জাহীদ রেজা নূর
তাঁদের বাঁচার কোনো কারণ ছিল না। প্রশস্ত ছিল ষড়যন্ত্রের থাবা, তাই সে সময় দেশে থাকলে সেই থাবার নিচে ক্ষতবিক্ষত হতে হতো তাঁদের। একে একে হত্যা করা হয়েছে ভাইদের, ভ্রাতৃবধূদের। ছোট ভাই রাসেল ভয়ার্ত মনে ভাবীদের কাছে খুঁজেছিল আশ্রয়। ভাবীরা লাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত আগলে রেখেছিল শিশু দেবরকে। এরপর শিশু রাসেলের শরীরেও গুলির ক্ষতচিহ্ন। এরই মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ওর মাকে। এবং হত্যা করা হয়েছে বাবাকে-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সিঁড়ির ওপর পড়ে আছেন তিনি। নীরব। নিথর। রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোডে তখন অমানিশার সব আঁধার।
আঁধার পুরো দেশজুড়ে। শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা জীবনের এই নির্মমতম ট্র্যাজেডির কথা জানলেন পরে। জানলেন দেশ থেকে অনেক দূরের এক শহরে বসে। দেশে ছিলেন না বলেই বেঁচে গেলেন তাঁরা। সে রাতে ঘুরে গিয়েছিল ইতিহাসের চাকা।২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী: শেখ মুজিবুর রহমান’ নামের গ্রন্থ।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছবি: বাসস
২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী: শেখ মুজিবুর রহমান’ নামের গ্রন্থ। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছবি: বাসস
২.
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। কাঁদতেও তখন ভয়। এ ধরনের অস্ত্র দিয়েই একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল বাঙালির ওপর। লাশের পাহাড় গড়ে মানচিত্রকে রক্তে লাল করতে চেয়েছিল তারা। সে কথা কেউ ভোলেনি। একাত্তরের পর সে রকমই এক আক্রমণের শিকার পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতে চাননি, বাঙালিদের কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে। তিনি ভুল করেননি। যারা তাঁকে হত্যা করেছিল, তারা হৃদয়ে বাঙালি ছিল না। তাদের শিকড় ছিল হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।
এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করল, তাদের কথা মনে রাখলেই সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে; সেখান থেকে চিত্কার করে যাচ্ছিল ফুলের পোশাকে ঢাকা শকুন। ধাতবকণ্ঠে তখন ‘হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে...’—হত্যাকে যেন শিল্পের রূপ দিতে চায় এই শকুনের দল!
তখন শ্বাপদের হিংস্র থাবার নিচে বাংলাদেশ। তখন ইতিহাসের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে উল্টো দিকে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়ি। এটি এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত
৩.
একাত্তর সালে যারা স্বজন হারিয়েছে, তারা জানে নিঃসীম অন্ধকার কাকে বলে। তারা জানে, কীভাবে একটি পরিবারে নেমে আসে কালবৈশাখী; কীভাবে বোধের আল ভেঙে দিশেহারা হয়ে যেতে থাকে মানুষ। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাও নিশ্চয় তা উপলব্ধি করেছেন। তাঁদের হাহাকার আমাকে স্পর্শ করে। আমাদের অনেককেই স্পর্শ করে। তেমনি, যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের স্বজনের শোক মিলেমিশে সমুদ্রের মতো হয়ে যায়।
৪.
বত্রিশ নম্বর সড়কের ওই বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে চেয়েছিল কুচক্রীরা। তারা প্রায় পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বেঁচে আছে শুধু দুই বোন। তাঁদের দীর্ঘশ্বাসের সাথি এখন অনেক মানুষ।
(এই লেখাটি ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম আলোর খোলা কলম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।)