আয়েশা পারভীন চৌধুরী
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের সমার্থক। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, “একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য/অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উম্মুক্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকত কখন আসবে কবি ? কখন আসবে কবি?” কবি এসেছিলেন, লিখেছিলেন তার অমর কবিতাখানি। সেই কবি আর কেউ নন, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতি বছর জন্ম ও শাহাদত দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয় জাতির অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহান বাঙালিকে। ১৯৭৫ সালের শোকাবহ ১৫ আগষ্টে সূর্য উঠার আগে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য নিজ বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করেছিল। ঘাতকের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোন উত্তরাধিকার যেন বেঁেচ না থাকে। আর সেজন্যই তার কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছরের শিশু রাসেলকেও হত্যা করে। কিন্তু জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু আরো বেশি জীবন্ত হয়ে প্রতিনিয়ত প্রেরণা যুগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে নাই বরং শোককে আরো বেশি শক্তিশালী করে তুলেছে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০এর নির্বাচন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বঙ্গবন্ধুকে অতুলনীয় ও অদ্বিতীয় মহান নেতার আসীন করেন। পরবর্তীতে তাঁর নেত্বত্বে ১৯৭১ এর ৯মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে তাঁকে অবিসংবাদিত নেতার আসন এনে দিয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রবন্ধে লিখেছেন, “সেই জাতিই ভাগ্যবান, যার নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণার রসদ খুজে পায়।” যদিও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল ইতিহাসের অমোগ নিয়মে মুক্তিযুদ্ধ ও তার মূল প্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে স্বমহীমায় অধিষ্ঠিত হতে থাকে। দলমত নির্বিশেষে তিনি বাঙালি জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বল আইকন হিসেবে দিন দিন আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। বঙ্গবন্ধু আজ মিশে আছেন প্রতিটি বাঙালির মনে। সেই কলঙ্কিত ৭৫এর অনেক পরে যাদের জন্ম, তাদের কাছেও আজ বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল সেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীক। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের প্রতীক।
১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু করতে চেয়ে পাকিস্তানীরা দুর্বার গণআন্দোলনে ব্যর্থ হয়। আবার পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান রাখার জন্য সিদ্ধান্ত নিলে বঙ্গবন্ধু এর জোর বিরোধীতা করেন। তিনি সংসদে দীপ্ত ও দৃঢ়চিত্তে বলেন, আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এ দেশটাকে বাংলা বলে ডাকেন। বাংলা শব্দটির নিজস্ব ইতিহাস আছে। এর একটা ঐতিহ্য আছে। স্কুল-কলেজের পাঠ্য বইয়ে বঙ্গবন্ধুর উপর প্রবন্ধ আছে। বিভিন্ন প্রতিযোগীরা, যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করে। টেলিভিশন ও রেডিওতে বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রচারিত হয়, শিক্ষকরা ক্লাসে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেন, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপর বই পুরস্কার দেওয়া হয়। ঘরে ও বাহিরে অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজন বঙ্গবন্ধুর ওপর আলোচনা শুনেন। এভাবেই শিশু কিশোররা জাতির পিতা সম্পর্কে জানতে পারে। শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে ধাপে ধাপে নিজের যোগ্যতায় জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থাপতি বঙ্গবন্ধুও মুুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন। ‘হে মহান তোমার করণে, তোমার স্মরণে এ বাংলা, বাঙালি রবে চিরদিন’- এ স্নোগানে আর্ট ক্যাম্পের আয়োজনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে রং তুলিতে আবিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়। জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, রক্তদান কর্মসূচি, প্রামাণ্যচিত্র, চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, কবিতা, আবৃতি, নাট্যশালা, থিয়েটার, ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়। সংরক্ষিত এই আলোকচিত্র ও প্রামাণ্য দলিলগুলো কালের সাক্ষী হিসেবে থেকেছে। বাংলাদেশের পুরো মানচিত্র জুড়ে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব বিরাজ করছে। কবি অন্নদাশংকর রায় কবিতায় বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও অস্তিত্ব তুলে ধরেছেন, “যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান/ তবু নাহি ভয়, হবে হবে জয়/জয় মুজিবুর রহমান।” বাঙালি-বাংলা-বঙ্গবন্ধু এক সূত্রে গাথা। তাই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে ভাবায়।” ঐ নিরন্তন সম্প্রতির উৎস ভালোবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। কবি রফিক আজাদ বলেছিলেন “স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর”। এডওয়ার্ড হীথের সৌজন্যতা ও বদান্যতা আজো সবাই মনে রেখেছেন। ১০ ডাউনিং ষ্ট্রিটের সড়কে নেমে নিজ হাতে গাড়ির দরজা খুলে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৭৩ সালে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি” বঙ্গবন্ধুর চমৎকার ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা, বিচক্ষণতা, অভিব্যক্তি, অসীম সাহসে অভিভূত হয়েই কাস্ত্রো এমন মন্তব্য করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে ইসলামী মহা সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু লাহোর যান। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমেই দেখেন তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা নেই। বাংলাদেশের পতাকা বিহীন গাড়িতে তিনি চড়তে অসম্মতি জানানোর পর অপেক্ষারত গাড়িটিতে বাংলাদেশের পতাকা লাগানো হয়। তার এমন সাহসী দৃঢ় মনোভাবের ফলে তৎকালীন লাহোরের সংবাদ পত্রগুলোতে বেশ জোড়ালো ভাবে সংবাদটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশাল এক প্রতিনিধি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু কোন ধরনের ইতস্তত মনোভাব ছাড়াই ইন্ধিরা গান্ধীকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর এহেন হঠাৎ প্রশ্নে বুদ্ধিমতি ইন্ধিরা গান্ধী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন এবং সেনা প্রত্যাহার করেন।
হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী কিশোর বঙ্গবন্ধুর মাঝে যে অসীম সাহস ও দৃঢ় মনোবল দেখেছিলেন প্রতি পদে বঙ্গবন্ধু তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। ২০১৮ সালে ইউনিসেফ কর্তৃক স্বীকৃত তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তাকে আরো অনেক দূরে নিয়ে যায়। বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক কালজয়ী ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধুমাত্র স্বাধীনতাকামী বাঙালীর মুক্তির সনদ নয়, বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানুষের জেগে উঠার মন্ত্র। জাতিসংঘে তিনি বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন। Non-Aligned Movement এর তৎকালীন নেতৃবৃন্দের মধ্যে তিনি ‘জুলিও কুরি’ উপাধি পেয়েছিলেন। নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় “১৯৭৫-এ আমি হারিয়েছি আমার প্রতীক, শোর্যবীর্য ধারা অন্ধকারে/তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে একা, গৃহহার/’। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডকে ঘৃণা জানিয়ে প্যারিসের বিখ্যাত সংবাদপত্র (Le Mondel) রবার্ট এসকারপি মন্তব্য করেছিলেন, “বড় নেতা সেই যে সময়ের সাথে সাথে আরও বড় হতে থাকে। তাকে খুন করে সমাজ থেকে নির্বাসিত করা যায় না। সে বরং বার বার ফিরে আসে।” প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই মাপের নেতা। অসাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে পুরো বাঙালি জাতিকে এক করেছেন। তার আগে ও পরে বাংলার ইতিহাসে অনেক বড় বড় নেতার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু কেউ এক বাক্যে বাঙালিকে এক করতে পারেনি। “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” এই স্লোগানটিই এর মোহনীয় শক্তিই সবাইকে এককাতারে নিয়ে আসে। বাংলার ইতিহাসে আর কোন ব্যক্তিকে নিয়ে কাব্যগাথা, গান, কবিতা, ছড়া, সভা-সমাবেশ, মিলাদ-মাহফিল, স্মৃতি-স্মারক, এত বেশী রচিত হয় নাই। তাইতো অধ্যাপক আবুল ফজল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। বিরল নেতৃত্বগুণ, সম্মোহনী শক্তি, অসাধারণ বাগ্মিতা, ভাব-প্রকাশের নিজস্ব ধরণ তাকে সর্বকালের মহানায়কে পরিণত করেছিল। এই মহান নেতার মৃত্যু তাকে আরো বেশী-বাঙালির হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। ১৯৭৫ এর ২৮ আগস্ট তারিখে লন্ডনের ‘দি লিসনার’ পত্রিকায় বি বি সির সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারন এই জঘণ্য হত্যাকান্ডের সমালোচনা করে বলেন, “বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে উচ্চতর আসনে অবস্থান করবেন। তাঁর বুলেট-নিক্ষিপ্ত বাসগৃহটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং কবরস্থানটি পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে”। তাঁর মৃত্যু শোক নয়, শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাঁকে চিরঞ্জীব মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্যেই বেঁচে থাকুন বঙ্গবন্ধু, বেঁচে থাকুক বাংলাদেশ।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,
ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম