বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা দুটো সমার্থক শব্দ

কাজী রুনু বিলকিস্‌

(Original Caption) Sheikh Returns. Dacca, Bangladesh: Sheikh Mujibur Rahman waves handkerchief in the air as he came home, January 10, to Bangladesh, the nation he had fathered, and was engulfed in an emotional and exuberant demonstration of affection by a sea of people that stretched as far as the eye could see. The Sheikh had been jailed in West Pakistan for over nine months and sentenced to death for advocating freedom from East Pakistan.

তিনি গার্ড অব অনার গ্রহণের পর পতাকাবিহীন গাড়িতে চড়ে শহরে ঢুকতে অসম্মতি জানান। বলেন, পতাকা আসা পর্যন্ত আমি বিমানবন্দরেই অপেক্ষা করব। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাড়াতাড়ি গাড়িটি বাংলাদেশের পতাকায় সজ্জিত করেন। লাহোরের পাকিস্তান টাইমস পত্রিকায় এই ঘটনাটির কথা প্রকাশিত হয়। তখন এক পাকিস্তানি সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন, “শেখ মুজিবের মত দৃঢ়চেতা ও সাহসী একজন নেতা পেলে পাকিস্তান বহু বিপর্যয় থেকে বেঁচে যেতো।”

একবার এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, What is your qualification উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন I Love my people আবারও জিজ্ঞেস করেছিলেন What is your disqualification বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন love them too much . এ হচ্ছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তাঁর মত সাহসী দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী নেতা এই বাংলায় আর জন্ম নেবেন কিনা জানি না। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। যতদিন বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি আর বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতেই হবে। যত চেষ্টাই হোক বঙ্গবন্ধুকে কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদা করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রাম বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর অসীম সাহস ও ব্যক্তিত্ব সারা পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ১৯৭২ সালে নিজ অফিস ছেড়ে ১০ নং ডাইনিং স্ট্রিটের সড়কে নামেন নিজ হাতে গাড়ির দরজা খুলে স্বাগতম জানান বঙ্গবন্ধুকে। এডওয়ার্ড হীথের এই সৌজন্য বিশ্ববাসীর মনে রাখার কথা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুুজিবুর রহমান যখন লাহোরে যান তখন ১৯৭৪ সাল। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি দেখেন তাঁর জন্য অপেক্ষারত গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা নেই। তিনি গার্ড অব অনার গ্রহণের পর পতাকাবিহীন গাড়িতে চড়ে শহরে ঢুকতে অসম্মতি জানান। বলেন, পতাকা আসা পর্যন্ত আমি বিমানবন্দরেই অপেক্ষা করব। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাড়াতাড়ি গাড়িটি বাংলাদেশের পতাকায় সজ্জিত করেন। লাহোরের পাকিস্তান টাইমস পত্রিকায় এই ঘটনাটির কথা প্রকাশিত হয়। তখন এক পাকিস্তানি সাংবাদিক মন্তব্য করেছিলেন “শেখ মুজিবের মত দৃঢ়চেতা ও সাহসী একজন নেতা পেলে পাকিস্তান বহু বিপর্যয় থেকে বেঁচে যেতো।”

কিউবার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি, জনগণের অর্ন্তনিহিত শক্তির উপর অপার আস্থা, বিশ্বাস, অসম্প্রদায়িক মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালবাসা–মমত্ববোধ, ত্যাগ স্বীকার এবং সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু।

অল্প বয়স থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলীম লীগে। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেম ও দেশের জন্য কাজ করা তাঁর জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই তাঁর কর্মকাণ্ড বিচক্ষণতা ও ভাষণ শুনে সবাই আকৃষ্ট হতো। ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এদেশের নাম ছিল পূর্ব বাংলা। যখন পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান রাখার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয় সংসদের সদস্য তখন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এদেশটাকে বাংলা বলে ডাকেন। বাংলা শব্দটার নিজস্ব ইতিহাস আছে এর একটা ঐতিহ্য আছে আপনারা এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

ভাষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সবই ছিল ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নেওয়া। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুতও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ দেশ নিয়ে যে স্বপ্ন বুনেছিলেন, এদেশের মানুষকে যেভাবে বাঁচাতে চেয়েছিলেন সেভাবে বাঁচানোর সুযোগ তিনি পান নি। দেশ পুনর্গঠন ও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিনতর ছিল। এর মধ্যে তিনি সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষানীতি, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মত মৌলিক কাজগুলো করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে মনে হয়েছে নেতা হওয়ার জন্য কোন সংক্ষিপ্ত পথ নেই, ঘটনাচক্রে কেউ কেউ নেতা হতে পারেন বটে কিন্তু তারা মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারেন না। গণ মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারেন না। যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলার সাহস করেনি সমস্ত আয়োজন করেও, সেখানে এদেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করে বাংলাদেশকে হাজার বছর পিছিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন এদেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে? তাঁর ভালবাসার মানুষেরাই তাঁকে হত্যা করেছে।

আজকের যেই রাজনীতি, আজকের যেই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছিঁটেফোটাও এতে উপস্থিত নেই। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ঐতিহ্যবাহী এই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের এতটা অধপতন ঘটতো না। বঙ্গবন্ধু মানে আওয়ামী লীগ নয়, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দুরদর্শিতার একটা উদাহরণ দেই। নতুন সরকারের প্রথম ভারত সফরে যান বঙ্গবন্ধু। এই ডেলিগেশনে দেড় শতাধিক প্রতিনিধি ছিল। বিধান সরণীতে এই দুই রাষ্ট্রের বিশাল প্রতিনিধির মুখোমুখি মিটিংয়ে হঠাৎ মুজিব ইন্দিরাকে বলে বসলেন ম্যাডাম, আপনার সেনাবাহিনী কবে ফিরিয়ে আনছেন? পুরো সভা নিশ্চুপ। ইন্দিরার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ তিনি চুপ করে থেকে উল্টো প্রশ্ন করলেন, আপনি কবে ফিরিয়ে দিতে চান। পুরো হলরুমের সবাই বিস্মিত। সবাই বুঝলেন এই স্পর্শকাতর বিষয়টির খুব তাড়াতাড়ি সমাধান চাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। এবং ইন্দিরা গান্ধী খুব দ্রুত তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেন। এটা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এটা সম্ভব ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। ১৫ই আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের শিকার গোটা বঙ্গবন্ধুর পরিবার। কেন? বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন শোষিত মানুষের পক্ষে যে অবস্থান, সেটি বঙ্গবন্ধুকে এদেশের গণমানুষের নেতায় পরিণত করেছিল। এটিই ছিল সুযোগ সন্ধানীদের ভয়ের কারণ। বঙ্গবন্ধু কখনোই নিজের কথা ভাবেন নি। তিনি দেশ ও দেশের মানুষের কথাই ভেবেছেন। তিনি কোন দল কিংবা কোন গোষ্ঠীর নন তিনি সমগ্র দেশের, সকল মানুষের। যতদিন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা শব্দ দুটো থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে বারে বারে গৌরবের সাথে। “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার কবি, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাঙালির রাজনীতির কবি– বিশ্বের মানুষ এ সত্য স্বীকার করেছে”– সেলিনা হোসেন।

SUMMARY

923-1.jpg