ড. মো: সেকান্দর চৌধুরী
১৭ মার্চ। বাঙালির ইতিহাসের একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। এদিন বাংলার চির সবুজ ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ এক গ্রামীণ পরিবেশে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে ভূমিষ্ঠ হন বাঙালির মুক্তির দূত। কে জানতো আজকের দিনে আরো অনেকের সাথে জন্ম নেয়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এ ছেলেটি হবে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এ ছেলেটিই সময়ের সাথে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করে স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ এ মহান নেতার জন্মের ৯৯ বছর। আর এক বছর পর বাঙালি উৎযাপন করবে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্মশতবার্ষিকী।
বাঙালি জাতির উৎপত্তি, ঘাত-প্রতিঘাত, পরাধীনতা ও স্বাধীনতার সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস রয়েছে। বঙ্গ, সমতট, রাঢ়, গৌড় ও হরিকেল অঞ্চলগুলোর মধ্যে বঙ্গ অঞ্চলটি কালে কালে বিভিন্ন শাসকের দ্বারা শাসিত হয়েছে। এ শাসকদের প্রায় সবাই বাইরে থেকে এসে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ী হন। বাংলার সম্পদ প্রাচুর্যের লোভে যুগে যুগে পৃথিবীর শাসকরা বাংলায় এসেছে। গ্রীক বীর আলেকজান্ডার ও সুলতান মাহমুদ শুধু ব্যতিক্রম। তাই প্রাচীনকাল থেকে শাসক এবং এদের সাথে আগত বিভিন্ন জাতি যেমন- আর্য-অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, মগ, হুন-দল, মুঘল-পাঠান সবাই বর্তমানের বাঙালি জাতির মধ্যে মিশে গেছে। কবিগুরুর ভাষায়-
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন / শক হুন-দল পাঠান মোঘল একদেহে হলো লীন।
ইতিহাসে প্রথম শাসক হিসেবে শামশুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে একত্রিত করেন। তিনি এসময় ‘শাহ-ই-বাঙালা’ উপাধি ধারণ করে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তার শাসন বিস্তৃত করেন। তিনি নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন এবং খুৎবা পাঠের নির্দেশ দেন। মুসলিম শাসনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বংশের শাসকরা ভারতবর্ষ শাসন করেন। মুসলিম শাসনের অধীনে শাসকরা বাংলাকে নিজের মত করে আপন ভূমি ভেবেই শাসন করেছেন। তবে এসকল শাসকের সময়ে বাংলা একটি সুসংগঠিত জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি।
১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে বাংলার শেষ স্বাধীন শাসক সিরাজুদ্দৌলা পরাজিত হলে বাংলার সমাজ জীবনে নতুন ধরনের ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তৃত হয়। বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ সম্রাজ্যের কলোনির অংশ হিসেবে ভারতবর্ষকেও তারা সম্ভাবনাময় বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে। এসময় ব্রিটিশরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার প্রসারিত করার জন্য নতুন নতুন উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা পেলে ইউরোপের নতুন আবিষ্কার ও চিন্তার সাথে ভারতবর্ষের মানুষের সংযোগ ঘটতে শুরু করে। এ সংযোগ শুধু বাণিজ্যিক নয়, শিক্ষা, সভ্যতা থেকে শুরু করে নিত্য নতুন আবিষ্কারের সাথে প্রাচ্যের প্রতিনিয়ত সংযোগ সাধিত হতে থাকে। এর ফলে ভারতের সমাজ জীবনে মধ্যযুগীয় প্রভাব রহিত হতে থাকে এবং মানুষ আধুনিক চিন্তা ও শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রধান উদ্দেশ্য বাণিজ্য হলেও নানাবিধ সংস্কারে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এরসাথে প্রাচ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদানও উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক বাংলার সংস্কারকদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের অবদান অগ্রগণ্য। রাজা রামমোহন রায় ১৮২০ এর দশকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার লক্ষ্যে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা দায়ের করেন। এর প্রায় ১০০ বছর পর জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতার বিরুদ্ধে জোড়ালো প্রতিবাদী হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি শুধুমাত্র শিল্প সাহিত্য মহলেই নয় রাজনৈতিক মহলেও সচেতন হিসেবে পরিগণিত ছিলেন। ভারতীয়দের এই আধুনিক ইংরেজি শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তরের সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। আর কার্ল মার্ক্স এটিকে বলেছেন ‘আনকনসাস টুলস অব হিস্ট্রি’। রবীন্দ্রনাথের কালান্তরের সংকট এবং কার্ল মার্ঙের আনকনসাস টুলস অব হিস্ট্রি যে সময়ের সাথে এ অঞ্চলের মানুষকে স্বাধীনতার পথে চালিত করবে তা বোধ হয় ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি বলেই লেখা ছিল।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন যে, এ অঞ্চলের মানুষ এক সময় নিজেই নিজের পথ খুঁজে নেবে। এ জাতির মুক্তির জন্য একজন মহামানবের আবির্ভাব ঘটবে। তাইতো তিনি ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছিলেন- ‘আজ আশা করি আছি পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দরিদ্র লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দ্বৈববাণী সে নিয়ে আসবে। মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’ বাঙালির পরিত্রাণকর্তা মহানায়ক বঙ্গবন্ধুই কি রবীন্দ্রনাথের সেই প্রতিশ্রুত নাম?
কিংবা ইতিহাসের প্রভাবশালী অটোমান রাজবংশ প্রতিষ্ঠাকালীন যে স্বপ্নের কথা প্রচলিত আছে যেখানে বলা হয়েছে- শেখ ইদিব আলী স্বপ্ন দেখলেন একজন সুদর্শন পুরুষের সাথে তার মেয়ে ঘুমিয়ে আছে যেখান থেকে একটি গাছের চারা বেড়ে উঠে গাছটি তিন মহাদেশে তার শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে। শেখ ইদিব আলী এর ব্যাখ্যার জন্য দারবিশের কাছে গেলে তিনি ইদিব আলীকে বললেন তোমার মেয়েকে ওরখানের সাথে বিয়ে দাও। এ বিয়ের মাধ্যমে যে সন্তানের জন্ম হবে তার মাধ্যমে তিন মহাদেশ বিস্তৃত সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটবে। ঠিক তেমনি, পূর্বসূরীদের উচ্চারিত প্রতিশ্রুত ব্যক্তি কি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন? এ বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ইতিহাসের পাঠে মনোযোগ দিতে হবে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফসল ভারত ভাগ ছিল অবাস্তব ও অবিবেচনাপ্রসূত। এ ভারতবর্ষ ভাগ থেকে উদ্ভূত পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশে বিভক্ত যার একটি থেকে আরেকটি হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। ফলে পাকিস্তানের জন্ম থেকেই যে ত্রুটি তা অতি অল্প সময়ে বিরোধ হিসেবে দেখা দেয়। এ বিরোধ হিসেবে প্রথম সম্মুখে আসে ভাষার প্রশ্ন। ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বাঙলার জনসাধারণের মধ্যে যে ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতৃত্বে আবির্ভূত হতে দেখতে পাই। তিনি বাংলা ভাষার অপমান সহ্য করেন নাই। অসমাপ্ত আত্নজীবনী গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি আব্বাসউদ্দিন কে কথা দিয়েছিলেন এবং সেকথা রাখার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং সেকথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।’ পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা ঐ জাগরণকে আরো গতিশীল করে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে বিশেষ করে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট রূপ লাভ করলো। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয় ঘটে। এই আন্দোলনের গতি আরো ত্বরান্বিত করে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দিয়ে বললেন- “তোমাদেরকে স্বায়ত্ত্বশাসনের সাঁকো দিলাম, এটির পথ ধরে তোমরা স্বাধীনতা অর্জনের দিকে ধাবিত হবে।” এই ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন।
পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার আকুতি শেখ মুজিবের মধ্যে বরাবরই ছিল। এই ঘটনা পরম্পরায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করে জেলে বন্দি করা হয়। পূর্ববাংলার ছাত্র রাজনীতির উত্তাল মুহূর্তে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্ত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের স্বপ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি এবং তৎপরিপ্রেক্ষিতে গণআন্দোলনগুলো পরিচালিত হচ্ছিল। আন্দোলনের এ ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কবির মতো উচ্চারণ করলেন,- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর এই কালজয়ী ভাষণে বাঙ্গালির স্বাধীনতা ও পরবর্তী করণীয় সবকিছুই যেন প্রতিভাত হয়ে উঠলো। বাঙালি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলো এক আমরণ সংগ্রামের। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বিশ্ব বিবেককে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের পক্ষে আনতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকেই যেন প্রথম আঘাতটি আসে এবং এভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে নীরিহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের উপর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক সেই বর্বোরোচিত হত্যাকাণ্ড চালায়। পাক হানাদার বাহিনী ঐ রাত্রেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। পাক বাহিনীর হাতে বন্দি হবার আগে বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখন ২৬ মার্চ। ইতিহাসের এক নব অধ্যায়। বিশ্বের বুকে আবির্ভাব ঘটলো নতুন একটি দেশের, নতুন একটি স্বাধীন জাতির। এ দেশ বাংলাদেশ, এ জাতি বাঙালি জাতি। প্রতিষ্ঠা পেল একটি জাতিসত্ত্বা থেকে একটি জাতিরাষ্ট্র।
বঙ্গবন্ধুর পিতা বঙ্গবন্ধুকে উপদেশ দিয়েছিলেন- ্তুঝরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব্থ থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না। বঙ্গবন্ধু একথা কোনদিন ভুলে যাননি। তিনি বাঙালির জন্য পিতার এ আদেশ মেনে চলেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তাইতো এভাবেই ইতিহাসের এ মহানায়কের হাত ধরে বাঙালি পেল তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা ও মুক্তি। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো একটি জাতি। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত নব রাষ্ট্র বাংলাদেশের যেন আরেকটি পরিচয় হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ যে বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ। তাইতো একথা বলা অত্যন্ত বাস্তব যে, বঙ্গবন্ধু, তোমার জন্মেই বাংলাদেশ।
লেখক : ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।