শাহিদা আক্তার জাহান
‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো, মুক্তিদাতা পিতা মুজিবের জন্য কাঁদো, কাঁদো বঙ্গমাতার জন্য কাঁদো, কাঁদো সবার ছোট্ট আদরের রাসেলের জন্য কাঁদো। বাংলার সোঁদা মাটি, নদী পাহাড় বেষ্টিত এই সবুজ শ্যামল বাংলা। ইস্পাত কঠিন পাথরের মত একটি জাতির সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, বলেছিলেন বাঙালিদেরকে ‘চল তোমরা আমার সাথে, আমি তোমাদের নিয়ে যাব অনেক দূরে, একটি লাল সবুজের পতাকা নিচে। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দেব। তোমরা আমাকে সাহসী বাঙালি দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেবো। তাই ৭১ এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখন লক্ষ লক্ষ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সাড়া দিয়ে জীবনবাজি রেখে বাঙালিদেরকে সংঘবদ্ধ করে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দুই লক্ষ ঊনসত্তর হাজার মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে একটি মানচিত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন বঙ্গবন্ধুর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায়। বাংলার প্রতিটি মানুষকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত করেছেন। জাতীয় নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে সেদিন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল এ দেশের জনগণ। পিতা মুজিবের বিশ্বাস ছিল বাঙালিদের ওপর। তাই পাকিস্তানে বন্দি হয়েও দিশেহারা হয় নি। বাঙালিরা কোনদিন তাকে মারতেই পারে না– এ বিশ্বাস থেকে নিরাপত্তাহীনভাবে থাকতেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলের নেতা কর্মী ও সহকর্মীদের প্রতি ছিল তার গভীর ভালবাসা। তাদের দুঃখ, কষ্ট, ভাল মন্দ এবং আনন্দ বেদনার অংশীদার ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের সত্তা, জাতির চেতনা, বাঙালির শক্তি, সাহস, মুক্তির প্রেরণা, দুঃখী মেহনতি মানুষের ঠিকানা। বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, এই মহান মানুষটিকে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছে চির ঋণী করা হয়েছে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড কারো কাছে কাম্য ছিল না। বছরের আবর্তনে এসেছে বাঙালি জাতির শোকাবহ আগস্ট মাস। বাঙালির বর্ষ পঞ্জিকায় প্রতি বছর ফিরে আসবে ‘শোকাহত আগস্ট’। শোকাবহ স্মৃতি অশ্রুসজল বেদনার্ত, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাঙালি জাতি স্মরণ করে, বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক, বাঙালির প্রথম স্বাধীন জাতি, রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্থপতি, কালজয়ী মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি স্বাধীন বাংলার রূপকার, দুঃখী মেহনতি মানুষের নতুন স্বপ্নের নির্মাতা। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত রাজনীতি করেছেন। মানুষের প্রতি ছিল তার গভীর ভালবাসা, মমত্ববোধ। বাংলার দুঃখী মানুষের কষ্টে তিনি ব্যথিত হতেন। স্বপ্ন দেখতেন অগণিত ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করবেন। নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিতের কথা চিন্তা করে জীবনের– যৌবনের মূল্যবান সময় জেলে কাটিয়েছেন। অনেক কষ্ট, নির্যাতন সহ্য করেছেন। বাঙালির মুক্তির জন্য, শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পথ দেখিয়েছেন।
বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশ পাবে, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা পাবে। অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র পাবে, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবাই একসাথে সমাজে বসাবাস করবে এই অঙ্গীকার ও প্রত্যাশা পূরণ হতে শুরু করছিল। স্বল্প সময়ে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সংবিধান রচনা করেছেন, শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, যার মূল লক্ষ্য শান্তি, মুক্তি, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীর ক্ষমতায়ন। তাই তাকে বাদ দিয়ে কখনো বাংলার প্রকৃত ইতিহাস রচিত হতে পারে না। যখন একটু শান্তি ও স্বস্তি ফিরে এসেছে, ঠিক তখনই ১৯৭৫–এর ১৫ আগস্ট কাল রাতে বাঙালি জাতি হারিয়েছে আবহমান বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একইসাথে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো আত্মীয়–স্বজনসহ তার পরিবারের সবাইকে। সবার আদরের যে ছোট্ট রাসেল সারাক্ষণ আনন্দে মাতিয়ে রাখতো বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি সেও রক্ষা পেল না। বাঁচতে চেয়েছিল রাসেল এই সুন্দর পৃথিবীতে, কখনো মার কাছে যাবে বলে, কখনো বাবার কাছে যাবে বলে, কখনো ভাই–ভাবীদের কাছে যাবে বলে। বাঁচার জন্য কাজের মেয়ের বুকেও লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিসের লোভে ঘাতকেরা এতো নিষ্ঠুর নির্দয় হয়েছিল, পাষণ্ডরা কচি বুকটা বুলেটে বুলেটে ঝাঝরা করে দিল? এই ছোট্ট রাসেলের কি দোষ ছিল? একটাই দোষ ছিল সে বঙ্গবন্ধুর সন্তান। এক অকল্পনীয় পৈশাচিক ঘটনা। দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে যান। ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ২০ দিনপর বিদেশে অবস্থানকারী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর কাছ থেকে প্রথম জানতে পারেন তাঁদের পরিবারের মা বাবা সহ অন্যান্য সদস্যরা কেউ বেঁচে নেই। অনেক কষ্টে নির্যাতনের শিকার হয়ে জার্মান থেকে দিল্লি এলেন ২৪ আগস্ট, আর ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে ৪ সেপ্টেম্বর দেখা হলে সব খবর জানতে পারেন। বাংলার মানুষের জন্য যে নেতার বুক ভরা ছিল ভালবাসা, বাংলার মানুষ, বাংলার আকাশ বাতাস, বাংলার মাটিকে গভীরভাবে ভালোবেসে সিক্ত করেছিলেন, যিনি সব সময় বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য আজীবন কষ্ট করেছেন, যৌবনের সুন্দর দিনগুলো আন্দোলন সংগ্রাম করে কাটিয়েছেন; এমনকি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও বাঙালির স্বাধিকারে দাবিতে আপোষ করেননি। পাকিস্তানিরা শত্রু হয়েও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে নাই, কিন্তু বাংলার মীর জাফররা জাতির জনককে হত্যা করলো। যে পাকিস্তানিরা বারবার চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসি দিতে চেয়েছিলো। ৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়, তার ফাঁসির হুকুম হলো, কবর খোঁড়া হলো, এ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, একবার মরি। তোদের কাছে অনুরোধ তোরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছে দিবি।’ আর সেই বাংলার মীর জাফররাই বাংলার মাটির বুক ভিজিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের রক্তে; ঘাতক বেঈমানের চক্রান্তে।
৭৫এর ১৫ আগস্টের মতো মর্মান্তিক হত্যা কোন জাতির জীবনে বেশি ঘটে না। পরিবারের ১৭ সদস্যসহ নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্র প্রধানকে এরূপ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। এই হত্যাকাণ্ড বিশ্বাসঘাতকতার ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার চরম দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে বিপ্লবের ‘প্রতিবিপ্লব’। এই প্রতিবিপ্লব যে কোন সময় হতে পারে এখনো বাংলাদেশ প্রতিবিপ্লবের শক্তি বিদ্যমান। যারা এই প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে বাংলার ইতিহাসকে ভিন্ন ভাবে বিকৃত চেষ্টা করেছিল তারা জানে না ইতিহাস তার নিজস্ব অমোঘ গতিতে সত্যের বাহন হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে বাংলার মীর জাফররা একটি জাতির স্থপতিকে স্বপরিবারে হত্যা করা করলো। এই হত্যাকাণ্ড একটি পরিবারকে হত্যা করেনি ঘাতকরা, অবৈধ দখলদাররা, সামরিক শাসকরা, হত্যা করছে স্বাধীন জাতির আত্মাকে, সামপ্রদায়িকতার ছুরিতে বিদ্ধ হয় পুরো জাতির আত্মা। রক্তক্ষরণ শুরু হয় প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের। হত্যা করেছে জাতির আদর্শকে, এ মৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে খর্ব করেনি। খর্ব করেছে তার স্বাধীন জাতিকে, তার দেশকে। অভিশপ্ত করেছে তার হন্তারক গোষ্ঠীকে। এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে উন্নতি অগ্রগতি হয়নি, জনগণ উন্নয়ন দেখেছ শুধুমাত্র মিডিয়ায়। দুর্নীতি লুটপাট সমস্ত উন্নয়নকে বাধা প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ভুলে গিয়েছে। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাদেরকে বারবার অপমান করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অবস্থা হলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের এমপি, মন্ত্রী বানানো হয়েছে। আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদদের দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা নিয়ে তারা ঘুরেছে দেশ বিদেশে। ক্ষমতাসীনারা ভুলে গিয়েছে জাতির জনকের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। নির্বাসিত হয়েছে সুস্থধারার রাজনীতি, অর্থনীতি। তাই আমাদের মাঝে সত্যিকারের গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, শোষণমুক্ত সমাজ, আইনের শাসন, সর্বোপরি জনগণ অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি। যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে বড় করে দেখেনি। ফলে দেশ ও জাতি অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসতে পারেনি। ঘুষ দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন ছিল গোটা সমাজ ব্যবস্থা। গণতন্ত্রের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতা ছিল বেশি। রাজনীতিতে জন্ম নিয়েছে ক্ষমতা, লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসা, সন্ত্রাস বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন। বঙ্গবন্ধুর নাম বাংলার মাটি থেকে চিরতরে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করতে লাগলো তারা। আগস্টের কলঙ্কজনক ঘটনা ছাড়াও বাংলাদেশের বুকে আরো ৪টি কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে।
১. মহান মুক্তিযোদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের ঘটনা। ২. ১৯৭৫ থেকে অবৈধ ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসনের ঘটনা। ৩. সামরিক শাসকদের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল চারনীতি ছেঁটে ফেলে সামপ্রদায়িকতা আমদানি করে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা উড়ানো। ৪. ২১ বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা বাংলাদেশেরর উন্নয়নের রূপকার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলার মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটানো হলো। একটার চেয়ে একটা ভয়ংকর ঘটনা। কিন্তু মহান আল্লাহ নেত্রীকে রহমতের হাত দিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে হত্যার দায় তারা কখনো অস্বীকার করেনি বরং গর্বের সাথে সদর্পে বলেছে আমি খুনি পারলে আমার বিচার করুন। আইন পাশ করে তাদের বিচারের পথ বন্ধ করা হয়েছিল। এই ইনডেমনিটি অ্যাক্ট ছিল তাদের বেঁচে থাকার রক্ষাকবচ। ঘাতকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তারা চিরদিন বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে। হত্যাকারীদের শুধু আইনের নিরাপত্তা দিয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি। হত্যার পরবর্তী সরকার তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছে, দেশে বিদেশে দূতাবাসেও চাকরি দিয়েছে। এ হত্যাকে তারা অপরাধ বিবেচনা করেনি। এই হত্যার কোন বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়, সে সরকার অব্যাহতির অধ্যাদেশ রহিত করে বিচারের কাজ শুরু করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করে। তখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সাথে বলেন, নিয়মতান্ত্রিক আদালতে স্বচ্ছ ও প্রকাশ্য বিচারের মাধ্যমে খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। স্বাধীন, মুক্ত, স্বচ্ছ ও প্রকাশ্য বিচার শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার জেলা ও সেশন জজ গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত ২০ জনের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। আবার দুর্ভাগ্য বাঙালির। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজন জেলা ও সেশনস আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। এ রায়ের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে চারজন আপিল করেন, কিন্তু আপিল বিভাগের অধিকাংশ বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে এ মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেছিলেন, ফলে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারপতির অভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি করা সম্ভব হয়নি। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদে বিচারের শেষ পরিণতি হয়নি। পরবর্তীতে সূক্ষ্ম কারচুপির কারণে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি, ক্ষমতায় এসেছে জোট সরকার, সে সরকারের সাথে ছিল কুখ্যাত জামায়াত। তাই বিচারের কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। জাতির জনকের নিজ হাতে গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কঠিন লড়াই, রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে ঘাতকদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আবার ক্ষমতায় এসে তারই সুযোগ্য কন্যা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিচার শুরু করেন। ইতিহাসে এমন কালো অধ্যায়ের তুলনা মেলা ভার। এমন কি এই মহান নেতাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে চরম অবহেলায়, অবজ্ঞায়। যেনতেনভাবে দ্রুত মাটিচাপা দিয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়াই ছিল খুনিদের মূল লক্ষ্য। এলাকার বাধার মুখে ৫৭০ কিনে আনা হয়। রেডক্রসের গুদাম থেকে চারটি শাড়ি আনা হয়। পাড় ফেলে দিয়ে দুইটি কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। একজন মুসলমান হয়ে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই সমাধিস্থ করার নির্দেশ দেওয়া হয় এই মহান নেতাকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করে ফাঁসির রায় কার্যকর করে বাঙালি জাতি অভিশাপমুক্ত হয়েছে। কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। ১৫ আগস্টের বিচার যদি তখন হতো তাহলে এদেশের এতো বীর সন্তানদের প্রাণ দিতে হতো না। একটি হত্যাকাণ্ড আরেকটি হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয়। তৎকালীন সরকারগুলো বিচার না করায় হত্যাকারীরা অতি উৎসাহিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে বার বার হত্যা করার প্রচেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদেরকে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এতো কিছুর পরও দেশের আপামর জনসাধারণের ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর সাহসী কর্মদক্ষতায় আজ নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু সহ দেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছেন। যা ধীরে ধীরে আজ বাঙালিদের কাছে দৃশ্যমাণ। অনেক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে, অনেকগুলো শেষ হওয়ার পথে। হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ঢাকা– চট্টগ্রাম ও ঢাকা – ময়মনসিংহ হাইওয়ের কাজ শেষ হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ঘরে ফেরা কর্মসূচি, একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রায়ন প্রকল্প ও আরো অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বছরের প্রথম দিন ৩৫ কোটি ৪২ লক্ষের অধিক বিনামূল্যের বই বিতরণ করা হচ্ছে। ১ কোটি ৪০ লক্ষের অধিক উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ফোনের মধ্যেমে পাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। যারা গরীব তাদেরকে সরকার বিনামূল্য মোবাইল ক্রয় করে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বিদেশে ৯ টি নতুন দূতাবাস খোলায় সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী প্রণীত ‘শান্তির মডেল’ জাতিসংঘে গৃহীত হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরাবী এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রবিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি সহ আরো অনেক স্কুল, কলেজ মাদ্রাসার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে ‘ফোর্সেস’ গোল ২০৩০ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার সহজলভ্য করা হয়েছে। ২০০৫০০০ শিক্ষা প্রতিষ্টানে স্বল্পমূল্যে দোয়েল ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়েছে। প্রায় ১৩ হাজারের অধিক ডিজিটাল কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন, আর তার সাহসী কন্যা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এদেশ আমাদের পূর্ব প্রজন্মদের রক্ত দিয়ে কেনা, ইজ্জত দিয়ে কেনা, বঙ্গবন্দুর সপরিবারে জীবন দিয়ে কেনা। এই বাংলা তাই ইতিহাসের সৃষ্টিরূপে এবং স্রষ্টারূপে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ। আজ আমরা যে দিকে তাকাই সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে পাই, আর এক মমতাময়ী মার ছবি দেখতে পাই। দেশ এখনো সামপ্রদায়িকতার ছুরিকাবিদ্ধ, এখনো জাতির আত্মার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন; থাকবেন বাংলার গণমানুষের মাঝে। সে ভালোবাসা অবিনশ্বর। বঙ্গবন্ধু অক্ষয়, বাঙালি জাতির কাছে চির জাগরুক, চিরভাস্বর। মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা যায়নি, তিনি সগৌরবে উঠে এসেছেন কবর থেকে তার প্রিয় বাংলাদেশে, মুক্তির মিছিলে, ফসলের আভায়, সবুজ বাংলার নদীর স্রোতে, কৃষকের হাসিতে, মাঝির ভাটিয়ারি, ভাওয়াইয়া, গাড়িয়ালের গানের সুরে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। বাংলার বিশাল মানচিত্র জুড়ে আছে বঙ্গবন্ধুর শরীর। বাংলাদেশ যত সুশিক্ষার শিক্ষিত হবে ততই বঙ্গবন্ধু নতুন প্রজন্মের কাছে চেতনার আদর্শ হয়ে দাঁড়াবেন। তিনি বাংলাদেশের ফাউন্ডিং নেতা। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের হাতিয়ার। তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে অমর, অবিনশ্বর চেতনা। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি আজ উদ্ভাসিত স্বমহিমায়। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার দূরবদ্ধদৃষ্টি সম্পন্ন অভিজ্ঞায় দারিদ্র্য–বৈষম্যের অবসান করে সুখী সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে সোনার বাংলাদেশ।