মোস্তফা কামাল পাশা
সামাজিক যোগাযোগের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যমটিতে অনুপ্রবেশ সর্ব সাম্প্রতিক। মাত্র মাস পেরিয়ে কয়েকদিন। অবশ্য পেশাগত কারণে টুইটার, গুগল প্লাজাসহ কিছু মাধ্যম ব্যবহার করছি আগে থেকে। বাংলায় টাইপ সমস্যার কারণে নতুন মাধ্যমে ইংরেজিতে পোস্ট–কমেন্ট করতাম। কিন্তু সাড়া ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই। ইংরেজিতে দখল কম বলেতো ভুল থাকবেই, এ’নিয়ে মনোকষ্ট নেই। কারণ ভাষাটা আমার নয়। তো কিছুদিন আগে ইংরেজি সাহিত্যের অমর নাট্যকার ও কবি সেক্সপিয়রের একটি জনপ্রিয় উধৃতি ‘লাইফ ইজ এ টেইল টোল্ড বাই এ্যান ইডিয়ট ফুল অফ সাউন্ড এ্যান্ড ফিউরি– সিগনাফাইয়িং নাথিং’ টাইমলাইনে লিখে উধৃতিটা কার ফেবু বন্ধুদের কাছে জানতে চাই। একটু মজা করতে, যিনি বলতে পারেন তার জন্য পুরষ্কারেরও ঘোষণা দেই। বিষ্ময়ের ব্যাপার, কয়েকজন পোস্টটাতে লাইক দিলেও কোন কমেন্ট নেই। এতে স্পষ্ট, আমাকে যারা অনুসরণ করেন, হয় তারা এটা পড়েন নি– অথবা আমার কোন লেখাই পড়েন না। নেতিবাচক কোন কথা লিখে কাউকে খাটো করার দুঃসাহস নেই। পরে অবশ্য, সহকর্মী ছোটভাই সৌমেনের টিপস অনুসরণ করে রিদমিক টাইপ নামিয়ে বাংলাও চর্চা করছি। কিন্তু অবিশ্বাস্য কান্ড হচ্ছে, আজেবাজে পোস্ট বা সুন্দরিদের নানা ভঙ্গির প্রোফাইলে লাইক কমেন্টের পোলাও কাবাবের বন্যা নামলেও নিজের পাতে লঙ্কাপোড়াও জোটেনা। কিন্তু দমে যাইনি। এই প্রজন্মের চর্চা, বুদ্ধি ও মানসিক বিকাশের সুলুক সন্ধানে মাধ্যমটি হচ্ছে সবচে দৃষ্টব্য বিলবোর্ড। এই বিলবোর্ডের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন বা সেলিব্রেটিরা হচ্ছেন তুমুল খ্যাতিমান অথবা আকর্ষণীয় সুতনুকা তন্বিরা। আরেকটি অদ্ভুত কান্ডও ফে’বুকে তুমুল ঢেউ তুলেছে। সেটা হচ্ছে অসংখ্য মিনি টিভি চ্যানেল। স্মার্টফোন আর কিছু কারিগরি জ্ঞান থাকলে এখানে যে কেউ মিনি টিভি চ্যানেল খুলে লাইভ অনুষ্ঠান চালাতে পারে। ফে’বু জানালা বন্ধ রাখলে এটা কখনো জানা হতো না। মানুষের জীবনটা খুবই ছোট। মহাকালের ছোট্ট একটি বুদবুদ মাত্র। জানাশোনা ও শেখার ভান্ডার সমৃদ্ধ করার সময় একেবারেই সামান্য। তাই শিক্ষক বা পন্ডিত নয়, নয় সেলেব্রেটি–ছাত্র হিসাবেই জীবনটা উপভোগে বিশ্বাসী আমি। কারণ পরিচিতি যত বাড়ে উটকো ঝামেলা বাড়ে তার চেয়ে বেশি। জীবন নিজের মতো উপভোগ বা পর্যবেক্ষণের সূযোগই থাকেনা। শেখাতো একেবারেই অসম্ভব। খ্যাতির বিড়ম্বনা কী বস্তু খ্যাতিমানরা তা ভালই জানেন। যদি মনে করেন, নিজে মশামাছি বলে এসব বড়ো কথা লিখছি, আপনার মনে এমন ভাবনা আসলে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেব না, হয়তো আপনিই ঠিক। তো ফে’বু আসক্তদের দুষণ নিয়ে আগেও লিখেছি তাই বেশি টানার দরকার নেই। নিজে সমাজ সংস্কারক বা মিশনারিও নই যে, ঘোলাস্রোতে ফিটকিরি মিশিয়ে স্বচ্ছ করার কঠিন দায়িত্ব টানব।
আমাদের পরম সৌভাগ্য জাতি হিসাবে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের দোরগোড়ায় এসে গেছি আমরা। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিজয়ের ৪৬ বছরে অর্জনের মতো আমাদের দায়ও অনেক ভারি। পবিত্র রবিউল আওয়াল এবং মাহে রমজানে দেশে ধর্মীয় আবেগের বান ডাকে। আবেগের জোয়ার কুলপ্ল্যাবি হলেও ধর্মীয় চেতনার মূল শিকড়টা শুকিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের অসাধারণ অর্জন যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও সপরিবারে হত্যাকান্ডের দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমরা বেশ আড়ম্বরের সাথে পালন বা উদযাপন করি। কোন কোন দিবসকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী অগুণতি আয়োজনও হয়ে থাকে। বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় শোক দিবস এবং বিজয় দিবসকে ঘিরে হয় ব্যাপক অনুষ্ঠান। প্রায় নয় বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এবং মানব ও জাতীয় উন্নয়নের নানা সূচকে দেশের অগ্রগতির কারণে উৎসব–আয়োজনের জাকজমক অনেক বেড়ে গেছে। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে ঘিরে তো দস্তুরমত নগরজুড়ে সপ্তাহ বা মাসব্যাপী বহু মেলা ও উৎসবের প্রতিযোগিতা চলছে। বঙ্গবন্ধু, জননেত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র ও বঙ্গবন্ধুর মহান সহধর্মীনীর নামে নগরীর জলাবদ্ধ খালে গজিয়ে ওঠা বেওয়ারিশ কলমি শাকের ঝাড়ের মতো অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠেছে। সব তালিকাবদ্ধ করতে হলে ‘সংগঠন শুমারি কমিশন’ তৈরি করতে হবে। পরষ্পরের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে এসব ভুইফোঁড় সংগঠন জাতীয় দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে উৎসব বা মেলা সাজাচ্ছে। রাজনীতিক বা কর্পোরেট ভি আই পিদের টার্গেট করে অতিথি বানাচ্ছে। নিজস্ব বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন মিডিয়ায় ছবি–খবর ছাপাচ্ছে। এদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী উল্লেখের কোন দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার আই টি খাতের উপদেষ্টা একমাত্র পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আশাবাদী আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের চেয়েও বেশি আসন পাবে। আমরাও চাই। কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে শীর্ষনেত্রী ও নেতাদের ধারণা না থাকলে আখেরে উল্টো কিছুও ঘটে যেতে পারে। কারণ দেশে মৌসুমী দেশপ্রেমিকের সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। বিশেষ ধর্মীয় দিবসে আমরা যেমন অতিরিক্ত ধার্মিক হয়ে যাই তেমনি। জাতীয় দিবসগুলো আসলে মেলা, উৎসব, আয়োজনের প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু এগুলো দেশ বা দলীয় আদর্শের টানে নয়। এসব আয়োজনে দেশপ্রেমের ন্যূনতম মিশেল নেই। মৌসুমি দেশপ্রেমিকরা মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদ, তিন লাখ মা–বোনের প্রাণাধিক ধন সম্ভ্রম নিয়ে একটুও ভাবেনা। বাণিজ্যিক লাভালাভ, নিজস্ব প্রচার এবং প্রসারই হচ্ছে তাদের দেশপ্রেমের বিলবোর্ড। এরা জাতেও পাঁচমিশালী। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের যারা তালিকা ধরে ঘর থেকে টেনে হিচড়ে বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে খুন করেছে–তাদের উত্তরসূরিরা সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরে ভিড়ে গেছে। নেতারা নিজের পক্ষ ভারি করতে এদের বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিচ্ছে –আশ্রয় দিচ্ছে। ক্ষমতা, পদ বিত্ত যখন সরকারি দলের নেতাদের মূল টার্গেট হয়ে যায়, তখন জন এবং অস্ত্র বলই তাদের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠে। দেশপ্রেম বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নয়। এ’অবস্থায় দিবস উদযাপন ও পালন হয়ে গেছে কর্পোরেট রাজনীতির বড় অস্ত্র। ক্ষণিকের বা মৌসুমি দেশপ্রেমিকদের দিয়ে আর যাই হোক, কোন বড় লক্ষ্য অর্জন একেবারেই অসম্ভব। সরকারি দলের অতিকায় শরীরের নাজুক স্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধা ঘাতকদের অনুগামীরা যখন ঘাটি গেড়েছে, তখন মুজিব কোটের বুকপকেটের উপর বঙ্গবন্ধুর কোটপিন শোভা পেলেও নেতাদের হৃদপিন্ডে তার অবস্থান মুছে যেতে বাধ্য।
অনুপ্রবেশকারীরা যেমন দলের বড় শত্রু তেমনি দেশেরও। অনুপ্রবেশের সংখ্যা যত বাড়ছে, সরকারি দলে দেশপ্রেমিক বা মুজিব আদর্শের প্রকৃত সৈনিকের সংখ্যা তত কমছে। দুর্ভাগ্য, ’৭৫ এর ইতিহাস দুমড়ে দেয়া জাতির জনক হত্যাকান্ডের যত মর্মান্তিক অন্তর্ঘাত যা কিছু ঘটেছে, সব ভুল মেরে বসে আছে সরকারি দল। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা বা ২০০৭ সালে তাকে গ্রেপ্তারের পরের ঘটনাপঞ্জি থেকে বিশালবপু দলটির শীর্ষনেতারা কিছুই শিখেন নি। বিপুল অনুপ্রবেশকারী স্রোতে দলটির তিকর মেদের বহর বেড়েছে। ডালাপালা বেড়েছে অগুণতি। কিন্তু দেশপ্রেম ও জাতির জনকের কর্ম ও আদর্শ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সরকার ও দলীয় নেতাদের মনে রাখা উচিত, দেশপ্রেম ছাড়া পৃথিবীতে কোন বড় জয় আসেনি, আসতে পারেনা।