বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র চেয়েছেন বাংলাদেশের ধাঁচে

অনুপম সেন
বছরের আবর্তনে আবার ফিরে এসেছে শোকাবহ আগস্ট মাস। আগামী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫–এর এই কালো দিনটিতেই জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, আবহমান বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

রক্তঝরা এই দিনটিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার–পরিজনসহ নৃশংসভাবে শহীদ হন ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে। কিছু বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকের চক্রান্ত এবং সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারান তার প্রিয় সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল ও দশ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল এবং নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল।

মধ্য আগস্টের সেই হত্যাকাণ্ডে আরো প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমকর্তা ও কর্মচারী।

বঙ্গবন্ধু আমাদের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয়তা দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আজীবন কাজ করেছেন। তিনি স্বল্পতম সময়ে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সংবিধান রচনা করেছেন। শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রথম পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, যার মূল কথা দারিদ্র্য দূর।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন শোকাবহ আগস্ট মাস শুরুর প্রাক্কালে গতকাল এ ব্যাপারে নিজের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন দৈনিক আজাদীর কাছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সেই মানুষ, যিনি বলেছিলেন, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার নিঃশ্বাসে–প্রশ্বাসে। তাঁর সেই সাহস ছিল, মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তুলবার অনমনীয় ব্যক্তিত্বের জোর ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠবার আগেই তিনি এই নামটির সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব এক করেছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। এই অর্থে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। শক্তি, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নারী মুক্তি, শ্রমিক স্বার্থ কত কিছুই না তার ভাবনায় ছিল। তিনি ইতিহাস ও সংস্কৃতি পাঠকে গুরুত্ব দিতেন। পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন, আবার পাকিস্তান অর্জনের মাত্র ৭ বছর পর ১৯৫৪ সালে বাঙালির রাজনীতির রূপরেখা সামনে নিয়ে আসায় অবদান রাখেন।

অনুপম সেন বলেন, স্থানীয় চিন্তার সাখে বৈশ্বিক চিন্তার মেলবন্ধন ঘটাতেন বঙ্গবন্ধু। ‘বিশ্বামানব হবি যদি, কায়মনে বাঙালি হ।’ এ কথা তিনি ধারণ করতেন। শৈশব থেকে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন–সবসময় কাজ করে গেছেন সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলাতে। ডেভিড ফ্রস্টারের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা একমাত্র যোগ্যতা মানুষকে ভালোবাসতে পারা। সবচেয়ে বড় দুর্বলতার উত্তরও ছিল তাই।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের মূল দ্বন্দ্ব ছিল শাসকরা গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করেছিল। ১৯৫৪ সালের পর প্রথমবারের মতো একজন নেতা ১৯৭০ সালে জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। তিনি জনগণকে বুঝালেন স্বশাসনের কথা। তিনি বলেছিলেন দুঃখী মানুষরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের জন্য কিছু করতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে তারাই সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরিয়েছে। তারা আপসের কথা ভাবেনি। আমি মনে করি দুঃখী মানুষের মুক্তি–এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের রাজনৈতিক র্কমকাণ্ডের মূল বিষয়।

অনুপম সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন গরিব মানুষের গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্র চেয়েছেন বাংলাদেশের ধাঁচে। তিনি বলতেন, ব্যক্তিমালিকানা, সমবায় ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা ক্ষেততমজুর–কৃষকরা সমবায়ে যোগ দেবে। রাষ্ট্র কৃষিকাজে সহায়তা দেবে। জমির মালিক, কৃষক যার যার মতো ফসলের ভাগ পাবে। তিনি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। এসব যাতে সফল না হয় সেজন্যই তাকে হত্যা করা হয়।

কেমন ছিল তাঁর নীতি ও আদর্শ? জানতে চাইলে অনুপম সেন বলেন, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইস্পাত–কঠিন। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র চিন্তাজুড়েই ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। সুদৃঢ় সংকল্পবোধ নিয়েই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়–আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিচক্র তাঁকে দেশের অভ্যন্তরে সপরিবারে হত্যা করেছিল। ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা কখনোই সফল হবে না বলে বিশ্বাস করেন অনুপম সেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণেই তাঁর পুরো দর্শনটা ফুটে উঠেছে। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বলেছেন কীভাবে দিনের পর দিন বাঙালি শোষিত হয়েছে, কীভাবে পাকিস্তান বাঙালিকে শোষণ করছে। তিনি বলেছেন আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি মানুষের অধিকার চাই। এই অধিকার বলতে তিনি মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। সংবিধানের চার মূলনীতিতে তা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি বলেছেন, আমি শোষকের গণতন্ত্র চাই না, শোষিতের গণতন্ত্র চাই। আমি আমার দেশের মতো করেই সমাজতন্ত্র কায়েম দেখতে চাই।

অনুপম সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন মানুষ যেন মানুষের অধিকার নিয়ে মানুষের মর্যাদায় বেঁচে থাকতে পারে। আর তার জন্য অবশ্যই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতির অধিকার থাকতে হবে। সেই অধিকার আজও বাস্তবায়িত হয়নি। তার মানে এটা নয় যে, বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টা চলছে না। বাংলাদেশে চেষ্টা চলছে। যেমন খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারছে বাংলাদেশ। এটা ধরে রাখতে হবে। জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যেতে হবে। শোষিতের গণতন্ত্র অর্জন করতে হবে। সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব যারা করেন তারা কি শোষিতের কথা বলেন? আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি তিনি খুব সিনসিয়ার। কিন্তু তার আশপাশের মানুষগুলো কি তার মতো? বর্তমানে দেশে প্রতিক্রিয়াশীলতা একটা বড় শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের প্রতিনিয়ত লালন–পালন করে চলেছে। এ অবস্থায় আমাদের থেমে গেলে চলবে না। সম্মিলিতভাবে আন্দোলন–সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। একদিন সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবেই। সেদিন হয়ত আমি থাকব না, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করবে।

বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন কতটা পূর্ণতা পেয়েছে? জানতে চাইলে এ প্রবীণ সমাজবিজ্ঞানী বলেন, যিনি নিজেও চাটুকারদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই চাটুকারের দল যাতে শেখ হাসিনার চাটুকারে পরিণত না হয় তার প্রতি নজর রাখতে হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে চাই সম্পদের সুষম বণ্টন। আমাদের অগ্রগতি আছে। ১৯৭২ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখন ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে। তবে বৈষম্য বাড়ছে। তারপরও বলব, কম আয়ের লোকেরা আগের চেয়ে ভালো আছে। শেখ হাসিনার অনেক কর্মসূচি আছে গরিবের জন্য। সামাজিক সুরক্ষা–বলয় ফল দিতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার সময় নারীদের মাত্র ৪ শতাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। এখন তা ৪০ শতাংশ। এসব সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার জন্য। দেশ বিশ্বসমাজে মর্যাদার আসন ফিরে পেতে শুরু করেছে। বিশ্বের তিনটি বড় অর্থনীতির দেশ ভারত, চীন ও জাপান বাংলাদেশের পাশে আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। একটু একটু জীবনমান উন্নত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়াই সমস্যা। তিনি মানুষকে কীভাবে দেখতেন তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। উদার চিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি। শুধু অর্জন নয়, ভোগ নয়; দেশকে দিতে হবে।

অনুপম সেন বলেন, স্বাধীন এ জাতিকে দেশি–বিদেশি কুচক্রী মহল বহুবার পরাধীনতার নাগপাশে বন্দী করতে চেয়েছে। সফল হয়নি। পিছু হটে ফের নতুন কোনো ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে তারা। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই দাবিয়ে রাখতে পারবে না বাঙালি জাতিকে। কারণ আমাদের আছেন একজন শেখ মুজিব। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে তাকে হত্যা করে সেই কুচক্রী মহলটি ভেবেছিল ইতিহাসের পাতা থেকে শেখ মুজিবের নাম–নিশানা মুছে দেবে। পারেনি তারা। যিনি নিজেই ইতিহাস, যাঁর অমর কীর্তি গাঁথায় সমৃদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাস, তাকে মুছে ফেলবে, এমন সাধ্য কার? বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ একই সূতোয় গাঁথা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তিনি বেঁচে থাকবেন, প্রেরণা যুগিয়ে যাবেন আমাদের।

SUMMARY

933-4.jpg