন ছেলে- শেখ লুৎফর রহমান, শেখ শফিউর রহমান ও শেখ হাবিবুর রহমান। 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতে শেখ বোরহান উদ্দীনের কথা বলেছেন। বোরহান উদ্দিনের ছিল তিন পুত্র সন্তান। তারা হলেন: শেখ আকরাম, শেখ তাজ মোহাম্মদ ও শেখ কুদরতুল্লা। শেখ আকরামের দু’ছেলে- শেখ জাকির ও শেখ ওয়াসিম। 

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমাদের বাড়ির দালানগুলোর বয়স দুইশত বৎসরেরও বেশি হবে। শেখ বোরহান উদ্দিনের পরে তিন-চার পুরুষের কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে শেখ বোরহান উদ্দিনের ছেলের ছেলে অথবা দুই-এক পুরুষ পরে দুই ভাইয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। এদের সম্বন্ধে অনেক গল্প আজও শোনা যায়। এক ভাইয়ের নাম শেখ কুদরত উল্লাহ, আর এক ভাইয়ের নাম শেখ একরাম উল্লাহ। আমরা এখন যারা আছি তারা এই দুই ভাইয়ের বংশধর। এই দুই ভাইয়ের সময়েও শেখ বংশ যথেষ্ট অর্থ ও সম্পদের অধিকারী ছিল। জমিদারের সাথে তাদের বিরাট ব্যবসাও ছিল।’

শেখ বোরহান উদ্দিনের পিতা ছিলেন তেকড়ী শেখ। তিনি সোনারগাঁও-এ অনেক কাল বসবাস করেন। তেকড়ী শেখের পিতা ছিলেন শেখ জহির উদ্দিন। তিনি তাঁর পিতার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। শেখ জহির উদ্দিনের পিতা ছিলেন শেখ আউয়াল। যিনি এলাকায় দরবেশ আউয়াল নামে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁকে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ:) অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। বায়েজিদ বোস্তামি (রহ:) এর কথা আমরা অনেকেই জানি। সম্ভবত ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ বঙ্গীয় এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। তখন মুসলমানরা উপমহাদেশের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। তাদের দখলে তখন অনেক এলাকা। আমাদের এ বঙ্গ চিরকালই সুজলা-সুফলা। ইরাকের এই ইসলাম প্রচারক বঙ্গের প্রকৃতি, স্থানীয় জনপদ ও মানুষজনের সহজ-সরল আচরণের কথা শুনে খাইবার গিরিপথ হয়ে প্রথমে দিল্লি, পরে এই বঙ্গে আগমন করেন। অনেকের ধারণা, তিনি জাহাজে চড়ে এসেছিলেন বলে চট্টগ্রামে আস্তানা গেড়েছিলেন। বায়েজিদ বোস্তামি ছিলেন সুফি সাধক। মানুষকে তিনি ধর্মের শান্তি ও কল্যাণের কথা শোনাতেন। মানুষ তার কথা শোনতো মুগ্ধচিত্তে। এ বঙ্গে তিনি একা আসেন নি। তাঁর ছিল বেশ ক’জন সঙ্গী-সাথী। তাঁরাও ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তাঁদের মধ্যে শেখ আউয়াল দরবেশও ছিলেন। 

বায়েজিদ বোস্তামি (রহ:) একদিন শেখ আউয়ালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মেঘনা পাড়ের এলাকায় যাবার। শেখ আউয়াল গুরুর আদেশ মেনে চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও-এ। (বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প, পৃ; ১৬)

সোনারগাঁও-এ তেকড়ী শেখ অনেককাল বসবাস করলেও একসময় ব্যবসার উদ্দেশ্যে খুলনায় পাড়ি জমান। দাদার আস্তানাটির দায়িত্ব দিয়ে যান বিস্বস্ত লোকদের। তেকড়ী শেখের উত্তরাধিকারী- পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন মধুমতি ও ঘাঘোর নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামটির কথা শোনেন তাঁর বন্ধুর কাছে। রূপসা নদী পাড়ি দিয়ে একদিন তিনি বন্ধুর সাথে চলে আসেন টুঙ্গিপাড়ায়। বিয়ে করেন কাজী পরিবারে, ঘর বাঁধেন চিরকালের জন্য। এভাবেই টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন ঘটে। 

দুই.
আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বংশ বঙ্গীয় এ ভূমিতে বিস্তার লাভ করে দরবেশ শেখ আউয়ালের মাধ্যমে। তিনি তাঁর গুরু বায়েজিদ বোস্তামি (রহ:) আদেশ মেনে মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও-এ বসবাস শুরু করেন। তৎকালীন শাসনকর্তাদের কোঠাবাড়ি ছিল এখানে। বড় বড় পালতোলা নৌকা আসে এখানটায়। মেঘনা আর সবুজ-শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত সোনারগাঁর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ে দরবেশ শেখ আউয়ালের। এক সময় তাঁর সুনামও ছড়িয়ে যায় চারদিকে। তিনি মানুষকে সত্য পথে চলার উপদেশ দেন, ধর্মের বাণী শোনান। অনেকেই তাঁর অনুসারী হন। বিয়ে করেন স্থানীয় এক বাঙালি কন্যাকে। একদিন তাঁর ঘর উজ্জ্বল করে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। আদরের এ সন্তানের নাম রাখলেন শেখ জহির উদ্দিন। 

শেখ জহির উদ্দিন বড় হচ্ছেন। বাবার নির্দেশ মতো লেখাপড়া করছেন। বাবার আস্তানায় হাজারো মানুষের আনাগোনা। বাবাকে শ্রদ্ধা করেন। শেখ জহির উদ্দিনের এসব ভালো লাগে। কিন্তু এ ভালো লাগা বেশিদিন টিকলো না। কথা নেই, বার্তা নেই, নেই কোনো আয়োজন। একান্ত আপনজনদের জানিয়ে দরবেশ শেখ আউয়াল একদিন পাড়ি জমালেন মক্কায়- উদ্দেশ্য হজব্রত পালন। দেখতে দেখতে হজ মৌসুম শেষ হলো। বছরের পর বছর গেলো কিন্তু দরবেশ শেখ আউয়াল আর ফিরে আসেন নি। 

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমরা যারা বেঁচে আছি তারা এই দুই ভাইয়ের বংশধর।’ এই দুই ভাই বলতে শেখ একরাম উল্লাহ (শেখ ইকরাম) ও শেখ কুদরত উল্লাহ ওরফে কদু শেখের কথা বলেছেন। জানা যায়, শেখ ইকরামের দু’সন্তান: শেখ জাকির হোসেন ও শেখ ওয়াসিম উদ্দিন। শেখ জাকির হোসেনের তিন পুত্র: শেখ আবদুল মজিদ, শেখ আব্দুল রশিদ ও শেখ আবদুল হামিদ। আগেই বলেছি, এই শেখ আব্দুল হামিদই বঙ্গবন্ধুর দাদা। শেখ আবদুল মজিদের বংশধর বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন এবং শেখ ওয়াসিম উদ্দীনের বংশধর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা। শেখ ফজিলাতুন নেছার পিতার নাম মো: জহুরুল হক (দুদু মিয়া) ও দাদার নাম শেখ মো: আবুল কাশেম।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘শেখ কুদরতউল্লাহ ও একরামউল্লাহ শেখের মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর থেকেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয়। পরপর কয়েকটি ঘটনার পরেই শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৫)

তিন.
টুঙ্গিপাড়ার ইতিহাস খতিয়ে দেখা যায়, আড়িয়াল খাঁর একটি শাখা ভাঙ্গা-টেকের হাট ও রাজৈর হয়ে বাইগ্যার বিলের মধ্যে পতিত হয়েছে। এ শ্রোতধারার প্রাচীন রাজধানী কোতয়ালী পাড়ায় বয়ে যাওয়ার নাম ঘাঘোর নদী। পশ্চিমে মধুমতী আর পূর্বে ঘাঘোর নদী। মাঝ বরাবর জলাভূমি। টঙ্গ থেকে টুঙ্গি। জনবসতি গড়ে ওঠার পর টুঙ্গিপাড়া। এ পাড়ার বনেদী পরিবার- শেখ পরিবার। এ পরিবারে জন্মেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মের পর তাঁর নানা শেখ আবদুল মজিদ নাম রাখেন মুজিব অর্থাৎ সঠিক উত্তরদাতা। মা-বাবা তাঁকে ডাকতেন খোকা বলে। সেই খোকা একদিন ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠলেন এবং পরবর্তীতে বাঙালি জাতি তাঁকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট একদল উচ্চাভিলাষী সেনাসদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন পুত্র লে. শেখ কামাল, ক্যাপ্টেন শেখ জামাল ও শিশু রাসেল, দুই নববিবাহিতা পুত্রবধূ ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল ও পারভিন কামাল, একমাত্র ছোটভাই শেখ আবু নাসেরকে হত্যা করে ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। 

ঘাতকদল বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার দু সন্তান বেবী ও আরিফ, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহকে হত্যা করে। সেরনিয়াবাতের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মেজোবোন আমেনা খাতুন গুলিবিদ্ধ হন সেদিন। শরীরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি ৩০ বছর বেঁচেছিলেন। ২০০৫ সালের মৃত্যুবরণ করেন। সেই ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি এবং তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকেও হত্যা করে ঘাতকদল। বঙ্গবন্ধুকে দাফন করা হয় তাঁরই জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায়।

বঙ্গবন্ধুর বংশের তথা তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শুধু দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ৪২ বছর পর আমরা তাঁকে ও তাঁর বংশধরকে স্মরণ করছি। কারণ তিনি আজও আমাদের কাছে দেশপ্রেমের প্রোজ্জ্বল উপমা। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান। বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। বর্তমান প্রজন্মকে বিশাল মনের এ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে হবে। জানাতে হবে। 



তথ্য সংগ্রহ
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ঢাকা, ২০১২
২.  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার, বেবী মওদুদ, ঢাকা, ২০১০
৩. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, তৃতীয় মুদ্রণ, মার্চ ২০১৩, ঢাকা
৪. বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প, খালেদ বিন জয়েনউদ্দিন, একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭, ঢাকা
৫. অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি, মমিনুল হক খোকা, জানুয়ারি ২০১৬, ঢাকা 

SUMMARY

29-2.jpg