আহ্রার হোসেন
বিবিসি বাংলা, ঢাকা (২৩ জুন ২০১৭)
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আজ প্রতিষ্ঠার আটষট্টিতম বছর পার করে উনসত্তরতম বর্ষে পদার্পণ করেছে।
এ অঞ্চলের প্রাচীন এই দলটি তৈরি হয়েছিল, যখন বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ, এবং দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
দীর্ঘ উত্থান পতনের ধারাবাহিকতায় দলটি এখন আট বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় আছে এবং এবারই তারা সবচাইতে দীর্ঘসময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে।
১৯৪৯ সালের তেইশে জুন ঢাকার টিকাটুলিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটি আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই দলটিই আজকের আওয়ামী লীগ।
দল আত্মপ্রকাশের ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়া হয়, উদ্দেশ্য দলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চ্চা এবং অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।
১৯৬৬ সালে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে যে ছয় দফা দাবি তুলে ধরা হয় আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সেটাকেই মনে করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম একটি পদক্ষেপ।
এরপর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগের ভূমিকা দলটিকে এই অঞ্চলের একক বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করে ফেলে আর শেখ মুজিবর রহমান পরিণত হন দলের অবিসংবাদিত নেতায়। এর সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যুক্ত হওয়ায় শেখ মুজিব আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বলা হয় সেই জনপ্রিয়তাই সত্তর সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল বিজয় এনে দেয়।
ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিল, যার ধারাবাহিকতায় এখন স্বাধীন বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার পর সরকার প্রধান হন দলের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান
অবশ্যম্ভাবীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পেল আওয়ামী লীগ, সরকার প্রধান হলেন দলের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি এক পর্যায়ে গিয়ে ১৯৭৫ সালে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে দিয়ে চালু করলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ বা বাকশাল নামের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বক্তব্য এই বাকশাল গঠন আওয়ামী লীগকে তাদের এতদিনকার আদর্শ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।
''আমি মনে করি সেটি একটি বড় ভুল ছিল। হয়ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন ছিল, কিন্তু, আরো বেশি সময় নিয়ে আরো বেশি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে, এই বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব ছিল,'' বলেন মিঃ ইসলাম।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় সপরিবারে খুন হন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার প্রধান শেখ মুজিবর রহমান, দীর্ঘদিনের জন্য সামরিক সরকারের শাসনে চলে যায় বাংলাদেশ এবং বিরাট ছন্দপতন নেমে আসে আওয়ামী লীগে।
১৯৮১ সালে শেখ মুজিবর রহমানের বেঁচে যাওয়া দুই মেয়ের বড়জন শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর আওয়ামী লীগের এই ছন্দপতন দূর হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে যে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় তার অন্যতম শরীক হয় আওয়ামী লীগ, যুগপৎ আন্দোলনে স্বৈরশাসকের পতন হয়, এবং ১৯৯০ সালের একটি সাধারণ নির্বাচনে দীর্ঘ সময় পর আওয়ামীলীগ অংশ নিলেও পরাজিত হয়ে বিরোধী দলে পরিণত হয়।
দীর্ঘ একুশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকার পর আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। তার আগে অবশ্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একটি আন্দোলন করে সফলতা পায় দলটি।
এরপর আরেকদফায় ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ২০০৯ সালে আবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ, যে মেয়াদে তাদের সংবিধানে সংশোধনী এনে নিজেদের আন্দোলনের মাধ্যমে পাওয়া সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয় দলটি।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে একটি নির্বাচন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ, বড় বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণহীন সেই নির্বাচনটি দেশে বিদেশে ব্যপক সমালোচিত ও অগ্রহণযোগ্য হয়।
সেই পরিস্থিতির জন্য যদিও আওয়ামী লীগকে এককভাবে দোষারোপ করতে নারাজ প্রফেসর ইসলাম, কিন্তু তিনি বলছেন, সেরকম পরিস্থিতি যাতে আর না হয় সেজন্যও আওয়ামী লীগকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ আরো সুন্দর করতে হবে, ছোট ছোট সবগুলো দলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে এবং বিএনপির দিকে একটি হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
''আমি মনে করি যে এখনো সুযোগ আছে এবং এই দুইটি বড় দলের ভিতর একটি কনভার্সেসশন কথোপকথন শুরু হওয়া উচিত, এবং তা যদি সম্ভব হয়, যদি ২০১৯বা যাই হোক ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়।''
এদিকে আওয়ামী লীগ উত্থান পর্ব নামের গ্রন্থের রচয়িতা মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, এখনকার প্রেক্ষাপটে প্রতীয়মান হচ্ছে ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী অনেক প্রগতিশীল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই একেবারে বিপরীত মেরুর আদর্শের সাথে জোট গঠন করছে, আঁতাত করছে, যেটা আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের কাছে একেবারেই কাম্য নয় বলে মনে করেন মি. আহমেদ।