বঙ্গবন্ধু থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসজুড়ে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বাংলাদেশের ইতিহাস বরাবরই উপনিবেশি আগ্রাসনের নিচে পড়েছে। উপনিবেশি শাসকেরা নিজেদের মতো করে এই ইতিহাস লিখে নিয়েছেন, প্রয়োজনে বদলে দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ইতিহাস বইগুলো খুলে দেখলেই বোঝা যায়, একটি অসাম্প্রদায়িক জাতির গায়ে সাম্প্রদায়িকতার একটি চাদর চাপানোর কত চেষ্টাই না হয়েছে। কিন্তু যে ব্যাপারটি উপনিবেশি শাসনকালে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায়, স্বাধীন দেশে তা কোন যুক্তিতে গ্রাহ্য হবে? কেন স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হবে, বদলে ফেলা হবে? কেন আবারও বাঙালিকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার জন্য সরকারি ইতিহাসবিদেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়বেন? যে ঘটনাটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়, তাকে কেন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে মানুষের মন থেকে?

ইতিহাস বিকৃতিতে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট যা করেছে, তার কোনো তুলনা নেই। যখনই ওই সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে, তখনই জোটের নেতারা চিত্কার করে বলেছেন, একটি মীমাংসিত বিষয়ে কেন নতুন করে বিতর্ক সৃষ্ট হচ্ছে? অথচ মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ঘটনাকে কী সহজে তাঁরা মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। ফলে জিয়াউর রহমান হয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বের দাবিদার, একমাত্র কান্ডারি; বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন ঊণজনের সারিতে, গৌণ ভূমিকায়। যেন ছাব্বিশে মার্চ ১৯৭১ জিয়াউর রহমানের বেতার ভাষণের আগে বাংলাদেশের কোনো ইতিহাস ছিল না। অবশ্য ১/১১-এর পর জোটের কোনো কোনো ইতিহাসবিদ কাগজে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধে স্বীকার করেছেন, ছাব্বিশে মার্চ নয়, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ২৭ মার্চ এবং সেটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। জোটের এক মন্ত্রী (বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে কারান্তরীণ) একবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন, সাতই মার্চে (অর্থাৎ ১৯৭১ সালের সাতই মার্চে) আবার এমন কী হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কোনোক্রমেই কোনো স্বীকৃতি দিতে তিনি বা তাঁর দল বা জোট রাজি ছিল না। জোটভুক্ত দল জামায়াতে ইসলামীর ক্ষোভটা অবশ্য বোঝা যায়। রাজাকার-আলবদরদের উষ্মাটাও বোঝা যায়। কিন্তু বিএনপি কেন বঙ্গবন্ধুকে এ রকম বিষ ভাববে, তাঁর কথা মুখে নিলে বিরাট পাপ হয়েছে বলে মনে করবে? বেগম খালেদা জিয়া যে ১৫ আগস্ট বিশাল কেক কেটে জন্মোৎসব করতেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ নেই। মানুষের একটা জন্মদিন থাকে এবং সেটি ১৫ আগস্ট অবশ্যই হতে পারে। আর জন্মদিনে কেক কেটে খাওয়া, আনন্দ করা—এসবও তো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জোট সরকারের রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে দেওয়া তাঁর বাণীর অর্ধেকটায় বন্দনা করবেন জিয়াউর রহমানের এবং এক ক্ষুদ্র প্যারাগ্রাফে শেরেবাংলা, ভাসানী প্রমুখের সঙ্গে একবার মাত্র বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করবেন, এ কেমন কথা? রাষ্ট্রপতি মহোদয় এখনো আছেন, এবং পনেরোই আগস্ট তিনি কী বাণী দেন, তা দেখার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

তবে আন্দাজ করতে পারি, তিনি বঙ্গবন্ধুকে এবার অনেক বড় মর্যাদায় স্মরণ করবেন। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পনেরোই আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সরকার নিয়েছে এ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের একটি রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে। আমার মনে হয়েছে, এ কাজটি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অনাবশ্যক গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করল। যে মানুষটি সারা জীবন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করলেন, যাঁর নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো, দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি এক পরাক্রমশালী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করল তাঁরই অনুপস্থিত নেতৃত্বে এবং যিনি এক প্রতিক্রিয়াশীল, বিবেকহীন গোষ্ঠীর চক্রান্তে পরিবারের প্রায় সবার সঙ্গে নিহত হলেন, সেই মানুষটির প্রতি কোনো দলের বা জোটের এমন তীব্র বিদ্বেষ কেন থাকবে? যে জাতি তার ইতিহাসকে বিশ্বাস করে না, তার মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে না, সে জাতির ভবিষ্যত্টা উজ্জ্বল হতে পারে না। ইতিহাস সেই জাতিকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে। বাঙালি জাতির একটি অংশ মাত্র অবশ্য এই দোষে দুষ্ট। কিন্তু তারা দেশের ক্ষমতায় ছিল বলে ইতিহাস নিয়ে জোরেশোরে মিথ্যাচার করেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির পক্ষ থেকে ইতিহাসকে সেই মিথ্যাচার থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছে। এ জন্য সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। ভবিষ্যতে যদি চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় যায়, তাহলে আবার তারা পনেরোই আগস্টের মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয় কি না, সেটি দেখার বিষয়, যদিও জাতীয় শোক দিবসের পক্ষে রায়টি উচ্চ আদালতের। কিন্তু জোট সরকার উচ্চ আদালতকে যে খুব মান্য করে চলবে, তা-ও তো বলা যায় না, অতীত ইতিহাস যদি কোনো উদাহরণ হয়ে থাকে।

 ভাবনামগ্ন বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
ভাবনামগ্ন বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

পনেরোই আগস্টকে নিশ্চয় বিএনপি-জামায়াত জোট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করবে না। আপাতত তাদের আপত্তি তারা হয়তো উহ্য রাখবে, সময় এলে জানিয়ে দেবে। আমার ভয়, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করেছে এতকাল, তার ধারা থেকে তারা কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। একইভাবে আওয়ামী লীগও যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করছে এতকাল, সে ধারা থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না। ফলে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাদের মূল্যায়নে পাওয়া যাবে না, বরং যা পাব তা একদিকে কিছু বিদ্বেষের কালিতে আঁকা ছবি, অন্যদিকে জীবন থেকে বড় একটি মিথের বিস্তার। প্রথম মূল্যায়নটি বিবেচনারও যোগ্যতা রাখে না। জোট সরকারের কিছু ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক এবং নেতারা যতই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে চান, করতে পারেন। তাতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না; তাঁরাই বরং আরও খাটো হয়ে যাবেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু যা ছিলেন না, তাঁকে তা প্রমাণ করা; মানুষ হিসেবে এবং মানুষের স্বাভাবিক ভুলত্রুটিসহ একজন মানুষ হিসেবে তাঁকে না দেখে একজন মহামানব হিসেবেই শুধু কল্পনা করাটা তাঁকে কোনো অতিরিক্ত উচ্চতাতেও নিয়ে যায় না। আমি কোনো ইতিহাসবিদ নই, আমি একজন সাধারণ নাগরিক মাত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে, যখন তিনি পাকিস্তানিদের ছয় দফার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, আগরতলা মামলার আসামি হয়েছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এনে দিয়েছেন, তখন আমি বেড়ে উঠেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, তাঁর বক্তৃতা শুনেছি, তাঁকে দেখেছি, তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছি, বাঙালি হিসেবে আত্মবিশ্বাসের পাঠ নিয়েছি, তাঁর মহিমায় আরও কোটি কোটি বাঙালির মতো উদ্ভাসিত হয়েছি। আবার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পর তাঁকে ক্ষমতার শীর্ষে দেখেছি। তাঁর অর্জনগুলো, তাঁর অনর্জন এবং ভুলগুলোকেও দেখতে পেয়েছি। তারপর তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত, স্তব্ধ হয়েছি। আমার সব সময় মনে হয়েছে, তিনি অসাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষই। এই পরিচয়টিই তাঁকে জনগণের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। এটি ভুলে গেলে চলবে না। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক ছিলেন, আবার একজন সাধারণ বাঙালিও ছিলেন। তাঁকে স্মরণ করা তাই শুধু অর্থহীন কিছু স্তুতি করে যাওয়া নয়, বরং মানুষ হিসেবে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করা। একজন মানুষ প্রায় একা একটা বিশাল শত্রুর হাঁটু ভেঙে দিলেন, সেই পৌরাণিক গোলিয়াথের বিরুদ্ধে ডেভিডের মতো সাফল্যে: তাঁর এই দিকটা যেমন আমাদের চিরস্থায়ী অনুপ্রেরণার উত্স, তেমনি যে সাড়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু।


তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

তিন বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, সে সময়টাকে কেন বাংলাদেশকে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের মজবুত ভিত্তি তিনি গড়ে দিতে পারলেন না, সে বিষয়টি বোঝাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু বড় বড় অর্জনের পেছনে যদি থাকে তাঁর প্রতিভা, উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা এবং উদ্দেশ্য সাধনে অবিচল সংগ্রাম; তাঁর দল, তাঁর সহকর্মীদের সহযোগিতা এবং দেশের মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা, তাহলে তাঁর অসফলতাগুলোর পেছনেও নিশ্চয় কারণ ছিল, যার মধ্যে তাঁর নিজের কিছু ভুল যেমন ছিল, তেমন ছিল দল ও সহকর্মীদের ব্যর্থতা এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অর্জন-অনর্জন নিয়ে প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ, ইতিহাস-ঘনিষ্ঠ তেমন কোনো মূল্যায়ন হয়নি। একদল ইতিহাসবিদ তাঁর অর্জনের কোনো উল্লেখ না করে শুধু অনর্জনগুলোকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাঁকে দানব বানানোর চেষ্টা করেছেন, যদিও তাঁদের গায়ে দলের লেবেল আঁটা থাকায় তাঁদের বইপত্র, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ওই দল বা সহমর্মী দলের রাতকানা সমর্থকদের জন্যই। আবার আরেক দল ইতিহাসবিদ শুধু তাঁর অর্জনগুলো নিয়েই গবেষণা করেছেন, অনর্জনের দিকগুলোকে এড়িয়ে গেছেন বা নানা যুক্তির জালে বৈধতা দিয়েছেন। এখানে শুধু দু-তিনটি এ রকম অনর্জন বা ভুলের উদাহরণ দেওয়া যায়, যেগুলোর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ আমাদের অনেক সমস্যার নিষ্পত্তিতে সহায়তা করবে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় শতভাগ সাফল্য, রক্ষীবাহিনী গঠন এবং দেশজুড়ে বিরোধীদের ওপর নির্যাতন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ১৯৭৫ সালের আগস্টের পূর্ব পরিস্থিতি বুঝতে না পারা। এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদের মতো একজন সৎ, যোগ্য এবং দেশপ্রেমিক নেতাকে বঙ্গবন্ধু কেন দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন, এ প্রশ্নটির উত্তর খোঁজাও গুরুত্বপূর্ণ।

এসব ঘটনার প্রতিটির পেছনে আছে দলের দাবিকে সবার ওপরে স্থান দেওয়ার বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে ভালোবাসবেন, সেটি স্বাভাবিক; কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশের স্বাধীনতার জন্য অন্যান্য দলের সদস্যরা এবং বিরাটসংখ্যক সাধারণ নাগরিক যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের বাইরে রেখে ক্ষমতায় শুধু আওয়ামী লীগকে জায়গা দেওয়াটা ছিল অনুচিত। রক্ষীবাহিনী দিয়ে বিরোধীদের শাস্তি দেওয়াটা ছিল অনুচিত। চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়াটা ছিল অনুচিত। এসব অনুচিত কর্মের বোঝা কিন্তু এখনো আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। এখনো আমাদের গণতন্ত্রে ‘উইনার টেকস অল’ অর্থাৎ যে জেতে সবকিছু তার, এই মানসিকতা চলছে। আমাদের দেশে এখন র‍্যাবের ক্রসফায়ারে মানুষ মরছে। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষজন শুধু যে অধিকারবঞ্চিত, তা নয়; অনেকে নিজ দেশে আছেন পরবাসীর মতো। যদি বঙ্গবন্ধু আরেকটু উদার হতেন, দলের ইয়েসমেনদের থেকে দূরে থেকে তাজউদ্দীনের মতো মানুষদের পরামর্শ নিতেন, যদি ধৈর্যশীল হতেন ছাত্রদের প্রতি, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া তরুণদের প্রতি, বাংলাদেশের অনেক সমস্যাই এখন অতীতের বিষয় হয়ে দাঁড়াত।

দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশকে নিয়ে যে গভীর চক্রান্ত চলছিল, পাকিস্তানিদের অহংকারগুলো চূর্ণ করার জন্য তাঁকে যে পাকিস্তানি মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ক্ষমা করবে না এবং এ-দেশীয় রাজাকার-আলবদর যে সুযোগ পেলেই তাদের প্রতিশোধ নেবে, বিষয়টি নিয়ে না বঙ্গবন্ধু, না তাঁর দলের হর্তাকর্তা, কারও কোনো উদ্বেগ ছিল। বিষয়টি সত্যি অবাক করার মতো। মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি যুক্তরাষ্ট্রের অহমিকায় ছিল বড় আঘাত, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার জন্য ছিল একটি অন্তহীন দুঃস্বপ্ন। কে না জানে, এই দুই দেশের তখন গলায় গলায় বন্ধুত্ব। তাদের সঙ্গে আরও মিলেছে চীন, যার সঙ্গে পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে মিল হলো যুক্তরাষ্ট্রের। বেইজিংয়ে জুলাই ১৯৭১-এর শুরুর দিকে, কিসিঞ্জারের গোপন সফরের সময় প্রথম সুযোগেই যে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি বদলা নেবে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় ইতিহাসের কোনো প্রথম বর্ষের ছাত্রেরও, বিশেষ করে দেশে যখন রাজাকার-আলবদরেরা পুনর্বাসিত হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা, পাকিস্তানি মনোবৃত্তির কিছু সেনা যোগ দিয়েছে সামরিক বাহিনীতে। এসবের বিপরীতে সরকার ও আওয়ামী লীগের নিস্পৃহতা দেখে ইতিহাসই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে।

বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুর জন্য নির্ভর করেছেন তাঁর সহকর্মীদের ওপর, কিন্তু তাঁদের অনেকেই তখন ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে, দল ও ক্ষমতা নিয়ে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে সঠিক পরামর্শ দেননি। তাঁদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে। জনগণের মন তাঁরা বুঝতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর হাতে এক শটি কাজ ছিল, কিন্তু তিনি ভালো সমর্থন পাননি। পনেরোই আগস্ট ১৯৭৫-এর পর যখন তাঁর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কয়েকজন বাদে তাঁর সহকর্মীরা কেউ রাস্তায় নামলেন না, পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন, কেউ কেউ খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় নাম লেখালেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু খুব খাটো উচ্চতার দেশে দীর্ঘ উচ্চতার একজন মানুষ। ঝড়টা তাঁর ওপর দিয়েই গেল, কিন্তু ঝড়ের জন্য তিনি যথাযথ প্রস্তুত ছিলেন না।

আমি জানি, আমার এ লেখাটির ওপরের কয়েকটি লাইন পড়ে একদিকের কিছু মানুষ হাততালি দেবেন, আবার অন্যদিকের কিছু মানুষ খুবই বিরক্ত হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন মাত্র সাড়ে তিন বছরেই চলে গেলেন, তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্ন এত বড় একটা আঘাত পেল, কেন সেই আঘাত থেকে আমরা এখনো উঠে দাঁড়াতে পারলাম না, তা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এবং গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তাতে দেখা যাবে, একটি জালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আটকা পড়েছিলেন, যেটি ছিল দলনির্ভরতা, ক্ষমতা, অসঠিক নানা সিদ্ধান্ত এবং দেশের ভেতরে ও বাইরের নানা চক্রান্তের, তার দায় কতটা বঙ্গবন্ধুর, কতটা অন্যদের, সেটিও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বাস্তব, তা কোনো কল্পনা নয়। ১৯৭১ সালে আমেরিকার কী ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে, সম্প্রতি অবমুক্ত করা মার্কিন সরকারের কাগজপত্রে তা এখন স্পষ্ট। ওপরে যেমন উল্লেখ করেছি, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিলে আমাদের ভবিষ্যতের পথচলা সহজ হয়।

২. 
বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস কল্পনা করা বাতুলতা মাত্র। তাঁর মতো উচ্চতার নেতা আবার কবে আমরা পাব, জানি না। তাঁকে আমি তাঁর অসম্ভব বাঙালিয়ানার জন্য, তাঁর অসাধারণ সাধারণত্বের জন্য, মানুষের হৃদয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ার ক্ষমতার জন্য শ্রদ্ধা জানাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(এই লেখাটি ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।)

SUMMARY

92-1.jpg