বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল ও জাতীয় শিশু দিবস

অধ্যক্ষ মোঃ আসলাম হোসেন
গোপালগঞ্জ জেলার বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সেই গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী নদীর অসংখ্য শাখানদীর একটি বাইগার নদী। নদীর দুই পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে। পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে। প্রায় ২০০ বছর আগে মধুমতী নদী এই গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এ নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি দূরে সরে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরো অনেক গ্রাম। সেই ২০০ বছর আগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা এসে এই নদীবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত ছোট্ট গ্রামটিতে তাঁদের বসতি গড়ে তোলেন; এবং তাঁদের ব্যবসা–বাণিজ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। অনাবাদি জমিজমা চাষাবাদ শুরু করেন এবং গ্রামের বসবাসকারী কৃষকদের নিয়ে একটা আত্মনির্ভরশীল গ্রাম হিসেবেই এ গ্রামটিকে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রামরূপে গড়ে তোলেন। যাতায়াত ব্যবস্থা প্রথমে নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। পরে গোপালগঞ্জ থানা স্টিমারঘাট হিসেবে গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন, যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালে যে দুটি দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটিই জ্বালিয়ে দেয়। এ দালানকোঠায় বসবাস শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে, আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এ দালানেরই উত্তর–পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন বঙ্গবন্ধুর বংশের উর্দ্ধতন পুরুষ শেখ আবদুল হামিদ। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান এ বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। আর এখানেই ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল বঙ্গবন্ধুর আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর মায়ের দুই কন্যাসন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান বঙ্গবন্ধু। আর তাই বঙ্গবন্ধুর নানা তাঁর সব সম্পত্তি বঙ্গবন্ধুর মা কে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান,‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগদখ্যাত হবে।’

বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে, বর্ষার কাদা–পানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা; দোয়েল পাখির সুমধুর সুর বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে আকর্ষণ করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে–ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন। তিনি যা বলতেন, তারা তা–ই করত। আবার এগুলো দেখাশোনার ভার দিতেন ছোট বোন হেলেনের ওপর। এই পোষা পাখি, জীবজন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। মাঝেমধ্যে এ জন্য ছোট বোনকে বকাও খেতে হতো। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ–পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল মধুমতী ও বাইগার নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এ খালের পারেই ছিল বড় কাছারিঘর। এই কাছারিঘরের পাশে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলবি সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এঁরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন।

বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। তখন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূর। বঙ্গবন্ধু এই স্কুলে প্রথম লেখাপড়া করেন। একবার বর্ষাকালে নৌকায় করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকা ডুবে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাবা খালের পানিতে পড়ে যান। এরপর বঙ্গবন্ধুর মা তাঁকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। আর একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল, তাঁর এতটুকু কষ্ট যেন সবারই কষ্ট! সেই স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধুর বাবার কর্মস্থল ছিল। সেই থেকে গোপালগঞ্জেই তিনি পড়ালেখা করতে শুরু করেন। মাঝখানে একবার বঙ্গবন্ধুর পিতা মাদারীপুর বদলি হন। তখন কিছুদিনের জন্য মাদারীপুরেও বঙ্গবন্ধু পড়ালেখা করেন। পরে গোপালগঞ্জেই তাঁর কৈশোরবেলা কাটে।

বঙ্গবন্ধুর শরীর ছিল বেশ রোগা। তাই মা সব সময়ই ব্যস্ত থাকতেন কিভাবে তাঁর খোকার শরীর ভালো করা যায়। আদর করে পিতামাতা তাঁকে খোকা বলেই ডাকতেন। আর ভাই–বোন, গ্রামবাসীর কাছে ছিলেন ‘মিয়া ভাই’ বলে পরিচিত। গ্রামের সহজ–সরল মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে তিনি মিশতেন। বঙ্গবন্ধুর মা সব সময় ব্যস্ত থাকতেন খোকার শরীর সুস্থ করে তুলতে। তাই দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরি হতো। বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ সব সময় খোকার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই ছিপছিপে পাতলা ছিলেন, তাই মায়ের আফসোসেরও সীমা ছিল না–কেন তাঁর খোকা একটু হৃষ্টপুষ্ট, নাদুসনুদুস হয় না। খাওয়ার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাওয়ার শেষে দুধ–ভাত–কলা ও গুড় খুব পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর চার বোন ও এক ভাই ছিলেন। এই চার বোনের মধ্যে দুই বোন বড় ছিলেন। ছোট্ট ভাইটির যাতে কোনো কষ্ট না হয়, এ জন্য সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকতেন বড় দুই বোন। বাকিরা ছোট; কিন্তু পিতামাতার কাছে খোকার আদর ছিল সীমাহীন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বঙ্গবন্ধুর পিতা ও মাতার বোনদের ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে যারা পিতৃহারা–মাতৃহারা, তাদের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুন নিজেদের কাছে এনেই মানুষ করতেন। আর তাই ১৭–১৮ জন ছেলেমেয়ে একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর পিতাও খেলাধুলা পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধু আবদার করলে পিতা ও মাঝেমধ্যে খেলা দেখতে যেতেন।জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক লিখায় উল্লেখ করেন, ‘দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে,তোমার বাবা এত রোগা ছিল যে বল জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়ত। বাবা যদি ধারে কাছে থাকতেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো, মাঝেমধ্যে বাবার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো। আমি যখন ওই সব এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাঁরা বাবার ছোটবেলার কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে এই খেলার অনেক ফটো ও কাগজ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফলে সব শেষ হয়ে যায়।” স্কুলে পড়ার সময় পড়তে বঙ্গবন্ধুর বেরিবেরি রোগ হয় এবং চোখ খারাপ হয়ে যায়। ফলে চার বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকে। তিনি সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম ছিল হামিদ মাস্টার। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এবং বহু বছর জেল খাটেন। পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে যখন জেলে থাকতেন অথবা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে আসত, বঙ্গবন্ধুর মা মাঝেমধ্যে সেই মাস্টার সাহেবের নাম নিতেন আর কাঁদতেন। এমনিতে বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন। ছেলের কোনো কাজে কখনো তাঁরা বাধা দিতেন না; বরং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ, যখনই যেটা ন্যায়সংগত মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর পিতা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শিশুদেরও খুব ভালবাসতেন। শিশুরা তাঁর কাছে ছিল পবিত্রতার প্রতীক। শিশুকিশোরদের সাহচার্য তাঁর মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলতো। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি শিশুদের জন্য আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, তাদের জন্য নানারকম কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি বলতেন, আজকের শিশুরাই আগামীদিনের জাতির নেতৃত্বে দেবে। শিশুর সুস্থ সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা না দিলে প্রকারান্তরে জাতিই দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই শিশুদের শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানেগুণে সমৃদ্ধ ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ছিল। মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিশুদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশে তাঁর যেমন উৎসাহ ছিল তেমনি দুঃস্থ দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত শিশুকিশোরের জন্যও তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। এই ভালবাসা কোনো তাৎক্ষণিক আবেগসঞ্জাত নয়, শিশুরা যাতে তাদের অধিকার নিয়ে সমাজে বেড়ে উঠতে পারে, তাঁর জন্য বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক চেষ্টা ছিলো। ১৯৭৪ সনের ২২ জুন তিনি জাতীয় শিশু আইন জারী করেন। এ আইনে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শিশুর প্রতি অবহেলা, শোষণ বঞ্চনা নিষ্ঠুরতা নির্যাতন নিপীড়ন, অথবা শিশুকে বিপদসংকুল, অসামাজিক কাজে ব্যবহার করা– এসব থেকে শিশুজীবনের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয় এই আইনে।

স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত দেশ গঠনকালীন উদ্ভুত নানাবিধ অনাকাঙ্কিত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে নিহত না হলে তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক বিকাশ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে আরও অনেক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তা হলে হয় তো সমাজে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরভাবে শিশুনির্যাতন ও শিশুহত্যার অসু’ মানসিকতার উদ্ভব ঘটত না। বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্ন ছিল সস্থ’–সুন্দর বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন। শিশুদের যোগ্য মানুষ হয়ে গড়ে ওঠবার জন্য সমাজে যে শিশুবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন তার জন্য বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল। ১৯৭২ সালে কচিকাঁচার মেলার শিশুরা তাদের আঁকা ছবি নিয়ে গণভবনে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু রাশিয়া সফরে যাওয়ার সময় সে দেশের শিশুদের জন্য শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে আমাদের দেশের শিশুদের আঁকা এই ছবিগুলো নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তিনি শিশুদের শিল্পকর্ম দেখে বলেছিলেন, আমাদের দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। শুধু নিজের দেশের নয়, বিশ্বের সকল শিশুর জন্য তাঁর এই মনোযোগ আর ভালবাসা ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে দেশে জাতীয় শিশুদিবস পালন বন্ধ হয়ে যায়। তবে বেসরকারি ও দলীয় পর্যায়ে এ দিবস যথাযোগ্য গুরুত্বের সাথে পালিত হতো। ২০০৯ থেকে জাতীয় শিশুদিবস পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। দেশ ও জনগণের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য যে–কোন ধরনের আয়োজন, ব্যবস্থা বা কর্মসূচি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হওয়া কখনোই বাঞ্চনীয় নয়। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে অন্য কারো বা কোনো কিছুর তুলনা চলে না। তিনি স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা। তাঁর জীবন ও চরিত্র শুধু এ দেশের নয়, সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য মহান আদর্শ লিংকন, নেলসান ম্যান্ডেলা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসা, বিশ্বের এ সমস্ত বিখ্যাত মহান নেতার মতোই শেখ মুজিবুর রহমানও আদর্শ মানবের প্রতিমূর্তি। মধুমতির পাড়ের যে খোকা মা, মাতৃভাষা, মাটি ও মানুষের জন্য বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে আজীবন, আজ ১৭ মার্চ সেই মানুষটির জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণটিকে আমরা আমাদের খোকাখুকুর সামনে জীবন গঠনের উত্তর আদর্শ হিসেবে স্থাপন করতে পারি, যাতে আমাদের শিশুরা ভবিষ্যতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। শিশুদের সবকিছুকে সহজে বুঝতে পারতেন। আর এজন্যই তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আবার পালিত হচ্ছে জাতীয় শিশুদিবস। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ কি এতই ফেলনা যে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছুড়ে ফেলতে হবে? সরকারিভাবে তার জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে যাবে? বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির নেতা। তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির পিতা। অথচ ভিন্ন আদর্শের অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তার জন্মদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হবে না, তা কি ভাবা যায়? বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান মানে বাঙালির জাতির সত্তাকে অস্বীকার করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের দুঃখ–দুর্দশার সাথী হয়ে মানুষের মধ্যে অমর হয়েছেন। অহিংসা দিয়ে, মানবপ্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সমাজে যে আদর্শ তিনি তৈরি করে গেছেন তার কোনো মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই। আমরাও বঙ্গবন্ধুর মতো দেশকে ভালোবাসব। উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে উঠব। স্বাধীনতার শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে এ দেশকে গড়ে তুলব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবারের জাতীয় শিশুদিবসে এ–ই হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।

লেখক : অধ্যক্ষ, ডাঃ ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম।

গোপালগঞ্জ জেলার বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সাজানো সুন্দর একটি গ্রাম। সেই গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী নদীর অসংখ্য শাখানদীর একটি বাইগার নদী। নদীর দুই পাশে তাল, তমাল, হিজল গাছের সবুজ সমারোহ। ভাটিয়ালি গানের সুর ভেসে আসে হালধরা মাঝির কণ্ঠ থেকে। পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ গড়ে তোলে। প্রায় ২০০ বছর আগে মধুমতী নদী এই গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এ নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি দূরে সরে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরো অনেক গ্রাম। সেই ২০০ বছর আগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা এসে এই নদীবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমামণ্ডিত ছোট্ট গ্রামটিতে তাঁদের বসতি গড়ে তোলেন; এবং তাঁদের ব্যবসা–বাণিজ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। অনাবাদি জমিজমা চাষাবাদ শুরু করেন এবং গ্রামের বসবাসকারী কৃষকদের নিয়ে একটা আত্মনির্ভরশীল গ্রাম হিসেবেই এ গ্রামটিকে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রামরূপে গড়ে তোলেন। যাতায়াত ব্যবস্থা প্রথমে নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। পরে গোপালগঞ্জ থানা স্টিমারঘাট হিসেবে গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন, যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালে যে দুটি দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটিই জ্বালিয়ে দেয়। এ দালানকোঠায় বসবাস শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে, আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এ দালানেরই উত্তর–পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন বঙ্গবন্ধুর বংশের উর্দ্ধতন পুরুষ শেখ আবদুল হামিদ। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান এ বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। আর এখানেই ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল বঙ্গবন্ধুর আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর মায়ের দুই কন্যাসন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান বঙ্গবন্ধু। আর তাই বঙ্গবন্ধুর নানা তাঁর সব সম্পত্তি বঙ্গবন্ধুর মা কে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান,‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগদখ্যাত হবে।’

বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে, বর্ষার কাদা–পানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা; দোয়েল পাখির সুমধুর সুর বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে আকর্ষণ করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে–ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন। তিনি যা বলতেন, তারা তা–ই করত। আবার এগুলো দেখাশোনার ভার দিতেন ছোট বোন হেলেনের ওপর। এই পোষা পাখি, জীবজন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। মাঝেমধ্যে এ জন্য ছোট বোনকে বকাও খেতে হতো। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ–পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল মধুমতী ও বাইগার নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এ খালের পারেই ছিল বড় কাছারিঘর। এই কাছারিঘরের পাশে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলবি সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এঁরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন।

বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। তখন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূর। বঙ্গবন্ধু এই স্কুলে প্রথম লেখাপড়া করেন। একবার বর্ষাকালে নৌকায় করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকা ডুবে যায়। বঙ্গবন্ধুর বাবা খালের পানিতে পড়ে যান। এরপর বঙ্গবন্ধুর মা তাঁকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। আর একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল, তাঁর এতটুকু কষ্ট যেন সবারই কষ্ট! সেই স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধুর বাবার কর্মস্থল ছিল। সেই থেকে গোপালগঞ্জেই তিনি পড়ালেখা করতে শুরু করেন। মাঝখানে একবার বঙ্গবন্ধুর পিতা মাদারীপুর বদলি হন। তখন কিছুদিনের জন্য মাদারীপুরেও বঙ্গবন্ধু পড়ালেখা করেন। পরে গোপালগঞ্জেই তাঁর কৈশোরবেলা কাটে।

বঙ্গবন্ধুর শরীর ছিল বেশ রোগা। তাই মা সব সময়ই ব্যস্ত থাকতেন কিভাবে তাঁর খোকার শরীর ভালো করা যায়। আদর করে পিতামাতা তাঁকে খোকা বলেই ডাকতেন। আর ভাই–বোন, গ্রামবাসীর কাছে ছিলেন ‘মিয়া ভাই’ বলে পরিচিত। গ্রামের সহজ–সরল মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে তিনি মিশতেন। বঙ্গবন্ধুর মা সব সময় ব্যস্ত থাকতেন খোকার শরীর সুস্থ করে তুলতে। তাই দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরি হতো। বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ সব সময় খোকার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই ছিপছিপে পাতলা ছিলেন, তাই মায়ের আফসোসেরও সীমা ছিল না–কেন তাঁর খোকা একটু হৃষ্টপুষ্ট, নাদুসনুদুস হয় না। খাওয়ার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাওয়ার শেষে দুধ–ভাত–কলা ও গুড় খুব পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর চার বোন ও এক ভাই ছিলেন। এই চার বোনের মধ্যে দুই বোন বড় ছিলেন। ছোট্ট ভাইটির যাতে কোনো কষ্ট না হয়, এ জন্য সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকতেন বড় দুই বোন। বাকিরা ছোট; কিন্তু পিতামাতার কাছে খোকার আদর ছিল সীমাহীন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বঙ্গবন্ধুর পিতা ও মাতার বোনদের ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে যারা পিতৃহারা–মাতৃহারা, তাদের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা খাতুন নিজেদের কাছে এনেই মানুষ করতেন। আর তাই ১৭–১৮ জন ছেলেমেয়ে একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর পিতাও খেলাধুলা পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধু আবদার করলে পিতা ও মাঝেমধ্যে খেলা দেখতে যেতেন।জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক লিখায় উল্লেখ করেন, ‘দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে,তোমার বাবা এত রোগা ছিল যে বল জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়ত। বাবা যদি ধারে কাছে থাকতেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো, মাঝেমধ্যে বাবার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো। আমি যখন ওই সব এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যাঁরা বাবার ছোটবেলার কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে এই খেলার অনেক ফটো ও কাগজ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফলে সব শেষ হয়ে যায়।” স্কুলে পড়ার সময় পড়তে বঙ্গবন্ধুর বেরিবেরি রোগ হয় এবং চোখ খারাপ হয়ে যায়। ফলে চার বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকে। তিনি সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম ছিল হামিদ মাস্টার। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এবং বহু বছর জেল খাটেন। পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে যখন জেলে থাকতেন অথবা পুলিশ গ্রেপ্তার করতে আসত, বঙ্গবন্ধুর মা মাঝেমধ্যে সেই মাস্টার সাহেবের নাম নিতেন আর কাঁদতেন। এমনিতে বঙ্গবন্ধুর পিতামাতা অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন। ছেলের কোনো কাজে কখনো তাঁরা বাধা দিতেন না; বরং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ, যখনই যেটা ন্যায়সংগত মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর পিতা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শিশুদেরও খুব ভালবাসতেন। শিশুরা তাঁর কাছে ছিল পবিত্রতার প্রতীক। শিশুকিশোরদের সাহচার্য তাঁর মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলতো। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি শিশুদের জন্য আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, তাদের জন্য নানারকম কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি বলতেন, আজকের শিশুরাই আগামীদিনের জাতির নেতৃত্বে দেবে। শিশুর সুস্থ সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা না দিলে প্রকারান্তরে জাতিই দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই শিশুদের শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানেগুণে সমৃদ্ধ ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ছিল। মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিশুদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশে তাঁর যেমন উৎসাহ ছিল তেমনি দুঃস্থ দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত শিশুকিশোরের জন্যও তাঁর ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। এই ভালবাসা কোনো তাৎক্ষণিক আবেগসঞ্জাত নয়, শিশুরা যাতে তাদের অধিকার নিয়ে সমাজে বেড়ে উঠতে পারে, তাঁর জন্য বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক চেষ্টা ছিলো। ১৯৭৪ সনের ২২ জুন তিনি জাতীয় শিশু আইন জারী করেন। এ আইনে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শিশুর প্রতি অবহেলা, শোষণ বঞ্চনা নিষ্ঠুরতা নির্যাতন নিপীড়ন, অথবা শিশুকে বিপদসংকুল, অসামাজিক কাজে ব্যবহার করা– এসব থেকে শিশুজীবনের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয় এই আইনে।

স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত দেশ গঠনকালীন উদ্ভুত নানাবিধ অনাকাঙ্কিত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে নিহত না হলে তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক বিকাশ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে আরও অনেক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তা হলে হয় তো সমাজে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরভাবে শিশুনির্যাতন ও শিশুহত্যার অসু’ মানসিকতার উদ্ভব ঘটত না। বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্ন ছিল সস্থ’–সুন্দর বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন। শিশুদের যোগ্য মানুষ হয়ে গড়ে ওঠবার জন্য সমাজে যে শিশুবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন তার জন্য বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল। ১৯৭২ সালে কচিকাঁচার মেলার শিশুরা তাদের আঁকা ছবি নিয়ে গণভবনে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু রাশিয়া সফরে যাওয়ার সময় সে দেশের শিশুদের জন্য শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে আমাদের দেশের শিশুদের আঁকা এই ছবিগুলো নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তিনি শিশুদের শিল্পকর্ম দেখে বলেছিলেন, আমাদের দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। শুধু নিজের দেশের নয়, বিশ্বের সকল শিশুর জন্য তাঁর এই মনোযোগ আর ভালবাসা ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে দেশে জাতীয় শিশুদিবস পালন বন্ধ হয়ে যায়। তবে বেসরকারি ও দলীয় পর্যায়ে এ দিবস যথাযোগ্য গুরুত্বের সাথে পালিত হতো। ২০০৯ থেকে জাতীয় শিশুদিবস পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। দেশ ও জনগণের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য যে–কোন ধরনের আয়োজন, ব্যবস্থা বা কর্মসূচি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হওয়া কখনোই বাঞ্চনীয় নয়। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে অন্য কারো বা কোনো কিছুর তুলনা চলে না। তিনি স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা। তাঁর জীবন ও চরিত্র শুধু এ দেশের নয়, সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য মহান আদর্শ লিংকন, নেলসান ম্যান্ডেলা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসা, বিশ্বের এ সমস্ত বিখ্যাত মহান নেতার মতোই শেখ মুজিবুর রহমানও আদর্শ মানবের প্রতিমূর্তি। মধুমতির পাড়ের যে খোকা মা, মাতৃভাষা, মাটি ও মানুষের জন্য বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে আজীবন, আজ ১৭ মার্চ সেই মানুষটির জন্মের মাহেন্দ্রক্ষণটিকে আমরা আমাদের খোকাখুকুর সামনে জীবন গঠনের উত্তর আদর্শ হিসেবে স্থাপন করতে পারি, যাতে আমাদের শিশুরা ভবিষ্যতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। শিশুদের সবকিছুকে সহজে বুঝতে পারতেন। আর এজন্যই তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আবার পালিত হচ্ছে জাতীয় শিশুদিবস। কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ কি এতই ফেলনা যে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছুড়ে ফেলতে হবে? সরকারিভাবে তার জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে যাবে? বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির নেতা। তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির পিতা। অথচ ভিন্ন আদর্শের অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তার জন্মদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হবে না, তা কি ভাবা যায়? বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান মানে বাঙালির জাতির সত্তাকে অস্বীকার করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের দুঃখ–দুর্দশার সাথী হয়ে মানুষের মধ্যে অমর হয়েছেন। অহিংসা দিয়ে, মানবপ্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সমাজে যে আদর্শ তিনি তৈরি করে গেছেন তার কোনো মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই। আমরাও বঙ্গবন্ধুর মতো দেশকে ভালোবাসব। উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে উঠব। স্বাধীনতার শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে এ দেশকে গড়ে তুলব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবারের জাতীয় শিশুদিবসে এ–ই হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।

লেখক : অধ্যক্ষ, ডাঃ ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম।

SUMMARY

937-1.jpg