মনোজ সাহা
কারা ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান যারা শেষবারের মতো বাংলা মায়ের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হাতে ছুঁয়ে দেখেছিলেন! তাঁর কাফনের কাপড়ের যোগান কি করে হয়েছিলো! স্বদেশীর ছোঁড়া বুলেটে ঝাঁঝরা তাঁর রক্তমাখা শরীর কোন সাবানে ধুয়ে স্রষ্টার কাছে সমর্পন করা হয়েছিল!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা জানেন না, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে জাতির সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের ৪৩ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসেও আমরা অনেকেই জানিনা কীভাবে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালির শেষকৃত্য পালন করা হয়েছিল। কারা ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান যারা শেষবারের মতো বাংলা মায়ের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হাতে ছুঁয়ে দেখেছিলেন! তাঁর কাফনের কাপড়ের যোগান কি করে হয়েছিলো! স্বদেশীর ছোঁড়া বুলেটে ঝাঁঝরা তাঁর রক্তমাখা শরীর কোন সাবানে ধুয়ে স্রষ্টার কাছে সমর্পন করা হয়েছিল!
দিনটি ছিল ১৯৭৫ এর ১৬ আগস্ট। শোকে যখন সমগ্র জাতি বিহ্বল তখন রাজধানী ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ এসে পৌঁছায়। নিজেদের রক্তাক্ত হাত ঢাকতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল ঘাতকদল।
জাতির পিতার কফিন হেলিকপ্টার থেকে নামিয়েছিলেন টুঙ্গিপাড়ার তৎকালীন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কাসেম, ক্যাশিয়ার, পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার আনোয়র হোসেন, স্থানীয় মেম্বার আব্দুল হাই; এছাড়াও গ্রামবাসীদের আকবর কাজী, মোঃ ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সেনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক, গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টারসহ অন্যান্যরা।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীদের জীবিতদের একজন টুঙ্গিপাড়া পৌর সভার মেয়র মোঃ ইলিয়াস হোসেন বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে শুনেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। সেদিন টুঙ্গিপাড়ার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মানুষ শোকে বিহবল হয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে টুঙ্গিপাড়া থানা সংলগ্ন হ্যালিপ্যাডে সেনা বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসা হয়। কফিন বহন করার জন্য আমিসহ অন্যান্যদের ডাকা হয়। আমরা হেলিকপ্টারের মধ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর কফিন বের করি। পরে বহন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে আসি।”
বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক নিবাসে লাশ বহন করে আনার পর কফিন খুলতে ডাকা হয়েছিলো ওই গ্রামেরই একজন কাঠমিস্ত্রীকে, যার নাম হালিম শেখ। সাথে সহযোগী হিসেবে ছিলেন মৃত হালিম শেখের ১০ বছর বয়সী ছেলে আয়ুব আলী শেখ যার বর্তমান বয়স ৫৩ বছর। মহান এই নেতার কফিন খুলবার ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে ধরা গলায় তিনি বলেন, “কফিন খোলার জন্য আমি ও আমার বাবা মরহুম হালিম শেখকে ডাকা হয়। আমি হাতুড়ি ও চেড়া শাবল দিয়ে কফিন খুলেই বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। গভীর শোকে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল আমার। তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না আমাদের প্রাণ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন। মনে হচ্ছিল, সে কফিনে ঘুমিয়ে রয়েছে। কিছু সময় আমি কাজের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ি। সেনা সদস্যরা দ্রুত কাজ করার ধমক দিলে আমার চেতনা ফিরে আসে। এ ঘটনার পর বেশ কয়েক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ গ্রহনকারীরা প্রায় সবাই মারা গেছে। আমি, ইদ্রিস কাজী, আনোয়ার হোসেন ও ইলিয়াস হোসেন এখন বেঁচে আছি।”
ষড়যন্ত্রকারী ও বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা স্থানীয়দের নির্দেশ দেন কফিনসহ দাফন করতে তবে ইমাম সাহেবের আপত্তি থাকায় তা সম্ভবপর হয়নি। মেয়র ইলিয়াস হোসেন জানান, “বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা সেনা সদস্যরা কফিনসহ লাশ কবর দেয়ার কথা বলে। মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। একজন মুসলমানকে ইসলামী বিধি বিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। সেনা অফিসাররা (সব নিয়ম সেরে) ১৫ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের অনুমতি দেন।”
এরপর খোলা হয়েছিল কফিনটি। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বঙ্গবন্ধুর সেই রক্তমাখা অবয়বের বর্ণনাও দিলেন তিনি, “বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলা হয়। বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়েছিল। গুলি গুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর হাতেও গুলি লেগেছিল। তখনও তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিলো সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবী। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবীর এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ।”
তার বর্ণনায় উঠে আসে কি বীভৎসভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত শরীরের উপরেও সহিংস হয়েছিল ঘাতকরা। ইলিয়াস হোসেন জানান, “যে তর্জনীর ইশারায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু জনসমুদ্রে ঢেউ তুলেছিলেন। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট কলোরাতে ঘাতকরা তাকে হত্যা করে তর্জণী কেটে দেয়।”
কফিন থেকে জাতির পিতার লাশ বের করার পরে তাকে গোসলের জন্য নেয়া হয়। স্থানীয় আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে কিনে আনা ৫৭০ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী গোসল করানো হয়েছিল বলে জানান তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে শেষ গোসল করিয়েছিলেন মন্নাফ শেখ, সোনা মিয়া ও ইমান উদ্দিন গাজী।
শেষ নিঃশ্বাস অবধি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে আসা এই মহানায়কের পোশাক ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে। সাদা সূতী পাঞ্জাবী-পাজামা আর কালো কোট ছিল তাঁর চিরচেনা রূপ। আর শিষ বিদায়ে কাফনের কাপড়টি যেন আরও সহজিয়া, আরও অনাড়ম্বর! রেডক্রিসেন্টের ত্রাণের যে শাড়ী এসেছিল দুঃস্থদের জন্য, তাঁর দেশের অসহায় মানুষের জন্য; সে কাপড় দিয়েই কাফন পরানো হয়েছিল তাঁকে। এপ্রসঙ্গে ইলিয়াস হোসেন বলেন, “রেডক্রিসেন্ট এর মালা শাড়ী আনা হয়েছিল। সে শাড়ীর জমিনে সাদা আর পাড়ে লাল-কালো ছিল। সেই পাড় ছিঁড়ে ফেলে বঙ্গবন্ধুর কাফন হিসেবে পরানো হয়েছিল।”
হত্যাকান্ডের দ্রুত সমাধা করতে সামরিক সেই সেনা কর্মকর্তারা জনসাধারণকে জানাযায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। দাফনক্রিয়ায় টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতী ও পাঁচকাহনিয়া গ্রামের মাত্র ৩০/৩৫ জন অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনকারী অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগে থেকেই টুঙ্গিপাড়ায় কবর খুঁড়ে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে দাফনে গ্রামের মানুষ অংশ নিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পথেই পুলিশ ও সেনা সদস্যরা তাদের বাধা দিয়ে আটকে দেয়। তারা দাফনে অংশ নিতে পারেনি।”
বায়ে কাঠমিস্ত্রী আয়ুব আলী শেখ ও ডানে মেয়র ইলিয়াস হোসেন।
জানাযা শেষে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জানাযা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন মরহুম মৌলভী আব্দুল হালিম। জাতির পিতার লাশ দাফন শেষে সেনা সদস্যরা ডাইরিতে শেখ আব্দুল মান্নাফের স্বাক্ষর গ্রহণ করে চলে যান। তবে কবর দেওয়ার পরেও সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কবরের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না। টুঙ্গিপাড়াবাসী বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ ও কুরআন খানি আয়োজন করেছিল।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক শেখ আবুল বশার খায়ের বলেন, “ওই দিন আমি বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ নিতে টুঙ্গিপাড়া আসতে গেলে পথেই আমাকে আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকজন আটকে দেন। দাফনের পর বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত বা শ্রদ্ধা নিবেদন নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনে গিয়ে অনেকেই পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছে। তারপরও পুলিশের বাঁধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু অনুরাগীরা কবরে এসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে লাশ টুঙ্গিপাড়া গ্রামে দাফন করে ওরা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।”
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, জনতার অবিসংবাদিত মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের প্রকৃতির প্রতিটি কণায় কণায় মিশে আছেন, থাকবেন যতদিন এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অস্তিত্ব নিয়ে থাকবে। জীবিত না থেকেও তিনি সমান অম্লান রয়েছেন আমাদের চেতনায়, মননে! তাঁর অনাকাঙ্খিত বিদায়ের দিনটিতে গভীর শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করছে প্রতিটি জীবিত বাঙালী স্বত্তা!