ক্রুরতার চুম্বক ইশারায়: মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বিজয়

অরুণ দাশগুপ্ত..

কবিতা পড়ে কাব্যরসিক পাঠকের পেট ভরে না, মন ভরে। আনন্দ ও চিত্তের প্রসার ঘটে।

জার্মান দার্শনিক হোয়াইটডের কথায় বলা যেতে পারে, Poetry is something which adds the soul’s self attainment..

কবিতার সার্থকতা বিচার হয় তখন, যখন কবিতা মন ভরাতে পারে। কবির কাব্যরচনার সার্থকতাও সেখানে। তার পরও কবিতা কী? কী তার কাজ, কবিতা লেখা হয় কীভাবে? ইত্যকার প্রশ্ন একবিংশোত্তর শতাব্দীতে এসেও কবি ও পাঠকের মনে ঘোরা ফেরা করে। এর কারণও যে নেই, তা নয়। পাশ্চাত্যে কবিতা নিয়ে মতানৈক্যের শেষ নেই। জেএম সিঙ্গের কাব্যনাট্যগুলোর ভূমিকা লিখতে গিয়ে W.R. Reogerr কবিতাকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। একটিthe poetry of real lifeথ অন্যটিthe poetry of a land of fancy . এই ভাগ মোটা দাগের। জবড়মবৎৎ কী ভেবে এমন ভাগ করেছেন সেটা আমাদের জানা নেই। তবে আমার মতে কোন কবিতা–ই বাস্তববর্জিত নয়। এ প্রসঙ্গে ফুল গাছের কথা ধরে নিয়ে বলা যায় ফুল আকাশের দিকে চেয়ে ফুটলেও ফুল গাছের শিকড়টি থাকে মাটিতে। মাটি থেকে রস টেনে নিয়ে ফুলগাছ বেঁচে থাকে। তার জীবনশক্তি মাটিতে। তবে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনারও মিশেল থাকতে হয়। ‘কল্পনা’ ছাড়া কবিতার জন্ম অসম্ভব। কল্পনাতেও থাকে কবির ভাষায় কিছু তার ‘জৈব’ কিছু তার ‘দৈব’। কবিতার স্পর্শে চেনা জগৎ নিমেষে হয়ে যায় অচেনা, রহস্যময় হয়ে ওঠে বলে মনে হয় কবিতায় বুঝি জাদু আছে। সব দেশের ইতিহাসে তাই মিথ, জাদু, কবিতা একাকার হয়ে যায়, অথচ কবিতা কোন দৈব ব্যাপার নয়, কবি প্রতিভাও শ্রমের ফসল। তবে তার রূপান্তর ক্ষমতা এত গভীর ও ব্যাপক যে তাকে বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ জন্য আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ বলেছিলেন–অ চড়বস ংযড়ঁষফ হড়ঃ সবধহ, নঁঃ ঃড় নবব্থ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, কবিতা বিশ্লেষণযোগ্য নয় বরং অনুভববেদ্য। পাঠক কবিতা যদি সহৃদয়তা দিয়ে পাঠ না করেন তাহলে তিনি কবিতার অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে পারেন না। কবি সাথী দাশের কবিতাগ্রন্থ ‘ক্রুরতার চুম্বক ইশারা’ গ্রন্থিত কবিতাগুলোও যদি পাঠক ঈষৎ মনোযোগ দিয়ে পড়েন তবে তাঁরাও অনুভবের আনন্দরসে সিক্ত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।

সাথী দাশ ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে কবিতা চর্চা ও অনুশীলনে সক্রিয় থাকলেও তাঁকে সত্তরের দশকের কবি হিসেবেই গণ্য করা শ্রেয়। কারণ সত্তরের দশকের প্রারম্ভ থেকেই তাঁকে কাব্য ও ‘ছোট পত্রিকাও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। সাথী দাশ একজন মুক্তিযোদ্ধাও। এক সময় তিনি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সঙ্গত কারণে এসবের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার ‘চুম্বক ইশারা’ রয়েছে তাঁর ক্রুরতার চুম্বক ইশারা’ নামধেয় কাব্যগ্রন্থটিতে।

আগেই বলা হয়েছে সাথী দাশ সত্তরের দশকের কবি। সত্তরের দশক ঐতিহাসিক–রাজনৈতিক–সামাজিক ও সংস্কৃতির দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সত্তরের শুরুতেই বাঙালির অবিস্মরণীয় ঐক্য বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন যে প্রেক্ষাপটে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছিলো, সেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই তাঁর দল ৭০–এর নির্বাচনে বাঙালি জাতির নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করে। ৭১–এ পাকিস্তানি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত ভাষণ সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে এক তর্জনীর ডগায় একট্টা করে তোলে। এরপর পাকিস্তানি চক্রের অনমনীয়তা এবং অনৈতিক আক্রমণ বাঙালি জাতিকে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ–ত্রিশলক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন–যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পাকিস্তানীদের পক্ষ অবলম্বন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে বিজয় অর্জন। বিজয়ের আবেগ, যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা, পাশাপাশি বিপর্যস্ত দেশের পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক চক্রান্তে ১৯৭৫–এ বাঙালির নেতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পট পরিবর্তন। এর পর সামরিক শাসন। এসব ঘটনার আবর্তে বাংলাদেশের সত্তরের দশকের কবিতা প্রভাবিত হয়েছে অবশ্যই। সত্তরের কবিতার প্রবণতার দিকে মনোযোগ দিলে এসব ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রচার আবিষ্কার করা কঠিন নয়।’ সাথী দাশের কবিতাগুলোতেও সত্তরের কবিতার প্রবণতা দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

সত্তরের দশকের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে কবিতা কর্মী ‘স্পার্ক জেনারেশন’ নামধেয় একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। ‘এন্টি এ স্ট্যাব্লিশমেন্ট’ এই সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয় সত্তরের দশকের কয়েকজন কবির উদ্যোগে। তবে এই আন্দোলন খুব বেশিদূর এগুতে পারেনি। কবি সাথী দাশ এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি। সম্ভবত তিনি মনে করেন, কবিতা গণমানুষের সুখ–দুঃখ, হর্ষ–বিষাদ আশা–নিরাশার চিত্র ফুটে উঠতে হবে। কিন্তু কবিতায় ব্যক্তি মানুষের, বিশেষ করে অনুভবের কথাও বিম্বিত হয় সেটা তিনি বিস্তৃত হননি। ক্রুরতার চুম্বক ইশারা’ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পুরুষোত্তমের হুংকার ধ্বনি’ কবিতাটিতে কবি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ঊনিশ’শ একাত্তরের সাতই মার্চ ঢাকার রেস কোর্সের ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে দৃপ্তকন্ঠে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ও দেশের স্বাধীনতা লাভের জন্য এদেশের জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যদ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে ডাক দিয়েছিলেন তারই কথা পাঠককে মনে করিয়ে দেয়। যেমন:

‘নিজেদের ভাষা, দেশ–মাটি–অস্তিত্বের পরিচিতি খুঁজে নিতে

এক পুরুষোত্তমের হুংকার ধ্বনি মায়াবী শিষ ছড়ায় এলোমেলো বাতাসে,

ভেতরগত অনুভবে, শোনা যেতো শুধুই ধ্বনি ঐ সুর। মানুষের দুঃখে,

মানুষের সুখে, ঐ ধ্বনি, ঐ সুর আলোড়িত হতো বুকের ভেতর।

দিন দিন প্রতিদিন যে ঐ ধ্বনি–ঐ সুর রক্তে জাগাত শিহরণ,

রক্তে জাগানিয়া শিহরণে মানুষের সাথে মানুষের মেল বন্ধনে

অসুরের মুখোমুখি হয়; রক্ত বন্যায় ভাসে এদেশ এ মাটি।

বীভৎস অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষেরা অতঃপর একদিন

সোনালী স্বপ্নের পতাকা হাতে নবজন্মের ঠিকানা খুঁজে পায়।’

এতো গেল দেশ ও জাতির মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্তির কথা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নব প্রজন্মের চোখে স্বাধীনতা কীভাবে প্রতিভাত হচ্ছে, স্বাধীনতাকে কীভাবে দেখছে

একালের নতুন প্রজন্ম সেটাও কবি বর্ণনা করেছেন কবি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্ত স্বাধীনতা পাওয়ার পর যে তার সুফল যতটা যেভাবে পাওয়ার কথা সেটা যে পায়নি তার চিত্রটি কবি ফুটিয়ে তুলেন ‘নবপ্রজন্মের চোখে’ কবিতায়। যথা–

‘সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই আকাশ জুড়ে

কালো মেঘের লুকোচুরি। খেলার চোখে দেখেছিল নিশ্চয়,

অদূরদর্শিতার নিস্পৃহ প্রশ্রয়ে খেলতে খেলতে সময় ক্ষয়,

অথচ ফাঁক ফোকরে বাড়তেই থাকে গোকুলে ঘাতক।

নেকাব আর আলখেল্লা খুলে ফেলে নেকড়ের দল;

খামচে রক্তাক্ত করে স্বাধীনতার স্বাক্ষর সৌধ

‘বৃক্ষরোপণের বুদ্ধিমান চালে মুছে ফেলে স্মৃতি চিহ্ন;

৭ ই মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান

নবপ্রজন্মের চোখে শোভাময় পার্কের ছবি ভাসে।’

ষোল ডিসেম্বর ‘বিজয় দিবস’ উদযাপন যে বর্তমানে নিছক আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কবির অনুভবে সেটা ধরা পড়েছে ‘বিজয়ের অর্থটা কী মানুষ জানে না’ শিরোনামের কবিতাটিতে। কবির মতে,

‘লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে নির্মিত এ স্বদেশভূমে

গণতন্ত্রের খোলা বাতাসে স্বদেশী শাসকেরা হাঁটতেই শিখলো না।’

স্বাধীনতোত্তর দেশে আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অনেকটা নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়েছে, স্বদেশেউ উদ্বাস্তুর মতো হয়ে গেছে কবি তা বেদনার সঙ্গে অনুভব করেছেন ‘স্বদেশে পরবাসী’ নামাংকিত কবিতায় কবি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন;

‘নিজ মাতৃভূমে উদ্বাস্তুর মতো পড়ে থাকে লাশ রাস্তায়

এভাবে দিন কাটে মানুষের মধ্যে মানুষের জীবন।’

এদেশ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশ এই ঐতিহাসিক সত্য ভুলে গেছে বললে অসত্য হবে না। এখনও স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাঙা, তাদের উৎখাত করার ঘটনা মাঝে মাঝে যে ঘটছে তার সংবাদ গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। কবি সাথী দাশ হিন্দু সম্প্রদায়ের ইচ্ছে সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন,

হিসেবের হালখাতা খোলা নয়, আত্মিক শুদ্ধতায় সবাই এখন

একটি কথাই শুনতে চায়

ভালোবাসি

ভালোবাসি ভালোবাসি মানুষকে সাম্প্রদায়িক নির্মোহে।

নব প্রজন্ম ‘স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ্থ দেখেনি বলে তাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক না বোঝাটা কিছুটা ক্ষমার্হ হতে পারে। কিন্তু এদেশের মানুষ অধিকাংশই যে স্বাধীনতার বা বিজয়ের সঠিক অর্থটাই জানে না তার জন্য কবি মনে দুঃখ পান। এই বেদনা কবির কলম থেকে উৎসারিত হয়,

বছরের পর বছর মানুষেরা মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের

সোনার স্বদেশকে খুঁজতে গেলে

স্বদেশের কথা প্রশ্ন করলে

সমস্ত দায়ভার ওরা একে অপরের কাঁধে সঁপে দিয়ে

দায় মুক্তি–মোচনের রেওয়াজি সংস্কৃতির পরিচর্যা করে।

আক্ষেপে কবি আরো বলেন:

লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে নির্মিত এ স্বদেশ ভূমে

গণতন্ত্রের খোলা বাতাসে স্বদেশি শাসকেরা হাঁটতেই শিখলো না।

(বিজয়ের অর্থটা কী মানুষ জানে না)

আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটিতে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় স্থান পেয়েছে। বিষয়গুলোর মধ্যে মানুষ–প্রকৃতি, এলিজি বা প্রয়াত ব্যক্তির স্মৃতি নিয়ে শোকগাথা নবোধ ইত্যাদি রয়েছে। এমন কি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নিয়েও কবিতা রয়েছে।

মানুষ সম্পর্কিত ‘অন্ধকার, মানুষ ও সময়’ শীর্ষক কবিতাটিতে কবির বক্তব্য অন্ধকার, মানুষ ও সময় একসূত্রে গাথা কবির প্র্রশ্ন, ‘অন্ধকার জেগে থাকে বলে মানুষ দেখে, নাকি/ মানুষ জেগে থাকে বলে অন্ধকার জেগে’? প্রশ্নটি পাঠককে ভাবায়। তবে কবি পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সময় ব্যয় করার কাজে বিব্রত করতে চান না। নিজেই তিনি উত্তর বলে দেন,

‘আসলে কিন্তু অন্ধকার, মানুষ, যে যার,

নিজস্ব কৌশলে আলোর প্রত্যাশায় প্রহর গুণে’।

মানুষ সম্পর্কিত অপর একটি কবিতা ‘মানুষ ও প্রকৃতি’। এই কবিতায় কবির মূল কথা হলো, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক চিরন্তন ও অবিচ্ছিন্ন।

কবির অনুভব:

‘মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক, প্রকৃতির সঙ্গে আবহাওয়া,

চাঁদ–সূর্য–নদী–সাগর–আকাশ ইত্যাকার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা

পৃথিবীটাকে এক সূঁতোয় গেঁথে রাখে। প্রকৃতির সঙ্গে

মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্ব–শত্রুতা, টানাপোড়েন, এমনকি

নিজের সাথে নিজেরও যে গোপন যুদ্ধ, ভারসাম্যহীন প্রকৃতির,

ক্ষুব্ধ–ক্রুরতার ইশারা। . . .’

প্রকৃতির বিপর্যয় মানুষকে ভোগায়, তবে মানুষের বিপর্যয়ে

প্রকৃতির শান্তিতে ধূসর ছায়া নামে। . . .

প্রকৃতি ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা সাথী ‘বৃষ্টি, ভূমি ও নারী’ কামধেয় কবিতাটিতেও। যেমন:

‘বৃষ্টি জলের কোমল ছোঁয়ায় খরাভূমি যেমন ফলবতী হয়

তরুণের স্পর্শ সিক্ত নিবিড়া লিঙ্গনে তরুণীও একদিন মা হয়ে ওঠে।

প্রকৃতি ও মানুষের এই অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্বেই

মহাকালের ধারায় পৃথিবীর পরিচয়, ভূমি ও নারীর সার্থকতা’।

বৃষ্টি সম্পর্কিত আরেকটি কবিতা ‘বৃষ্টি ও সম্রাটের স্বপ্ন’ শিরোনামের কবিতা। কবিতাটিকে প্রকৃতি পর্যায়ে ফেলা যাবে না। এটি মূলতঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর দীর্ঘকালের সমস্যা জলাবদ্ধতা। এর দায়ভাগ প্রধানত চট্টগ্রাম পৌর প্রতিষ্ঠান ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম পৌর প্রতিষ্ঠানের মেয়র চাক্তাই খাল খননের কথা বলেন, চাক্তাই খাল খনন কাজও কিছুটা হয়। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হয় না। তার শব্দচিত্র অঙ্কন করেন কবি এ ভাবে:

‘দেয়ালে দেয়াল ঠেকে চাক্তাই খালের পেট ফুলে গেছে আবর্জনায়।

জোয়ার–ভাটাহীন নিশ্চল নিথর চাক্তাই হ্রদে মশা তার

প্রজনন ক্ষমতায়নে শহরের আধিপত্য মুঠোয় আনে। এমন কি

সুবিশাল দালানের সর্বোচ্চ কক্ষেও চলে রক্তাক্ত সন্ত্রাস’।

নগর সম্রাট নগরবাসীকে স্বপ্ন দেখায়। বৃষ্টির জোয়ারে ভাসলেও নগর চাক্তাই খাল সচল হবে; নালার ওপর নগরায়ন লাভটা কার? খামোকাই প্যাচাল, অযথা বদনাম। যুক্তির পেছনে যুক্তি দাঁড়ালে তর্ক হয়। দেওয়ালে দেওয়াল ঠেকে যে দেওয়াল দাঁড়িয়ে, ওরা সবাই তো ভোটার।

কয়েক পশলা ভারি বৃষ্টিতে বহু রাস্তায় যাত্রীর সাথে গাড়িও ঝিমোয় চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতার যে বাস্তব শব্দচিত্র কবি এঁকেছেন, তাতে মৃদু ব্যঙ্গ থাকলেও তা গুঁড়ি পিঁপড়ের কামড় ডাঁস পিঁপড়ে বা বোলতার নয়। এজন্য কবিকে সাধুবাদ জানাই।

এবারে কবির রচিত এলিজি সম্পর্কে কিছু বলা যাক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)-এর পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর প্রধান শেখ ফজলুল হক মনির উদ্দেশ্যে রচিত ‘মনি ভাই, কুয়াশার আড়ালে ঢাকা’ শিরোনামের কবিতাটিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির স্মৃতির প্রতি নিবেদিত কবিতায় কবি সাথী দাশ প্রথমেই দেশ বন্দনা করে বলছেন:

এই দেশ ও মাটি

আমারই ভাবে, ভালোবাসায়

মায়ায় অসহায়তায় করুণায় গড়া।

প্রতিটি ধূলিকণায় জড়িয়ে আছে

আমার স্বপ্ন ও আশা,

যেভাবে অনুভূতি জড়িয়ে থাকে বোধ ও বোধিতে।

অন্তিম স্তবকে এসে বলছেন:

পনেরই আগস্টের ছায়ামূর্তিগুলো কুয়াশার মধ্যে

দাঁড়িয়ে আছে তোমার আশেপাশে

তুমি চিনেও চিনতে পারো না কিছুতেই,

চেনার জন্যে যাবে কোথায়?

মুখোশ পরে থাকা সামরিক–বেসামরিক আমলার কাছে? যারা সরকার বদলের সাথে সাথেই ভ্রূ নৃত্যে মুচকি হেসে শরীরের আড়মোড়া ভাঙে। শব্দের জাদু নেই, সোজা–সাপটা কথায় কবি দেশ–বন্দনা করেছেন। অন্তিম স্তবকে এসে কিন্তু তিনি এক আধো আলো–আধো অন্ধকারে এমন এক দ্যুতি সৃষ্টি করেছেন যাতে শেখ মনিকে হত্যা করার পেছনে শুধু পাক–বাহিনী নয়, এদেশের আমলারাও যে ছিল তা পাঠকদের জানিয়ে দিয়েছেন। এখানেই কবির নৈপুণ্য।

আর একটি এলিজি ‘কামরুলের জন্য শোকগাঁথা’। তিনটি স্তবকে গদ্যছন্দে লেখা এই কবিতাটি বিবৃতি বা বিবরণ দেবার ভঙ্গিতে কবি পংক্তিগুলো লিখে গেছেন। যেমন:

‘একটি মুক্তিযুদ্ধের ভেতর নিঃশব্দে নীরবে প্রীতি নৈকট্যের

রাখী বন্ধনে আমরা পরস্পর পরস্পরের সুখ–দুঃখ–

বেদনার নির্যাসটুকু সমবণ্টনে বণ্টন করেছি একদিন।

তারুণ্যের টগবগে রক্ত সময়ের সংকটে, অন্যায়ের প্রতিবাদে

রাজপথ প্রকম্পিত করতো। মিছিলে তখন সমুদ্র–গর্জনে

ভূখা মানুষের কথা বলতাম।

শেষ স্তবকে এসে কবি বলছেন,

মানুষের স্মৃতি বড় সংক্রামক ব্যাধি। কুরে কুরে খায় শুধু

মধুর ভালোবাসায় জড়ানো দিনগুলো রাতগুলো নিরন্তর।

এই স্তবকটি শোক গাঁথাটিকে দিয়েছে ভালোবাসার অভিজ্ঞান। ওয়ার্ডস্‌্‌ ওয়ার্থের মতে স্মৃতিজারিত কবিতাই উপভোগ্য ‘ঊসড়ঃরড়হ ৎবপড়ষষবপঃবফ রহঃৎধহয়ঁরষরঃু্থ কবিতাটি পড়লে সেই স্মৃতির সংহত প্রতিমা খুঁজে পাওয়া যায়।

সাথী দাশের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের আরেকটি সুন্দর কবিতা ‘যন্ত্রকলে সবাই নাচে’ মাত্র চৌদ্দ পংক্তিতে সাজানো এই কবিতায় কবি আমাদের আজকের সমাজের গড্ডল প্রবাহের চিত্র তুলে ধরেছেন। কবি দুঃখ পান, বর্তমান পৃথিবী, মানুষ, মনুষ্যত্ব, জ্ঞান, প্রেম, ধর্ম সবই অর্থের বা তোষামোদে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেখে। এই বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্য–প্রবণতা সবকিছু ভেঙে চুরে দিচ্ছে। কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে চার পংক্তিতে এই ভাঙচুরের কথা।

প্ররোচিত প্রলোভনে সংস্কারে যদি সবকিছু হয়, হয়ে যায়,

আমার–তোমার ভাবার তেমন কি–ই–বা আর থাকে।

ভাবার সময় বলার সময় তখনই আসে যখন দেখি

যন্ত্রকলে আজম নাচে, সাথে নাচে নুরু, আরো নাচে ম্যাগসেসে সাঁই।

তৃতীয় স্তবকে এসে শেষ দুই চরণে অব্যর্থ শব্দ। নিক্ষেপে কবি তাঁর ভাবনা, বক্তব্য তুলে ধরেছেন, যাতে গড্ডালিকা প্রবাহ ব্যঞ্জিত হয়েছে ইঙ্গিত ময়তায়–

সবই ঠিকঠাক, ফিটফাট, একদা গাণ্ডীব হাতছাড়া হলে–

পতনের দরজা খুলে যাবে ঠিক অনিয়মের ঘেরা কলে।

গ্রন্থটির শেষ কবিতাতেও প্রথম কবিতারই মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে বলেছেন,

‘জাতীয় স্বাধীনতার নন্দিত ঘোষক কবরের শীতল ছায়ায়

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ভাবে, আমি তো সবাইকে আমার মতো

প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিশ্বাসী না হওয়ার কথা বলতাম’।

SUMMARY

932-1.jpg