মো. হারুন-অর-রশিদ |
‘সার্বজনীন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা’ প্রদানকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বস্তুত শিক্ষায় যে একটি মৌলিক অধিকার, সে অঙ্গীকারকেই সংবিধান সম্মত অলঙ্ঘনীয় বিধানে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা দর্শন এবং শিক্ষা ভাবনা তার রাজনৈতিক দর্শন থেকে উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মতার্দশ, দার্শনিক শিক্ষা সমাজচিন্তাসহ জীবনের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। তিনি কেবল বাঙালির জন্য একটা স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যেই তার চিন্তা এবং আজীবনের সংগ্রামকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। এই রাষ্ট্রটির চরিত্র কেমন হবে, কেমন হবে এর রূপ কাঠামো, রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কর্তব্য, ক্ষমতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও তিনি স্থির করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন বিশেষ করে তাঁর সময়ে রচিত কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন শিক্ষা ভাবনাকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশের শিক্ষানীতি।
শিক্ষা বর্তমানের কানন। ভবিষ্যতের মুকুল। এটা বর্তমানের ফল, ভবিষ্যতের বল। একটি জাতির মেরুদণ্ড। কোনো জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির নিয়ামক শিক্ষা। মহাকবি মিল্টনের ভাষায় যেমন- Harmonious development of body, mind and soul, তেমন কালের সিঁড়ি। কোনো জনপদের জীবনধারা ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষার নির্দেশিত পথ। শিক্ষা মৌলিক অধিকার। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ছাব্বিশ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের ১৫ ও ১৭নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে বাংলাদেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা দর্শনকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশের ভবিষ্যত্ কল্যাণ, সমৃদ্ধিতে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত শিক্ষা নীতিতে যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের ছক তৈরি করেছিলেন তাঁর বাকি কাজটুকু জননেত্রী শেখ হাসিনা অবিচল আস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
রাজনীতির বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা ও শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে স্বাধীনতা-উত্তর তার সরকারের আমলেই এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু এদেশের উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ১৯৭৪ সালে এই কমিশনের রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার শিক্ষা দর্শনকে বাস্তবায়নের জন্য দেশের সর্বোচ্চ দলিলে শিক্ষাকে স্থান দেন। পবিত্র সংবিধানের ১৫, ১৬, ১৭, ১৯, ২৩, ২৮ ও ৪১-এ শিক্ষাসংক্রান্ত বিধানাবলি বিধৃত হয়েছে। ড. কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনের পর এদেশে আরো ৪টি শিক্ষা কমিশন ও তিনটি শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হলেও সেসবের শুধু সময়ের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু মূল আলোচ্য বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে রচিত শিক্ষা কমিশনের অধিক প্রাধান্য। যেহেতু শিক্ষার কিছু মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শাশ্বত ও চিরন্তন। তাই কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে শিক্ষার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিধৃত হয়েছিল। শিক্ষা কাঠামোর যে স্তরবিন্যাস ও শিক্ষা সম্পর্কিত যে মৌলিক দিকদর্শন চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো দীর্ঘ ৪৬ বছর পরও উপযোগিতা হারায়নি। ফলে বঙ্গবন্ধুর সময়ে রচিত কমিশনের অনেক ক্ষেত্র এখনো সমকালীন চিন্তা ও স্রোতের সঙ্গে যেমন যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ তেমনি গ্রহণযোগ্য। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন না হলে হয়তো বঙ্গবন্ধুর আমলের শিক্ষা কমিশনের বাস্তবায়ন অবলোকন করতে সমর্থ হতাম। সর্বশেষ ড. কবীর চৌধুরী শিক্ষানীতিতেও কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা রেখেই হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার মতো অর্থ বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রেখে দেশে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে এক বিরল নজির স্থাপন করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ২০১৬ সালে প্রণীত দ্বিতীয় অধ্যায়ে শিক্ষার জন্য তৃতীয় অধ্যায়ে বিধান রেখে গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্টবোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। একটি দেশের শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত হয় দেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতির দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মীয় সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। তাই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে কর্মবোধ, সাম্য, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, মূল্যবোধ ও মানবতাবোধ সম্পন্ন একটি জনশক্তি গড়ে তোলার দিকনির্দেশনা।
শিক্ষানীতিতে প্রতিফলিত হয় দেশের জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সাংবিধানিক নীতিমালা। সুতরাং তা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের আওতায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বিজ্ঞান মনস্ক, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমকালীন জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দক্ষ দেশপ্রেমিক, নৈতিক, মানবীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন একটি ভবিষ্যত্ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি বা শিক্ষা দর্শন প্রণয়ন করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীকে সচেতন করা। দেশের অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষাকে প্রয়োগমুখী, উত্পাদনক্ষম, সৃজনশীল করে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা। শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে পূর্ববর্তী স্তরে অর্জিত জ্ঞান দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত দৃঢ় করা ও এগুলো সম্প্রসারণে সহায়তা করা। জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা নৈতিক মূল্যবোধ বিকশিত করে বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা। দেশের জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। সংবিধানের বিধৃত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে শিক্ষার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার প্রতি শিক্ষার্থীদের সশ্রদ্ধ করে তোলা। শিক্ষায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করা।
বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ও কোরিয়া শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে ও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেশকে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে শিক্ষা ও শিল্পে এবং অর্থনীতিতে শীর্ষে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডের আদলে গড়ে তোলা। বাঙালির স্বাধিকার ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস একমাত্র বঙ্গবন্ধুর অবস্থানই জোরালো এবং স্পষ্ট। সামগ্রিকভাবে আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র হতাশাব্যঞ্জক ও সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে বলে শিক্ষাবিদরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। এ থেকে উত্তরণের এবং একটি আধুনিক, উন্নত ও শিক্ষিত জাতি হিসেবে আমরা বিকশিত হতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ও তার সময়ে প্রণীত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতির সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। – লেখক : এম ফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়