১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক দিন। এদিন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস দুঃসহ কারাবরণের পর বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মাটি স্পর্শ করেন এবং লাখ লাখ অনুরাগীর ভালবাসায় সিক্ত হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দেশের জনগণ ১০ জানুয়ারিই প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন। কেননা দেশ স্বাধীন হলেও বাংলার মানুষ তখনও জানতেন না তাঁদের নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবিত আছেন কিনা! তাই বিজয়ের মধ্যেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা, ছিল বিষাদের ছাপ।
জীবন-মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। জাতির পিতা তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’। তাই বলা যায়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিনটি ছিল বাঙালির জন্য পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিন। যদি কারাগারে থাকাকালীন সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারের রায়ে জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হতো তাহলে বিজয় লাভের পরেও বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসত দুর্যোগ ঘনঘটা। বিপন্ন হতো আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। ৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডন হয়ে দিল্লীর যাত্রাবিরতি শেষে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, তা যেমন বাঙালির একটি অমর কাব্যগাথা, তেমনি ১০ জানুয়ারি একই জায়গায় বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন আবেগাপ্লুত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। এটিও বাঙালির মুক্তির অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৯০ দিন তিনি বন্দী ছিলেন পাকিস্তানে। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় আগস্টে তাঁর গোপন বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান। আগস্টের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন যে, পাাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে। প্রহসনের বিচারের আগে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বন্দী অবস্থায় প্রহসনের বিচার করে তাঁকে হত্যার সব রকম আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার যে কোন কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের মনোবলে চিড় ধরাতে চায়। ১০ আগস্ট প্রহসনের বিচার শুরু হয়। শেষ হয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়।
গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হলেও তাঁর অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসাবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল। বাঙালি জাতির মহান বিজয়ের ফলেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফিরে আসেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তাঁকে বাদ দিয়ে দেশকে কল্পনা করা যায় না। যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রবাহিত হবে, এ ভূখণ্ডে জনপদে মানুষের বসবাস থাকবে, ততদিন পর্যন্ত অমর হয়ে থাকবেন এই মহান নেতা। তাঁর অবদান গগণচুম্বী। তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। তাঁর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও নেতৃত্বগুণে তিনি কোটি মানুষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উচ্চমাত্রায় সাহসী, নির্লোভ, আপসহীন ও তেজস্বী নেতা। তিনি জীবনে কারো কাছে মাথা নত করেন নি। ভয়, সংশয় ও প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে উঠে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন পরিচালিত করেছেন। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রশ্নে তিনি সব সময়েই সোচ্চার ছিলেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে আদায় করে নিতেন সকল দাবি।
এমন এক অবিসংবাদিত নেতাকে বাঁচতে দেওয়া হয় নি। হত্যা করা হলো সপরিবারে, যা শুধু নৃশংস নয়, নারকীয়ও। সবচেয়ে বড় আশ্চর্য ও দুঃখের বিষয় যে, এ হত্যাকাণ্ডের যাতে কোনো বিচার না হয়, তার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়। শুধু-তা নয়, যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিদেশে পাঠিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ইতিহাসের একটি ধারা ছিল, যা পৃথক ছিল প্রাক ১৯৭১ সালের ধারা থেকে। প্রাক ১৯৭১ সালের ধারাটির অন্য একটি নাম দিয়েছেন ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন। তিনি একে বলেছেন ‘ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি ধারা’ বা ‘পাকিস্তানি মানস ধারা’। এ ধারার বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করেছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এ দেশের বাম, মৃদু বাম, মধ্যপন্থি, যাদের আমরা প্রগতিশীল বা লিবারেল বলি, তারা এ ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ ধারাটিকে পুষ্ট করে পরিণতির দিকে নিয়ে যান। ১৯৭২ সালের সংবিধান এ ধারার জয় সূচিত করে।
এ ধারা বা বাংলাদেশ ধারার জয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি ধারা যে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, তার বহিঃপ্রকাশ পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। এ বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হলো প্রাক ১৯৭১ ধারা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত চলেছে এর চর্চা। কিন্তু আনন্দ বা কিছুটা স্বস্তির সংবাদ এই যে, দেরিতে হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। এটা জাতির জন্য বড় দায় ছিল। এর মাধ্যমে আমরা বলতে পারি, আমরা পরাজিত ব্যক্তির প্রতিভূ নই। আমরা আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টার হত্যার বিচার কাজ সম্পন্ন করেছি। এখন কেবল সজাগ থাকতে হবে, সেই পরাজিত শক্রুরা যেন আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। যেন ওরা ছড়াতে না পারে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। জয় হোক প্রগতির। অব্যাহত থাক তাদের ধারাবাহিক যাত্রা।