‘কোনো বিরোধী দল পাকিস্তানে না থাকায় সরকার গনতন্ত্রের পথ ছেড়ে একনায়কতন্ত্রের দিকে চলছিল দেশ। সর্বময় ক্ষমতার মালিক লিয়াকত আলী কোনো সমালোচনাকেই পাত্তা দিচ্ছিলেন না। ওই সময় একুশজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বের করে দিল এবং রাজশাহী জেলা ত্যাগ করার জন্য সরকার হুকুম দিল। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রসংগঠনগুলো কোন সভা করলেই একদল গুন্ডা ভাড়া করে এনে লেলিয়ে দেওয়া হতো তাঁদের পেটানোর জন্য।
ওইসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে যাই একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে লাখো মানুষের প্রিয় শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আমাকে বলেন, মুজিব বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হযে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরই দেশে শুরু হয় নিপীড়ন নির্যাতন। আর সেই নিপীড়ন নির্যাতনের রোষানলে পড়েন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। ৪৭’ থেকে ভাষা আন্দোলন, কেমন ছিল সেদিনের উত্তাল দিনগুলি। তা উঠে এসেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীমূলক বই ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে। নিচে সে দিনগুলি চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
অসমাপ্ত আত্নজীবনী
আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলাম। প্রায় সকল কলেজ ও স্কুলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। বিভিন্ন জেলায়ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠতে লাগল। সরকারি ছাত্র সংগঠনটি শুধু খবরের কাগজের মধ্যে বেঁচে রইল। ছাত্রলীগই সরকারের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছিল। কোন বিরুদ্ধ দল পাকিস্তানে না থাকায় সরকার গনতন্ত্রের পথ ছেড়ে একনায়কত্বের দিকে চলছিল। প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান সর্বময় ক্ষমতার মালিক হলেন। তিনি কোনো সমালোচনাই সহ্য করতে পারছিলেন না।
দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্তু তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত। এদের আমি বলতাম, “জনসাধারণ চলেছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারন আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।” তারা তলে তলে আমার বিরুদ্ধাচারণও করত, কিন্তু ছাত্রসমাজকে দলে ভেড়াতে পারত না।
এই সময় সরকারি কলেজে ছাত্রদের উপর খুব অত্যাচার হল। এরা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের সভ্য ছিল। একুশজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বের করে দিল এবং রাজশাহী জেলা ত্যাগ করার জন্য সরকার হুকুম দিল। অনেক জেলায় ছাত্রদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছিল এবং গ্রেফতার ও করা হয়েছিল । ১৯৪৯ সালে জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরেও ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেলের ভেতর দবিরুল ইসলামকে ভীষণভাবে মারপিট করেছিল- যার ফলে জীবনের তরে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছিল। ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে “জুলম প্রতিরোধ দিবস” পালন করার জন্য একটা কমিটি করেছিল। একটা দিবসও ঘোষণা করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় জেলায় এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ছাত্রবন্দিদের ও অন্যান্য বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হয় এবং ছাত্রদের উপর হতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করা হয়।
এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। তখনকার দিনে আমরা কোনো সভা বা শোভাযাত্রা করতে গেলে একদল গুন্ডা ভাড়া করে আমাদের মারপিট করা হয় এবং সভা ভাঙার চেষ্টা করা হয়। জুলুম প্রতিরোধ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ও কিছু গুন্ডা আমাদানি করা হয়েছিল। আমি খবর পেয়ে রাতেই সভা করি এবং বলে দেই, গুন্ডামির প্রশ্রয় দেওয়া হলে এবার বাধা দিতে হবে। আমাদের বিখ্যাত আমতলায় সভা করার কথা ছিল, কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মাঠে মিটিং করলাম । একদল ভাল কর্মী প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে রেখেছিলাম, যদি গুন্ডারা আক্রমন করে তারা বাধা দিবে এবং তিন দিক থেকে তাদের আক্রমন করা হবে যাতে জীবনে আর রমনা এলাকায় গুন্ডামি করতে না আসে এই শিক্ষা দিতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় সরকারি দল প্রকাশ্যে গুন্ডাদের সাহায্য করত ও প্রশ্রয় দিত। মাঝে মাঝে জগন্নাথ কলেজ, মিটফোর্ড ও মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা শোভাযাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা করলেই হঠাৎ আক্রমন করে মারপিট করত। মুসলিম লীগ নেতারা একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছিল যাতে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে না পারে। সুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না, যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিলেন সেই পন্থাই তাদের উপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুন্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনোদিন সফল হয় নাই , আর হতে পারে না- এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করে নাই।
এই সময় ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার কৃষঞনগরে জনাব রফিকুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেন-কৃষ্ঞনগর হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন করার জন্য। আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য জনাব এন,এম,খান পিএসপি তখনকার ফুড ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টার জেলারেল ছিলেন, তাকেই নিমন্ত্রন করা হয়েছিল, তিনি রাজিও হয়ে হয়েছিলেন। সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ গান গাইবেন। আমাকেও নিমন্ত্রন করা হয়েছিল। জনার এন এম খান পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে এই মহকুমায় এসডি ও হিসাবে অনেক ভাল কাজ করার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম এন এম খান ও আব্বাস উদ্দিন সাহেবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাস উদ্দিন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারন তার গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তার গান ছিল বাংলার জনগনের প্রানের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তার নাড়ির সম্বন্ধ। দুঃখের বিষয় , সরকারের প্রচার দপ্তরে তার মত গুনী লোকের চাকরি করে জীবিকা অর্জন করতে হয়েছিল। সভা শুরু হল, রফিকুল হোসেন সাহেবের অনুরোধে আমাকেও বক্তৃতা করতে হল। আমি জনার এন এম খানকে সম্বোধন করে বক্তৃতায় বলেছিলাম, আপনি এদেশের অবস্থা জানেন। বহুদিন বাংলাদেশে কাজ করেছেন, আজ ফুড ডিপার্টমেন্টোর ডিরেক্টর জেনারেল আপনি, একবার বিবেচনা করে দেখেন এই দাওয়ালদের অবস্থা এবং কি করে এরা বাচবে ! সরকার তো খাবার দিতে পারবে না-যখন পারবে না, তখন এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেছে কেন? দাওয়ালদের নানা অসুবিধার কথা বললাম, জনসাধারণকে অনুরোধ করলাম, স্কুলকে সাহায্য করতে। জনাব খান আশ্বাস দিলেন তিনি দেখবেন, কিছু করতে চেষ্টা করবেন। তিনি সন্ধ্যায় চলে যাবার পর গানের আসর বসল। আব্বাস উদ্দিন সহেব, সোহরার হোসেন ও বেদারউদ্দিন সাহেব গান গাইলেন। অধিক রাত পর্যন্ত আসর চলল। আব্বাস উদ্দিন সাহেব ও আমরা রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতে রইলাম । রফিক সাহেবের ভাইরাও সকলেই ভাল গায়ক। হাসনাত, বরকত ও ভাল গান গাইত। এরা আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল। আমার সাথে জেল ও খেটেছে। পরে দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল , নদীর ঢেউগুলি যেন তার গান শুনছে। তারই শিষ্য সোহরার হোসেনও বেদার উদ্দিন তার নাম কিছুটা রেখেছিলেন, আমি আব্বাস উদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বললেন মুজিব বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিটার ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হযে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্ট করেছিলাম।
আমরা রাতে ঢাকা এসে পৌছলাম। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে যেয়ে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে। নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা বহুদিন পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করেছে একথা আমার জানা ছিল। এরা আমার কাছেও এসেছিল। পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন এটাই পূর্ব বাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়ে নাই। তাদের সারা দিন ডিউটি করতে হয়। পূর্বে বাসা ছিল, এখন তাদের বাসা প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কারণ নতুন রাজধানী হয়েছে, ঘড়বাড়ির অভাব। এরা পোশাক পেত , পাকিস্তান হওয়ার পরে কাউকেও পোশাক দেওয়া হয় নাই। চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা ও ছিল না। ইচ্ছা মত তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামত চাকরি দিত।
আমি তাদের বলেছিলাম, প্রথমে সংঘবদ্ধ হোন, তারপর দাবিদাওয়া পেশ করেন, তা না হলে কর্তৃপক্ষ মানবে না। তারা একটা ইউনিয়ন করেছিল, একজন ছাত্র তাদের সভাপতি হয়েছিল। আমি আর কিছুই জানতাম না। জেলায় জেলায় ঘুরছিলাম। ঢাকা এসে যখন শুনলাম, এরা ধর্মঘট করেছে তখন বুঝতে বাকি থাকল না, কর্তৃপক্ষ এদের দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। তবু এত তাড়াতড়ি ধর্মঘটে যাওয়া উচিত হয় নাই। কারণ, এদের কোন ফান্ড নাই। মাত্র কয়েকদিন হল প্রতিষ্ঠান করেছে। কিন্তু কি করব, এখন আর উপায় নাই। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, ছাত্ররা এদের প্রতি সহানুভূতিতে ধর্মঘট শুরু করেদিয়েছে। কর্মচারীরা শোভযাত্রা বের করেছিল। ছাত্ররাও করেছিল। আমি কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের কাছে দেখা করতে যেয়ে তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকল কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবেন ঠিক করেছেন। বিকেলে আবার ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপিদের নিয়ে সাক্ষাৎ করলাম এবং অনুরোধ করলাম । এই কথা বলে যে, আপনি আশ্বাস দেন ওদের ন্যায্য দাবি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করে দিতে চেষ্টা করবেন এবং কাউকে চাকড়ি থেকে বরখাস্ত করবেন না এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে গ্রহন করবেন না। অনেক আলোচনা হয়েছিল, পরের দিন তিনি রাজি হলেন,। আমাদের বললেন, আগামীকাল ধর্মঘট প্রত্যাহার করে চাকরিতে যোগদান করলে কাউকেও কিছু বলা হবে না এবং আমি কর্তৃপক্ষের কাছে ওদের ন্যায্য দাবি মানাতে চেষ্টা করব।
আমরা তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম, তখন বিকাল তিনটা বেজে গিয়েছে। আমরা ওদের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে ঘোষনা করলাম,কাল তিনটা থেকে ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে। কারন বহু কর্মচারী কর্মচারী ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে, ভাইসচ্যান্সেলরের আশ্বাস পেয়ে তারা রাজি হয়েছে। অনেক কর্মচারী দুরে দুরে থাকে সকলকে খবর দিতে হবে। যতদুর সম্ভব, পরের দিন ছাত্ররাও ক্লাসে যোগদান করেছে। কর্মচারীরাও অনেকেই যোগদান করেছে। যারা বারটার মধ্যে এসে পৌছাতে পেরেছে, তাদের কর্তৃপক্ষ গ্রহন করেছে। আর যারা বারটার পরে এসেছে তাদের যোগদান করতে দেওয়া হয় নাই। অনেককে খবর পেয়ে নারায়নগঞ্জ থেকেও আসতে হয়েছিল। শতকরা পঞ্চাশজন কর্মচারী দেরি করে আসতে বাধ্য হয়েছিল,কারন বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর দিয়ে তাদের আনাতে হয়েছিল। আমাকে ও আমার সহকর্মীদের কাছে কর্মচারীরা এসে সব কথা বলল। একে একে আবার সকলে জড়ো হল। আমরা মিথ্যেবাদী হয়ে যাবার উপক্রম। সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে আবার আমরা ভাইস-চ্যান্সেলারের বাড়িতে উপস্থিত হলাম এবং বললাম , কি ব্যাপার? তিনি বললেন, আমি যখন আগামীকাল কাজে যোগদান করতে বলেছি তার অর্থ এগারটায় যোগদান করতে হবে, এক মিনিট দেরি হয়ে গেলে তাকে নেওয়া হবে না। আমরা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তিনি বুঝেও বুঝলেন না। এর কারণ ছিল সরকারের চাপ। আমরা বললাম সমান্য দু এক ঘন্টার জন্য কেন গোলমাল সৃষ্টি করলেন? তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না, আমরা তাকে আরও বললাম, আপনি পূবেই তো বলতে পারতেন, এগারটার মধ্যে যোগাদান করতে হবে। আপনি তো বলেছিলেন আগামীকালের মধ্যে যোগদান করলে চলবে। তিনি আর আলোচনা করতে চাইলেন না। আমরা বলে এলাম তাহরে ধর্মঘটও চলবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র-কর্মচারীদের যুক্ত সভা হল। সভায় আমি সমস্ত ঘটনা বললাম এবং আগামীকাল থেকে ছাত্র-কর্মচারীদের ধর্মঘট চলবে, যে পর্যন্ত না এদের ন্যায্য দাবি মানে। শোভাযাত্রা হল, আবার পরের দিন সকাল এগারটায় শোভাযাত্রা শুরু হবে বলে ঘোষনা করা হল। এবার আমাকে সক্রিয় অংশগ্রহন করতে হল। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ও শিক্ষাবিদ সরকারের চাপে এই রকম একটা কথার মারপ্যাচ করতে পারে এটা আমার ভাবতেও কষ্ট হয়েছিল। রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সভার পরে ঘোষনা করল, বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হল। হল থেকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চলে যেতে হবে। আর যে সমস্ত কর্মচারী ধর্মঘটে যোগদান করেছে তাদের বরখাস্ত করা হল। আমি সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সেই মুহুর্তে সভা ডাকা হল এবং সভায় ঘোষনা করা হল, হল ত্যাগ করা হবে না, ফজলুল হক হলেও সন্ধায় এই ঘোষনা করা হল। একটা কমিটি করা হয়েছিল,কর্মচারীদের জন্য একটা ফান্ড করা হবে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে টাকা তুলে সাহায্য করা হবে। কারন এদের প্রায় সকলেরই বিশ ত্রিশ টাকার বেশি বেতন পেত না। সংসার চালাবে কি করে? এদের মধ্যে কয়েকজনকে টাকা তোলার ভার দেওয়া হয়েছিল।
পরদিন দেখা গেল শতকরা পঞ্চাশজন ছাত্র রাতে হল ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। তার পরদিন আরও অনেকে চলে গেল। তিন দিন পর দেখা গেল আমরা ত্রিশ-পয়ত্রিশজন সলিমুল্লাহ হলে আছি আর বিশ পচিঁশজন ফজলুল হক হলে আছে। পুলিশ হল ঘেরাও করে রেখেছে। এক কামরায় আলোচনা সভায় বসলাম। আমাদের পক্ষে আর পুলিশকে বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না। সকলে একমত হয়ে ঠিক হল, হল ত্যাগ করার এবং নিম্ন কর্মচারীদের জন্য টাকা তুলে সাহায্য করা, তা না হলে তারও ধর্মঘট চালাতে পারবে না। চারদিন পরে আমরাও হল ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম এবং চাদা তুলে এদের সাহায্য করতে লাগলাম। দশ পনের দিন পর দেখা গেল এক একজন কর্মচারী বন্ড দিয়ে কাজে যোগদান করতে শুরু করেছে। এক মাসের মধ্যে প্রায় সকলেই যোগদান করল। ধর্মঘট শেষ হয়ে গেল। এই সময় আমি ও কয়েকজন কর্মী দিনাজপুর যাই। কারন কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে জেলে রেখেছে এবং দবিরুল ইসলামকে জেলের ভিতর মারপিট করেছে। ১৪৪ জারি ছিল। বাইরে সভা করতে পারলাম না। ঘরের ভিতর সভা করলাম। আমরা হোস্টেলেই ছিলাম। আবদুর রহমান চৌধুরী তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল। আমরা যখন ঢাকা ফিরে আসলাম বোধহয় আবদুল হামিদ চৌধুরী আমার সাথে ছিল। ট্রেনের মধ্যে খবরে কাগজে দেখলাম, আমাদেরসহ সাতাশজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করেছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদ,মোল্লা জালালউদ্দিন (এখন এডভোকেট) , আবদুল হামিদ চৌধুরীকে চার বৎসরের জন্য আর অন্য সকলকে বিভিন্ন মেয়াদে। তবে এই চারজন ছাড়া আর সকলে বন্ড ও জরিমানা দিলে লেখা পড়া করতে পারবে। মেয়েদের মধ্যে একমাত্র লুলু বিলকিস বানুকে বহিস্কার করা হয়েছিল। তিনি ছাত্র লীগের মহিলা শাখার কনভেনর ছিলেন। এক মাসের মধ্যে প্রায় সকল কর্মচারীই গোপনে গোপনে কাজে যোদগান করল। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ , ছাত্ররা নাই। এই সুযোগে কর্তৃপক্ষ নিম্ন বিতনভোগী কর্মচারীদের মনোবল ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল।
এই সময় বাইরে পুরানা লীগ কর্মী ও নেতারা আলাপ আলোচনা শুরু করেছে কি করা যাবে? একটা নতুন দল গঠন করা উচিৎ হবে কি না? আমার মত সকলকে বললাম, শুধুমাত্র ছাত্র প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করা যায় না। সরকারী মুসলিম লীগ ছাড়া কংগ্রেসেরও একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে গনপরিষদে ও পূর্ব বাংলা আইনসভায় এদের কয়েকজন সভ্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এদের সকলেই হিন্দু, এরা বেশি কিছু বললেই রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হত। ফলে এদের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামারও ভয় ছিল। কংগ্রেসকে মুসলমান সমাজ সন্দেহের চোখে দেখত। একজন মুসলমান সভ্যও তাদের ছিল না। এদিকে মুসলিম লীগের পুরানা নামকরা নেতারা সকলেই সরকার সমর্থক হয়ে গিয়েছিল। মন্ত্রিত্ব,পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি কিছু না কিছু অনেকের কপালেই জুটেছিল। নামকরা কোনো নেতাই আর ছিল না যাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন সদ্য আসাম থেকে চলে এসেছেন। তাকে পূর্ব বাংলার জনসাধারন তেমন জানত না। শুধু ময়মনসিংহ , পাবনা ও রংপুরে কিছু কিছু লোক তার নাম জানত। কারণ তিনি আসামেই কটিয়েছেন। তবে শিক্ষিত সমাজের কাছে কিছুটা পরিচিতি ছিলেন। একজন মুললিম লীগের নেতা হিসাবে তিনি আসামের বাঙ্গাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন এবং জেল ও খেটেছেন। টাঙ্গাইলের লোকেরা তাকে খুব ভালবাসত।
শামসুল হক সাহেব তাকে ভালভাবে জানতেন। কারণ, হক সাহেবের বাড়িও সেখানে। তিনিও মওলানা সাহেবের সাথে পাকাপাকি আলোচনা করবেন ঠিক হল। পূর্বেও তিনি পুরানা মুসলিমলীগ কর্মীদের সভায় যোগদান করেছিলেন। কিছুদিনের জন্য আসাম গিয়েছিলেন। ফিরে আসলেই আমরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করব ঠিক হল। সীমান্ত প্রদেশের পীর মানকী শরীফ একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তার নাম দিয়েছেন আওয়ামী মুললিম লীগ। সীমান্ত প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী খান আবদুল কাইয়ুম খান মুসলীম লীগ থেকে পুরানা কর্মীদের বাদ দিয়েছেন এবং অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়েছেন। অনেক লীগ কর্মীকে জেলে দিতেও দ্বীধাবোধ করেন নাই। গাফফার খান ও ডাক্তার খান সাহেবের মোকাবেলা করতে পারেন নাই। ফলে সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন হয়। একমাত্র পীর মানকী শরীফই লাল কোর্তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমলীগ দাড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবু পীর সাহেবের জায়গাও মুসলিম লীগে হয় নাই। পীর মানকী শরীফ সভাপতি এবং খান গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর সাধারন সম্পাদক হয়ে আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করা করেন।
সূত্র : বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী