১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ এর ........তম শাহাদাত বার্ষিকী।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি নিজ বাসভবনে স–পরিবারে হত্যার পর চট্টগ্রামে গেরিলা বাহিনীর প্রধান (মুক্তিযুদ্ধকালীন) সময়ের সাহসী সন্তান শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ দারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি সে দিন চট্টগ্রাম শহরের উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে শেখ মুজিব রোডস্থ ভাণ্ডার মার্কেট সংলগ্ন সৈয়দ মাহমুদুল হকের বাড়িতে গোপন আস্তানা করেন। আন্দোলন সংগ্রামের জন্য তিনি প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে বেশকটি সফল অপারেশন করতে সমর্থ হন। জাতির পিতা হত্যার পর ১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে তৎকালীন ভারতের সরকার প্রধান মুরারজী দেশাই ও জিয়াউর রহমানের যোগ সাজসে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মৌলভী সৈয়দ তাঁর সাথে থাকা ক’জন সহযোগীকে ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করান। সে সময় মৌলভী সৈয়দকে ঢাকা ক্যান্টেনম্যান্টে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েও মৌলভী ছৈয়দ নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে খুনীরা তার গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীর শেখেরখীল ইউনিয়নের লাল জীবন গ্রাম থেকে তার বৃদ্ধ পিতাকে ধরে এনে সুকৌশলে তাকে সনাক্ত করেন। এরপর ১১ আগস্ট প্রত্যুষে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মৌলভী সৈয়দ আহমদকে। বিচারের নামে সেই দিন প্রহসন হয়েছিল এই বীরের সাথে।
মুক্তিযুদ্ধের এই গেরিলা সংগঠক ১৯৩৮ সালের ৪ মার্চ বাঁশখালী উপজেলা শেখেরখীল ইউনিয়নের লাল জীবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম একরাম সিকদার ও মাতা উম্মে উমেদা খাতুন। পরিবারের পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পুইছড়ি ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে দাখিল পাস করেন। পরবর্তীতে ইজ্জতিয়া জুনিয়র হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে তিনি চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে আবারো সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি পাস করেন। এরপর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিটি কলেজে ভর্তি হন (বর্তমান সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) সেখান থেকে শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবন। ১৯৬৭–৬৮ সালে প্রথমে ছাত্র সংসদের জি.এস ও পরবর্তীতে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে রাজনৈতিক সংগ্রাম আন্দোলনে প্রথম কারাবন্দি হন। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি পাস করেন। ’৬৯ এর গণ–আন্দোলনে তিনি চট্টগ্রামের ছাত্র ও যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ’৭১ এ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ। এ সময় “জয় বাংলা বাহিনী” গঠন করেন তিনি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন এ সংগঠনের প্রধান। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানিরা নির্বিচারে মানুষ হত্যায় মগ্ন এই বিপ্লবী তখন চট্টগ্রামের হাজার হাজার ছাত্র ও যুব সমাজকে সাথে নিয়ে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার–অনাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দীপ্ত প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ সরদার, মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান, সাখাওয়াত জামান মজনু, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এই কিংবদন্তি নেতার সংগ্রামী জীবন কাহিনী নিয়ে বার বার এ কথাগুলো লিখেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার ইঙ্গিত পেয়েই এ সাহসী সৈনিক চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে গড়ে তুললেন গেরিলা বাহিনী। মৌলভী সৈয়দ শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থানীয়ভাবে বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেন। ভারতীয় ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলা গ্রুপের মিত্র বাহিনীরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জীত হয়ে শত্রুদের অবরুদ্ধ করে রাখা শহরে প্রবেশ করেন। রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের অবস্থান জেনে সেখানে তিনি আক্রমণ করতেন। এটাই ছিল তার নেতৃত্বের বিচক্ষণতা। দখলদার পাকিস্তানিদের হাত থেকে নিজ মাতৃভূমি এ চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে থেকেই দেশ প্রেম, কর্মনিষ্ঠা, সাহসিকতার সাথে সাংগঠনিক তৎপরতা ও প্রবল মনোবলের কারণে মুক্তিযুদ্ধে এক বিশাল অবস্থান করে তোলেন। সে সময় তার প্রতিষ্ঠিত গেরিলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানে ছিল উত্তর আগ্রাবাদ, পাঠানটুলী, মনছুরাবাদ, রামপুরা, গোসাইলডাঙ্গা ও হালিশহরসহ গ্রামীণ জনপদে। তিনি স্থাপন করে ছিলেন শত শত মুক্তিযুদ্ধের আশ্রয়স্থল। এ রকম একজন বীরের জন্ম বাঁশখালীতে হওয়ায় আমরা এলাকাবাসী গর্বিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৬ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে বসে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দেন। ভারতে অবস্থান কালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেই দেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধা ভোগিরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। সফলভাবে ভারতের আশ্রয় গ্রহণ প্রসঙ্গে মৌলভী সৈয়দ ও তার সহযোগীদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হন ষড়যন্ত্র কারীরা। সেদিন প্রতিরোধ সংগ্রামে চট্টগ্রামের যুবনেতা সৈয়দ মাহমুদুল হক, সৈয়দ আবদুল গণি, মোহাম্মদ জাকারিয়া, এ্যাডভোকেট সালাহ উদ্দীন, দিপেশ চৌধুরী, মুহাম্মদ ইউনুছ বাঁশখালীর সুভাষ আচার্য ও শফিকুল ইসলাম সহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং “চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা” শিরোনামে একটি মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন শহীদ মৌলভী সৈয়দ ও চট্টলবীর আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। এ মামলার বেশিরভাগ আসামি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এমনকি দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের “রাষ্ট্রদ্রোহী” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এই মামলায়। এটা ছিল জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জাজনক ঘটনা। এভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রাম শহর গেরিলা বাহিনীর প্রধান মৌলভী সৈয়দ বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। নিজের রক্ত দিয়ে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি। যা নতুন প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।