অধ্যক্ষ মোঃ আসলাম হোসেন
১৫ আগস্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুদের প্ররোচনায় মানবতার দুশমন, ঘৃণ্য ঘাতকরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ কারণে আজ বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন। ১৯৭৫ সালের এইদিনের কালরাত্রিতে ঘটেছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক ঘটনা। সেদিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্বকে বিনাশ করে। সেদিনের সেই নৃশংস এ ঘটনায় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন আর যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তারা হলেন– বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিল। ইতিহাসের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সেদিন আরো প্রাণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ রিন্টু খানসহ অনেকে। আগস্ট মাসটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে শোকের মাসে পরিণত হয়েছে আজকের এই দিনটির জন্য। ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেও সেদিন দেশে না থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। সে সময় স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে সন্তানসহ অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ রেহানাও ছিলেন বড় বোনের সঙ্গে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে আজ পালিত হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদত বার্ষিকী।বঙ্গবন্ধুর জীবন খুব একটা দীর্ঘ ছিল না। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তিনি তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন স্থানীয় দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। মা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫৫ বছর। পৃথিবীতে খুব কম নেতাকেই পাওয়া যাবে যিনি জীবনের এই সময়কালের বেশিরভাগটাই কারাগারে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮ এর সরকার বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেশে–বিদেশে তাঁকে এক কালজয়ী নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনায় বিশ্ববাসীর কাছে তিনি উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। কালজয়ী এই নেতার আহবানে বিশ্ববাসী বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু তৃতীয় বিশ্বের আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী নেতা হিসাবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ অধিবেশনের পর ওয়াশিংটনে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ১৯৭৪ সালের ১ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। বঙ্গবন্ধু মিসেস ফোর্ডের অসুস্থতা নিয়ে কুশলবিনিময়ের পর সোজা চলে যান মূল বিষয়ের আলোচনায়। দেশে খাদ্যের চরম সংকট। অনতিবিলম্বে খাদ্য সহায়তা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বললেন, তাঁর দেশে খাদ্যশস্যের ফলন আশানুরূপ হয়নি। বড়জোর আড়াই লাখ টন গম দিতে পারবেন। এর মধ্যে দেড় লাখ টন হাতে আছে, বাকি এক লাখ টন সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আসছে–এ খবরটি তখন জরুরি ছিল। খাদ্য ঘাটতিকে পুঁজি করে অনেকেই চাল–গমের মজুদ গড়ে তুলেছিল, এ খবরে সেই খাদ্যশস্য বাজারে ছেড়ে দেবে, দামও কমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ চলছে, এটি সম্ভব হলে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে। সে প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু জানালেন, দেশে ১০ থেকে ২০ টিসিএফ গ্যাসের মজুদ আছে, তেল অনুসন্ধানের জন্য আমেরিকার দুটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সবার জানা। তবু তিনি নিঃসংকোচে বললেন পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির কথা, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের কথা, এসব প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর নির্বিকারত্বের কথা জানালেন জেরাল্ড ফোর্ডকে।
দেশে কিংবা বিদেশে, যখনই কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন, দেশের স্বার্থের প্রসঙ্গ প্রথম সুযোগেই তিনি উত্থাপন করেছেন, নির্দ্বিধায়। মানুষের নেতা তিনি, দেশের আনাচ কানাচে হেঁটেছেন, মানুষের প্রয়োজন, দেশের প্রয়োজন তাঁর চেয়ে বেশি কে জানেন! তাই তাঁকে নির্ভর করতে হয়নি আমলাদের ওপর, কূটনীতিকদের ব্রিফিং বা নোটের ওপর। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ঘুরে দিল্লিতে নেমে বিপুল সংবর্ধনার জবাবে অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন বঙ্গবন্ধু। আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাঁর দেশের সৈন্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানালেন। তখনো তিনি স্বাধীন দেশে পা রাখেননি। তবু মাথায় রেখেছিলেন সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি, বন্ধুত্বের সংকোচে হারিয়ে যায়নি প্রখর বাস্তবতাবোধ।মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু দেশ সোভিয়েত রাশিয়া সফরে গিয়ে তিনি বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দর সচল করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে এসেছিলেন।
১৯৭৩ সালে অটোয়ায় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে মূল বৈঠকের আগেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগি ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করার ব্যাপারে তিনি স্বাগতিক দেশ কানাডা ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী। সেই সফরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বৈঠকে বঙ্গবন্ধু রেজুলেশনের প্রস্তাব দিলে কানাডা ও যুক্তরাজ্য সমর্থন করে। তবে তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে আপত্তি তুললেন। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর যুক্তি খণ্ডন করে বললেন,‘কমনওয়েলথের সম্মেলনে যোগ দিতে পৃথিবীর অর্ধেক পথ উড়ে এসেছি। এই সংস্থার সদস্য হিসেবে একটি রেজুলেশনও যদি না পাই, তাহলে কী লাভ? পরে রেজুলেশন গৃহীত হলো।
জ্যামাইকার কিংসটনে ১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হয়েছিলেন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াকুবু গাওয়ান। জিজ্ঞেস করেছিলেন, পাকিস্তান একটা শক্তিশালী দেশ। আপনি কেন এই দেশটিকে ভাঙলেন? বঙ্গবন্ধু অপ্রস্তুত হননি। স্বভাবসুলভ অট্টহাসি হেসে জবাব দিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে শক্তিশালী। তার চেয়েও শক্তিশালী এশিয়া মহাদেশ। আর বিশ্ব এশিয়ার চেয়েও শক্তিশালী। তবু কি এই বিশ্বকে এক রাখা গেছে? তাঁর এই তাৎক্ষণিক জবাবে নির্বাক বনে যান নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু তাঁর গলায় ঝোলানো চাদর ঝুলিয়ে দিলেন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের গলায়, সহাস্য বিদায় নিলেন। এমন অনেক নজির রয়েছে, দ্বিপক্ষীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সব সময়ই অন্য রাষ্ট্রনেতাদের কাছে উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, যিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের নেতা। গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে লম্বা পাঁচ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার শেখ মুজিব বিশ্বসভায় নজর কাড়তেন তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল নিউজ উইক সাময়িকীতে তাঁকে বলা হয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে টাইম ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়, উপমহাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত কার্যকর জনপ্রিয় নেতা হওয়ার সব ব্যক্তিগত গুণ রয়েছে তাঁর।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে চমৎকৃত হয়েছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। আলজিয়ার্সে ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কিউবার প্রধানমন্ত্রী ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি। তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় এই মানুষটি হিমালয়ের প্রতিভূ। তাঁকে দেখে আমার হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।” কাস্ত্রো তাঁর জীবদ্দশায়ই দেখছেন তাঁর দেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন। তাঁর দেশে পাট রপ্তানি করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। খাদ্য সহায়তার জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে শাস্তি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আজ বাংলাদেশের প্রতিও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে ওয়াশিংটনের, যা বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পারেননি।
১৯৭৫–এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পেছনে হাঁটে বাংলাদেশ, কলঙ্কিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও। স্বাধীনতার প্রসব বেদনা সহ্য করা মুজিবকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চলে ইতিহাস থেকে, গণমানুষের মন থেকে। কিন্তু বাঙালির রক্তে মিশে থাকা প্রিয় নেতা মুজিবকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। বরং স্বমহিমায় জাতির সামনে আরো শক্তিশালী বিশ্বনেতা রূপে ফিরে এসেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাত্র ৪৪ মাস সময় পেয়েছিলেন। এরই মধ্যে অনেক কিছুরই সূচনা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলো তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সময়। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়েও কাজ এগিয়ে রেখেছিলেন তিনি। চুক্তি সম্পাদনও হলো তাঁর কন্যার হাত ধরে, ১৯৯৭ সালে। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ঘাতকের বুলেট থামিয়ে দেয় সেই প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে থেমে যায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন। সেই সমুদ্রসীমাও নির্ধারিত হয়েছে চার দশক পর, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, মিয়ানমারের সঙ্গেও নিষ্পত্তি হয়েছে সমুদ্রসীমা বিরোধ। সমুদ্রেও এখন নতুন আরেক বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকার সঙ্গে যমুনা সেতু নির্মাণে সহযোগিতা চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ লক্ষ্যে একটি যৌথ ইশতেহারও ঘোষণা করেছিলেন দুই প্রধানমন্ত্রী। সেই সেতু চালু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ২২ বছর পর, ১৯৯৮ সালে যখন তাঁর মেয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের কাছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সীমিত আকারে চাল রপ্তানিও করছে এখন। গ্যাসসম্পদ সুরক্ষায় শেখ মুজিবের দূরদর্শিতার সুফল ভোগ করছে আজকের বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট সাড়ে চার মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে পাঁচটি তেল–গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নিয়েছিলেন বিদেশি কম্পানির কাছ থেকে। সেই পাঁচটি ক্ষেত্র এখন দেশের গ্যাসের চাহিদার এক–তৃতীয়াংশ মেটায়। এত বছর ব্যবহারের পরও এই ক্ষেত্রগুলোতে মজুদ থাকা বর্তমান গ্যাসের বাজারমূল্য ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন উত্থানপর্বে। ২৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পাশাপাশি মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রো রেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে উৎক্ষেপণ, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজও বাস্তবায়ন করছে সরকার। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে অবকাঠামো খাতে এশিয়ার বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর কাতারে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডর এবং ভারতসহ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর পণ্য বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হবে।
গেল বৎসরে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা বিএমআই রিসার্চ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভবিষ্যতের উদীয়মান ১০টি সেরা বাজারের তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে তারা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘সিএনএন মানি’ গত প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশেএখন বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ প্রবৃদ্ধির দেশ। আর বিশ্বব্যাংক গত প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে,বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশের ও বেশী। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনায় ভারতের পরেই জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে যে উন্নয়ন শুরু হয়েছিল তা এখন মধ্যগগনে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ। তারা বলেছে, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ।
কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, শিক্ষাসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে স্থাপিত করে দিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই পথেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে বাংলাদেশ আজ নানা বৈশ্বিক সূচকে সম্ভাবনার শীর্ষে স্থান পাচ্ছে। একদিন বিশ্বসভায় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বের ৫৭তম দেশে হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে । বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ স্বপ্নপূরণের অভিযাত্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত । জয় বাংলা। জয়বঙ্গবন্ধু।
লেখক : অধ্যক্ষ, ডাঃ ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম।