বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রসঙ্গে


মুহাম্মদ শামসুল হক
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে যুদ্ধপ্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছিলেন ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে ৩ মার্চ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে পল্টনে এক ছাত্র গণসমাবেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইস্তেহার ঘোষণা করা হয়। আর সেই ইস্তেহারের একটি ধারায় বঙ্গবন্ধুকে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক’ ঘোষণা করা হয়।
কথা ছিল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। কিন্তু ১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ৩ মার্চের প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বাংলার ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওইদিনই (১ মার্চ) ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির অনির্ধারিত বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জানান, ‘আমরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সক্ষম এবং সাত কোটি বাঙালির মুক্তির জন্য আমি চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত রয়েছি। ষড়যন্ত্রকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে আমরা নতুন ইতিহাস রচনা করবো। বস্তুত ‘নতুন ইতিহাস রচনা করবো’ কথাগুলোর দ্বারা বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এদিকে ৩ মার্চ থেকে চলে আসছিল দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এলো ৭ মার্চ। এখনকার মতো আধুনিক মোবাইল যোগাযোগ, শ শ সংবাদপত্র কিংবা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক কর্মসূচি ঘোষণার সহজ কোনো পদ্ধতি ছিল না সে সময়। তবু ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের রাজপথ ভেঙে নেমেছিল জনতার ঢল। বিশাল রেসকোর্স ময়দানের (পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, একাংশে স্থাপিত হয়েছে শিশুপার্ক। ৯৭-এর স্বাধীনতা দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই উদ্যানের একাংশে স্থাপন করেন শিখা চিরন্তন) কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সেদিন শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার প্রহর ভেদ করে অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু ২০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তা বিশ্ব ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য দলিল হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির নানাদিক পর্যালোচনা করলে এটা পরিষ্কার হয় যে, পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং কথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ মতো অন্য কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতার বিষয়টি মাথায় রেখে কৌশলী বক্তব্য দেন তিনি। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অপরিহার্যতা তুলে ধরাসহ শত্রুপক্ষকে মোকাবেলার জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতির বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেছেন, মুক্তির কথা বলেছেন। যুদ্ধ শব্দটি সরাসরি না বলে ‘লড়াই’ এর জন্য জনগণকে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছেন। কর্মীবাহিনীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এরপর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন এবং যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে চাকরিজীবী ও সাধারণ জনতা এই ভাষণ শুনে শিহরিত হয়েছেন। সিদ্ধান্ত জেনে গেছেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের গণ্ডিবদ্ধ নেই। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ভাষণ শোনার পর যে রক্ত আগুন জ্বলে উঠে বাঙালির শিরা-উপশিরায় সেই থেকে বাঙালিরা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসিহংস-অসহযোগ আন্দোলনে। চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষার পর এলো ২৫ মার্চ। সেই থেকে মুক্তির শেষ সময় পর্যন্ত বাঙালি তরুণ-যুবক-দামাল ছেলেসহ বাঙালি, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা এই ভাষণকে মন্ত্রজ্ঞান তথা যুদ্ধপ্রস্তুতির নির্দেশ মনে করে লড়াই করে গেছেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। যদিও ২৫ মার্চের দিনগত মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক একটি ঘোষণাও দিয়ে যান।
বস্তুত ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশের সাধারণ কৃষক-শ্রমিক দিনমজুর থেকে গাঁয়ের গৃহবধূর মুখে মুখেও তখন বলাবলি হচ্ছিল, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকছে না। যেসব বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং অস্ত্র তুলে নেবার আহ্বান মনে করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক, (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চই যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন তা উল্লেখ করে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটছিল। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বাঙালি অফিসাররা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সবার মনে একটি চিন্তাই পাক খেয়ে ফিরছিল কি করা যায়? কি করবো? …এরপর এলো ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বললেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা একে অস্ত্র তুলে নেবার আহ্বান বলেই মনে করলেন।’ (‘একটি জাতির জন্ম’ জিয়াউর রহমান, দৈনিক বাংলা, ২৬ মার্চ, ১৯৭২)।
মুক্তিযুদ্ধের আর এক সেক্টর কমান্ডার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে প্রথম প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী ইপিআর কমান্ডার, মেজর রফিকুল ইসলাম (পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বলেন, ‘সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ মিছিল, হরতাল চলছে এবং ঘোষণা করা হয়েছে ৭ মার্চ রেসকোর্স এর মাঠে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। আমরা অপেক্ষায় আছি যে সে ঘোষণায় তিনি কী দিক নির্দেশনা দেন।… সেদিন আমার অনুভব হয়েছিল, তাঁর ভাষণে আমাদের প্রত্যেকের জন্য শুধু নয়, সামরিক বাহিনীর প্রতিটি বাঙালির জন্য কী করণীয় তিনি সে নির্দেশে সুস্পষ্টভাবে সে ভাষণে দিয়েছিলেন। (চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় দেওয়া বক্তৃতা-১৯৯৪ সালে)
তারপরও বিভিন্ন সময়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন বা তর্ক করে বলেন, বঙ্গবন্ধু কেন সেদিন (৭ মার্চ) স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন নি? যদি তিনি তা করতেন তাহলে আজ এত লোকের জীবনহানি হতো না ৯ মাসের যুদ্ধে। আসলে রেসকোর্সের সেই সমাবেশের দিন কিংবা তারও কয়েকদিন আগে থেকেই ছাত্রজনতার অনেকেরও ধারণা এবং আকাঙ্ক্ষা ছিল ওই জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু সেরকম করলে তাৎক্ষণিক বিশ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা মাথায় রাখেন বলে মনে হয় না। তখনো বিশ্বের অন্যতম প্রধান সুপার পাওয়ারের অধিকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শক্তি চীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা মানেই হলো যুদ্ধ ঘোষণা। কিন্তু এই যুদ্ধ শুরু হলে তা দীর্ঘায়িত বা স্বল্পকালীন হওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি তখনো সম্পাদিত হয় নি। এমনই এক পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বল্পকালীন একান্ত বৈঠকে বসে জানিয়ে দেন যে, ‘পূর্ব বাংলার স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’ এর আগে ৬ মার্চ চরম কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আমার অনুরোধ তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকা এসে আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করব। আমি আশ্বাস দিতে পারি যে, জনগণের কাছে আপনার প্রদত্ত ওয়াদা পালিত হতে পারে।’ (বাংলাদেশের তারিখ: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৩৮)। এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন ? জানা যাক, বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের একটি বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি থেকে; ‘এটা পরিষ্কার ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ এবং রাজনীতি সচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দায়িত্বের ভার ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর দলের ওপর ন্যস্ত। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার সার্বিক ফলাফল তাই সতর্কভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়োজন ছিল। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অর্থ দাঁড়াত সামরিক বাহিনীকে তার সকল শক্তি নিয়ে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত করা। এতে তারা যে শক্তি প্রয়োগের ছুঁতো খুঁজে পেতো তাই নয়, বল প্রয়োগে তাদের ইচ্ছে চরিতার্থ করতে তারা সব কিছুর ওপর সকল উপায়ে আঘাত হানত। কোনো নিরস্ত্র জনগোষ্ঠী কি ওই ধরনের হামলার আঘাত সহ্য করে বিজয়ী হতে পারে? বহির্বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়াই বা কী দাঁড়াবে? অন্যান্য দেশের সরকারগুলো কি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে? একটি সুসংগঠিত সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যতদিন প্রয়োজন ততদিন টিকে থাকতে পারবে তো? অজস্র প্রশ্নের মধ্যে এগুলো ছিল কয়েকটি যা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হলো। বৈঠকে শেখ মুজিব বিভিন্ন মত শুনলেন, তবে নিজের অভিমত সংরক্ষিত রাখলেন।’ কাজেই চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘স্বাধীনতা’। কিন্তু শেখ মুজিব কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত রইলেন। কেননা এটা পরিষ্কার ছিল যে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে তারা অবস্থানও নিয়ে ফেলেছে যাতে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা আক্রমণ শুরু করতে পারে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পূর্ববর্তী মধ্যরাতে (৬ মার্চ) ইয়াহিয়ার একটি বার্তা নিয়ে একজন ব্রিগেডিয়ার এসেছিলেন দেখা করতে। বার্তায় বলা হয়েছিল, ইয়াহিয়া খুব শিগগিরই ঢাকায় আসার ইচ্ছা রাখেন এবং এমন একটি মীমাংসায় পৌঁছার আশা করছেন যা বাঙালিদের সন্তুষ্ট করবে। এটা ছিল এক চাতুর্যপূর্ণ যোগাযোগ… এটাকে তাঁর (ইয়াহিয়ার) জন্য একটা অজুহাত তৈরির চেষ্টা হিসেবেও দেখা হল এভাবে যে, যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় তাহলে ইয়াহিয়া সারা পৃথিবীকে বলতে পারবে যে, একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছার জন্য তিনি ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবই একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শক্তি প্রয়োগে বাধ্য করেছেন। ৭ মার্চ একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া থেকে শেখ মুজিবের বিরত থাকার ক্ষেত্রে এটাও ছিল বিবেচনার আর একটি বিষয়। (ড. কামাল হোসেন: মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল; পৃষ্ঠা ৬১-৬৩-৬৪)।
সুতরাং যাঁরা বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা যুদ্ধ ঘোষণা না করে ভুল করেছিলেন তাঁদের জন্য লেখক রাজনীতিবিদ প্রয়াত আবুল মনসুর আহমদের একটি অভিমত উপস্থাপন করে এ লেখার ইতি টানব। তিনি লিখেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের সময় স্বাধীনতার ঘোষণাটা না করিয়া মুজিব কত বড় দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন, সেটা বুঝিবার মত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ঐসব থিউরিস্টের নাই, এ সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায়। সেসব কথার মতামতের দুইটা দিক আছে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবের সামনে দুই দিকের সমান উপস্থিতি ছিল। (এক). যুক্তির দিক (দুই). বাস্তব দিক। সংক্ষেপে এই দুইটা দিক সম্বন্ধে বলা চলে কোন দিক হইতে ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা সমীচীন হইত না। যুক্তির দিক থেকে হইত না এই জন্য যে, প্রেসিডেন্টের পক্ষে বেআইনিভাবে পরিষদের বৈঠক বাতিল করাটাই স্বাধীনতার ঘোষণার পক্ষে যথেষ্ট কারণ ছিল না। আর বাস্তবতার দিক হইতে সেটা সমীচীন হইত না এজন্য যে, তাতে সভায় সমবেত ২০ লাখ নিরস্ত্র জনতাকে সুসজ্জিত বাহিনীর গুলির মুখে ঠেলে দেওয়া হইত। তাতে নিরস্ত্র জনতাকে জালিওয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বহুগুণ নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার বানানো হইত। হত্যাকাণ্ড বাদেও যেসব নেতা বাঁচিয়া থাকিতেন তাহাদের গ্রেপ্তার করা হইত, বিচারও একটা হইত। আরও জানা কথা, স্বাধীনতা বা অটোনমির আন্দোলন বহুদিনের জন্য চাপা পড়িত। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্য সেটা হইত অনেক গুরুতর লোকসান। অতএব ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা না করিয়া শেখ বিজ্ঞ জননেতার কাজ অবশ্যই করিয়াছেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে।’
লেখক : সম্পাদক ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।

SUMMARY

918-1.jpg