এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ


স্থিতধী বড়ুয়া
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২নং সড়কের বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাবিদুর কলঙ্কময় এই দিনটি স্মরণে প্রতিবছর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং আগস্ট শোকের মাস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বাসঘাতকতা, বেঈমানী এবং কৃতঘ্নতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির রক্তের সাথে মিশে আছে। এখন থেকে অনুমান আড়াইশ বছরেরও কিছু আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে মীরজাফর এবং তাহার সহযোগী রায়বল্লভ, রায়দূর্লভ, ইয়ার লতিফসহ আরো অনেকের বিশ্বাসঘাতকতা এবং বেইমানীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম পথিকৃৎ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। সিরাজের পতনের পর ইংরেজরা ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষ ছলে–বলে–কৌশলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা প্রদান করেন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যূদয়ের পরও ইংরেজরা নষ্টালজিয়া সাম্প্রদায়িক হানাহানির যে বীজ বপন করে যান এর মাশুল ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশের জনগণকে এখনো দিতে হচ্ছে। ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার রেডক্লিফ ৪৭ এ তাড়াহুড়ো করে দেশ ভাগের সময় হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাঞ্জাব ও বাংলাকে দ্বি–খন্ডিত করে কয়েক শতাব্দী যাবৎ একত্রে শান্তিতে বসবাসকারী হিন্দু–মুসলমান এবং শিখ সম্প্রদায়ের মাঝে যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সৃষ্টি করেছিলো এর প্রভাবে ভারত–পাকিস্তানের প্রায় দেড় কোটি মানুষ দেশান্তরিত হয় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌ ১৯৪৮ এর মার্চে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানের জনসভায় বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলার পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সুধী সমাবেশে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা আবারো ঘোষণা প্রদান করেন। এর বিরোধিতাকারীদের তিনি জাতীয় শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করার হুঁশিয়ারী দেন। তাহার এই ঘোষণার সাথে সাথে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ জিন্নাহ্‌ এর মুখের ওপর প্রতিবাদ জানান। কার্যত সেইদিন হতে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীসহ প্রকারান্তে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৯ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার কে.এম. দাশ লেনে রোজ গার্ডেনে অবিভক্ত বাংলার মুখ্য মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর প্রগতিশীল অনুসারীরা মুসলিম লীগ হতে বাহির হয়ে এসে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে। নবগঠিত এই দলের সভাপতি হন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ রাখা হয়। এদেশের ভাষা–শিক্ষা এবং সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সামান্যতম মিল না থাকা সত্ত্বেও তখন হতে সকল স্কুল–কলেজ এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ‘পাক সাদ জমিন সাদ বাদ’ উর্দু জাতীয় সংগীত চালুর নির্দেশ প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে সালাম–বরকত–রফিক–জব্বারসহ অনেকেই প্রাণ হারান। এতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। অবশেষে পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ছাত্র জনতার দাবীর কাছে নত স্বীকার করে ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি উর্দুর সাথে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর বাঙালি কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘পূরব্‌ বাংলার শ্যামলীমায় পঞ্চ নদীর তীরে অরুণীময়, ধূসর সিন্ধু মরু সাহারায় ঝান্ডাই জাগে যে আজাদ’ বাংলা জাতীয় সংগীত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র চালু করা হয়।

বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এবং বাঙালির ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জন্মের পর হতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ২৩ বছর স্থায়ী পাকিস্তানে এই মহান নেতাকে জীবনের ১২ বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছে। হুমকি–ধামকি এবং মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এই সংগ্রামী মহান নেতা পাকিস্তানীদের কাছে মাথানত করেননি।

পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ, শোষণ, বঞ্চনা এবং নিপীড়নের সাথে মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের চামচা চোস্ত পায়জামা কালো আসকান, কালো টুপি পরা ময়মনসিংহ এর ‘বটতলার উকিল’ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান আইয়ুবের আমলে রেডিওতে ভাষণের অর্ধেক আইয়ুবের প্রশংসা এবং বাকী অর্ধেক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালিদের সাচ্চা মুসলমান বানানোর নছীয়ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরো তরান্বিত করে। এই সাচ্চা পাকিস্তানী দালাল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেই নিহত হন। ইদানীং বনানীতে তার পরিবারের কাছে থাকা অবৈধ স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (উত্তর) এর প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক উদ্ধার করে জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন এবং জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন।

১৯৭১ এর ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে মহান মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধকল্পে ১৯০৬ সালে আন্দোলনের সময় আরেক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রসৈনিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ কবিতার প্রথম দশ লাইন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে যাওয়ার সময় প্রেরণার উৎস ছিল। ৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার শেষ শব্দটি ছিলো ‘জয় বাংলা’। ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের শেষ শব্দটিও ছিল ‘জয় বাংলা’। অথচ এই সামরিক শাসক ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি থাকাকালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো সভা সমাবেশে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এমন নজির নেই।

৭২ এর ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন এবং ১২ জানুয়ারি তিনি সরকার গঠন করেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য তিনি সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী একটি চক্র মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এদেশের পরাজিত শক্তি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিশোধপরায়ণ ক্ষমতালোভী একটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। ১৯৭৩ সালে ৩১ অক্টোবর আওয়ামী লীগের বিরোধী একটি অংশ সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) গঠন করেন। প্রায় একই সময়ে গণবাহিনী ও চরমপন্থী কিছু সংগঠনেরও উত্থান ঘটে। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী কিছু দুবর্ৃৃত্তও তাদের সাথে হাত মেলায়। থানা লুট, ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, বিভিন্ন স্থানে পুলিশের উপর চোরাগোপ্তা হামলা ডাকাতি, রাহাজানী, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে এরা দেশব্যাপী এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা অপর এক একশ্রেণীর অর্থলোভী দুর্বৃত্তও চোরাচালান, দখল বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভিতর দক্ষিণপন্থী অংশের দলনেতা বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক অতীতের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসে তার অনুসারীরাসহ বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে নেমে পড়ে। এই খলনায়কের সাথে হাত মেলায় সেনাবাহিনীর কিছু কর্মরত এবং অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা, পাকিস্তান ফেরৎ সুবিধাবঞ্চিত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মরত বেসামরিক প্রশাসনের অনেকে এই ষড়যন্ত্রের বাহিরে ছিল না। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট ভোর রাতে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মোশতাকের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় সামরিক বাহিনীর বিপথগামী এসব কর্মকর্তা সর্বমোট কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে, একটি গ্রুপ মেজর বজলুল হুদার নেতৃত্বে ধানমন্ডি ৩২নং সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আক্রমণ করে। তারা বিনা বাধায় বাসভবনে প্রবেশ করে প্রথমে শেখ কামালকে নীচতলায় গুলি করে হত্যা করে, পরে তারা বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাড়ীর ভিতরে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেনাবাহিনীর অপর গ্রুপ শেখ ফজলুল মনি এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাত এর বাসায় আক্রমণ করে সবাইকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা দেশের বাহিরে থাকায় তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের পরে পাকিস্তানী আদলে শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন। ৭২ এর ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ বেতার’ রাতারাতি ‘রেডিও বাংলাদেশ’ এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদে রূপান্তরিত হয়। স্কুল–কলেজ এবং সরকারি–বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান হতে জাতির জনকের ছবি নামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পরিবর্তে বিদেশে দূতাবাসে লোভনীয় চাকরিতে বহাল করেন। মোশতাক ছাড়াও পরবর্তী দুই সামরিক শাসক, এমনকি ৯১তে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর পর বিএনপি সরকারও খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত মোশতাক এবং দুই সামরিক সরকারের শাসনামলে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া সম্ভবপর হয়নি। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা পার্টি’ বিদ্রুপ করা হতো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ীও করা হতো এমনও নজির আছে। এই দুই সামরিক সরকার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অনেককে মন্ত্রীত্বের আসনে বসাতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এই সময় দালাল আইন বাতিলসহ সব দালালদের জেলখানা হতে বিনা বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়। এমনকি ৯১ থেকে ৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকারের দাবীদার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদদের মতো যুদ্ধাপরাধীদেরও মন্ত্রীত্বের গদিতে বসাতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ৯৬ তে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতির পিতার ছবি আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হয়। জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ এবং ‘বাংলাদেশ বেতারও’ আবার প্রতিস্থাপিত হয়েছে। জাতির জনকের জন্মদিন এবং মৃত্যু দিবস যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সরকার জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করে দোষীদের ফাঁসির মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামীরা বিদেশে পলাতক থাকায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

পরাধীন ভারতের বাংলা মুল্লুকে শরৎচন্দ্র বোস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, দেশবন্ধু সি আর দাশ, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে–বাংলা এ.কে ফজলুল হক এর মতো আরো অনেক খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা জন্মগ্রহণ করেন। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের বলয় হতে বের হয়ে এসে অবিভক্ত ভারতে ‘যুক্ত বাংলা’ আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বোসের সাথে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌ এবং মহাত্মা গান্ধীর এই প্রস্তাবে সম্মতি থাকা সত্ত্বেও খাজা নাজিম উদ্দিন, নুরুল আমিন প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা এবং নেহেরুসহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের বিরোধীতার কারণে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী এবং ভাবশিষ্য বঙ্গবন্ধুই একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করুক এটা পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে কল্পনা এবং বাস্তবায়নের চিন্তা করে আসছিলেন। ১৯৬৯ এর ৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ আয়োজিত শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দ্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আলোচনা সভায় তিনি পূর্ব বাংলার নামকরণ ‘বাংলাদেশ’ করেন (দৈনিক আজাদী তাং– ০৮/০৮/১৮ইং)। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, পর্বত প্রমাণ জনপ্রিয়তা, ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং সর্বোপরি সাংগঠনিক দক্ষতার দ্বারা শোষিত, বঞ্চিত একটি জাতিকে এক ছাতার নীচে আনতে সক্ষম হন, যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জন্ম। তাই সবার মুখে আজ ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। যারা আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর নাম–ঠিকানা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল তারা আজ সবাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের গতিধারা এমনই নির্মম।

লেখক : কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম।

SUMMARY

927-1.jpg