বাংলাদেশে মুজিবের মূল্যায়নে কতটা ঐকমত্য?


কাদির কল্লোল
বিবিসি বাংলা, ঢাকা (১৫ অগাস্ট ২০১৪)

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ৩৯ বছর পরও তাঁকে নিয়ে আবেগ এবং প্রতিক্রিয়া, দু’টি বিষয়ই রয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, শেখ মুজিবের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে মানুষ এখন সঠিক মূল্যায়নের একটা জায়গায় এসেছে।

তবে এ বিষয়ে এখনও জাতীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সেই বাড়িটিকে এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর করা হয়েছে।

সেখানে গিয়ে দেখা যায় দর্শনার্থীদের ভিড়। সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্র মোঃ সোহেল এই প্রথম বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর দেখতে আসেন।

তিনি বলছিলেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথা শুনেছেন। এখন যাদুঘরে এসে একটা পরিস্কার ধারণা তিনি পেয়েছেন।

shiekh mujibur rahman
১৯৭২ সালে লন্ডনে শেখ মুজিবুর রহমান (ফাইল চিত্র)
আরেকজন শিক্ষার্থী পলি আকতার মনে করেন, শেখ মুজিব ছাড়া দেশ স্বাধীন হতো না।


যাদুঘরে এসে তাঁর মনে হয়েছে,শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলেও তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে রয়েছেন।

এতবছর পরও শেখ মুজিবকে নিয়ে যে আবেগ কাজ করে, আদর্শই এর ভিত্তি বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন।

দলটির সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ, তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব ছিলেন।

মি: আহমেদ বলেছেন, আদর্শের কারণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও শেখ মুজিবের শক্ত অবস্থান রয়েছে।

তিনি বলছিলেন, “বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি একটি আদর্শ ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন বলেই, আমরা স্বাধীন হয়েছি- কৃতজ্ঞতার সাথে মানুষ তা স্মরণ করে।”

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, শেখ মুজিবকে নিয়ে আবেগ প্রকাশের বিষয়টাতেও বিভিন্ন সময় পরিবর্তন এসেছে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে।

তাঁকে হত্যার ঘটনার পর একটা লম্বা সময় আবেগ প্রকাশের সুযোগ ছিল না।

আবার ঘটনার একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এর আগে যখন ক্ষমতায় এসেছিল, সেই আমলে আবেগের প্রকাশ অনেক বেশি ছিলো বলেও বিশ্লেষকদের অনেকে বলে থাকেন।

সিনিয়র সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবির মনে করেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ৩৯ বছর পর এসে সাধারণ মানুষের মাঝে আবেগ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখন সাফল্য ব্যর্থতা নিয়েই মূল্যায়ন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর শাসনামল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মি: কবির বলছিলেন, “এখন কিন্তু মানুষ শেখ মুজিবকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছে।”

তিনি বলেন এটা সবাই অবশ্যই বলবে, শেখ মুজিব আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। এতে কারও কোন সন্দেহ নেই। তাঁকে হত্যার ঘটনাও মানুষ মূল্যায়ন করে।

“সার্বিকভাবে মূল্যায়নের পর মানুষ কিন্তু একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে মূল্যায়নে সাফল্য এবং ব্যর্থতা সবই কিন্তু এসেছে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। বিতর্ক রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর শাসনামলকে নিয়ে।

এখন কিন্তু মানুষ শেখ মুজিবকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছে। সেখানে মূল্যায়নে সাফল্য এবং ব্যর্থতা সবই কিন্তু এসেছে।
সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবির
আর সেই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকছে বাকশাল গঠন বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়।

এমন পদক্ষেপকে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখেন সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবির ।

যদিও আওয়ামী লীগ সেই সময়ের প্রেক্ষাপট এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে তুলে ধরে যুক্তি দিয়ে থাকে।

অর্থনীতিবিদ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এম এম আকাশ বলেছেন, শেখ মুজিবকে হত্যার ক্ষেত্রে বিতর্কের এই ইস্যুগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে।

তবে এর পিছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য কাজ করেছে এবং সেটা এখন অনেকটা পরিস্কার হয়েছে বলে তাঁর ধারণা।

“শেখ মুজিবকে হত্যা করা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না - এটা বুঝতে পেরেই শত্রুরা তাঁকে হত্যা করে।”

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথম দফায় ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ মুজিবকে হত্যার দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছিল।

এরপর ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেছিল।

ধানমন্ডিতে শ্রদ্ধা নিবেদন
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড়
২০০৯ সালে আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জাতীয় শোক দিবস এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালনের বিষয়গুলোকে ফিরিয়ে আনে।

তবে বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্মদিন ঘটা করে পালনের বিষয়টি ভিন্ন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন পরিবেশ বা বিভক্তির প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যেও পড়ছে।

আমানুল্লাহ কবির মনে করেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানসহ অন্য যাদের অবদান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ স্বীকৃতি না দেওয়ায় বিভক্তি থাকছে।

এমন বক্তব্য মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভক্তি রয়েছে।

সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ
কিন্তু শেখ মুজিবকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভক্তি নেই বলেই তিনি উল্লেখ করেন।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যখন নির্যাতন করেছে, তখনই কিন্তু এক শ্রেণীর লোক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তাদের নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা তো বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করবে না। তবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু রয়েছেন,” বলেন তোফায়েল আহমেদ।

বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব কীনা, তা নিয়েও নানান মত রয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, দিন দিন পরিবেশ আরও খারাপ হচ্ছে।

ফলে শেখ মুজিবসহ জাতীয় কোন ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কম বলে তারা মনে করেন।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর লন্ডনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব (ফাইল ফটো)
অনেক বিশ্লেষক অবশ্য এখনও আশা ছাড়তে চান না।

এম এম আকাশ মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এখনও যারা কথা বলেন, তাদের মধ্যে কমন ইস্যুতে সমঝোতা হলে বিভক্তির জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

তবে, আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, শেখ মুজিবকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে।

ঐকমত্যের প্রশ্নে সময়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর উপরও চাপ তৈরি হতে পারে বলে তাদের ধারণা।

তবে বিশ্লেষকরা এখনও প্রধান দুই দলের আচরণকেই বড় বাধা হিসেবে দেখেন।

SUMMARY

960-1.jpg

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরেন শেখ মুজিব (ফাইল ফটো)