জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনকালে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসিলম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের কথা মনে রেখে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের লেবাসধারী একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর অপতৎরতার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধকালে শান্তি, কল্যাণ ও মানবতার ধর্ম ইসলামের অপব্যাখ্যা করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকগোষ্ঠী, হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর-দালালেরা মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম-বিরোধী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অমুসলিম আখ্যা দেয়। তারা স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করে, চালায় নারী নির্যাতন। অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়; আর তথাকথিত ‘গনীমতের’ মাল হিসেবে লুট করে মুক্তিকামী মানুষের সম্পদ-সম্পত্তি।
অথচ এসবই ছিল সম্পূর্ণ ইসলাম-বিরোধী, সম্পূর্ণ হারাম বা অবৈধ। মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামের তথাকথিত ধ্বজাধারীদের এহেন ঘৃণ্য অপকর্ম সবাইকে হতবাক ও স্তম্ভিত করে দেয়। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে, ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা যেসব ঘৃণ্য অপকর্ম সংঘটিত করে এদেশের মাটিতে, তা পবিত্র ইসলামের শুভ ললাটে কালিমা লেপন করে দেয়। এই কালিমালিপ্ত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই জাতির জনক ইসলাম প্রচার-প্রসারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমার সুষ্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে করীম (স.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলাম বিরোধী আইন পাশের কথা ভাবতে পারেন তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফারস্থা করে তোলার কাজে।”
ইসলামের বিধানের প্রতি জাতির জনকের অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ এবং কুরআন সুন্নাহ-বিরোধী আইন পাশের বিপক্ষে তার অনমনীয় ও সুদৃঢ় অবস্থানের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে তার উল্লিখিত বক্তব্যে। তার এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে ইসলামের চিরন্তন কল্যাণকারী বৈশিষ্ট্য ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু তার এ ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (স.)-এর ইসলাম, ইসলামের সুমহান শিক্ষা; অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ইসলামের আপোসহীন অবস্থান; প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও মোনাফেকির বিরুদ্ধে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। স্বাধীনতার পরও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে একই ধরনের প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা আমরা শুনতে পাই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ওই দিনই তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক বিশাল সমাবেশে ঘোষণা দেন, “বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না ...এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।”
এর কিছুদিন পর বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল-বদর পয়দা করা বংলার বুকে আর চলবে না।”
ইসলামী আদর্শ মূল্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক ব্যাখ্যা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু এত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য প্রদান করা সত্তেও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এবং ইসলামের লেবাসধারী স্বার্থান্বেষী ওই মহলটি বঙ্গবন্ধুর উদার রাজনৈতিক দর্শন এবং তার দল আওয়ামী লীগকে ইসলাম-বিরোধী বলে অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতির জনক ধর্মকে কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাননি। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের নিজ নিজ ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যে তার আজীবন লালিত বিশ্বাসেরই প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি স্বভাবসুলভ দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেন:
“ধর্ম নিরেপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের দর্ম-কর্ম করার নিজ নিজ অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্ম চর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবও না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি হলো এই যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার উৎস ছিল মদীনা সনদের সেই শিক্ষা, যেখানে উল্লেখযোগ্য শর্ত ছিল- মদীনায় ইহুদি-নাসারা, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন একজন খাঁটি বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন ঈমানদার মুসলমান। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে যে নির্বাচনী অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, সেই অঙ্গীকার তিনি তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। তিনি অঙ্গীকার ভঙ্গ বা ধোঁকাবাজির রাজনীতি করতেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে, পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও হিমাদ্রিস্পর্শী এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।
তিনি যদি তার অতীতের সব অঙ্গীকার বিস্মৃত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুনভাবে সব কাজ শুরু করতেন, তবু তার বিরুদ্ধে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবার সাহস পেতো না। কিন্তু ঈমানদার ব্যক্তি কখনই তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। বঙ্গবন্ধুও জীবনে একটি বারের জন্যও অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। এ দৃঢ় মানসিকতার জন্য তাকে সারা জীবন জেল-জুলুম ও অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে শতকরা ৯৫ জন মুসলমানের দেশে ইসলাম-বিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না বলে তিনি যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সেই প্রতিশ্রুতি পালনে তিনি বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনমানসে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত বিরল। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:
* ইসলামকি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা।
* জাতীয় পর্যায়ে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) পালন।
* বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন (পূর্বে স্বায়ত্তশাসিত মাদ্রাসা বোর্ড ছিল না)।
*বিশ্ব এজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জায়গা বরাদ্দ।
* কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জমি বরাদ্দ।
* হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা।
* ঈদে মিলাদুন্নবী (সা), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা এবং উল্লিখিত দিনগুলোতে সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান।
* মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান।
* রেসকোর্স ময়দানের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধকরণ।
* রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা।
* আরব-ইসলাঈল যুদ্ধে আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ।
* ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি।
১. বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা
১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্টে এ প্রতিষ্ঠানের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় তা হচ্ছে:
(ক) মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমি ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।
(খ)মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমি ও ইনস্টিটিউট এবং সমাজ সেবায় নিবেদিত সংগঠনসমূহকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া।
(গ) সংস্কৃতি, চিন্তা, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদানের ওপর গবেষণা পরিচালনা।
(ঘ) ইসলামের মৌলিক আদর্শ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায় বিচার প্রভৃতি প্রচার করা ও প্রচারের কাজে সহায়তা করা এবং সাংস্কৃতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ এর সুপারিশ করা।
(ঙ) ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আয় ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণার আয়োজন করা ও তা প্রসার ঘটানো এবং জনপ্রিয় ইসলামি সাহিত্য সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলির সুলভ প্রকাশনা ও বিলি-বণ্ঠনকে উৎসাহিত করা।
(চ) ইসলাম ও ইসলামের বিষয় সম্পর্কিত বই-পুস্তক, সাময়িকী ও প্রচার পুস্তিকা অনুবাদ করা, সংকলন করা ও প্রকাশ করা।
(ছ) ইসলামের ইতিহাস ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আয় ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদির ওপর সম্মেলন, বক্তৃতা, বিতর্ক ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা।
(জ) ইসলামবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পুরষ্কার ও পদক প্রবর্তন করা।
(ঝ) ইসলাম সম্পর্কিত প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া, প্রকল্প গ্রহণ করা কিংবা তাতে সহায়তা করা।
(ঞ) ইসলামবিষয়ক গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান করা।
(ট) বায়তুল মুকারাম মসজিদের ব্যবস্থাপনা ও উন্নতি সাধন করা।
(ঠ) উপরোক্ত কার্যাবলির যে কোনোটির ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক বা আপতিত সব কাজ সম্পাদন করা।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ সংস্থা হিসেবে নন্দিত। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এ যাবত পবিত্র কুরআনের বাংলা তরজমা, তাফসীর, হদীস গ্রন্থের অনবুাদ, রাসূল (সো)-এর জীবন ও কর্মের ওপর রচিত ও অনূদিত গ্রন্থ, ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী আইন ও দর্শন, ইসলামী অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহাবী ও মনীষীগণের জীবনী ইত্যাদি নানা বিষয়ে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থ শুধু বাংলাদেশের পাঠকদের কাছেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। এ প্রতিষ্ঠান ঢাকস্থ প্রধান কার্যালয়সহ সারা দেশের ৬৪টি জেলা কার্যালয়, আর্ত-মানবতার সেবায় ২৮টি ইসলামিক মিশন, সাতটি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমীর মাধ্যমে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। বৃহত্তম কলেবরে ২৮ খণ্ডে ইসলামী বিশ্বকোষ, ১২ খণ্ডে সীরাত বিশ্বকোষ প্রকাশ করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু যে অসামান্য অবদান রেখেছেন এজন্য জাতি তার কছে চির কৃতজ্ঞ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনকালে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসিলম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের কথা মনে রেখে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
২. জাতীয় পর্যায়ে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা) পালন
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম হাক্কানী আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে পবিত্র ইসলামের সঠিক রৃপ জনগণের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সীরাত মজলিশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সীরাত মজলিশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাযতুল মুকাররম সমজিদ চত্বরে মাহফিলের উদ্বোধন করেন।
একজন সরকার প্রধান হিসেবে জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিলের উদ্বোধন উপমাহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকাতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রতিবছর জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা) মাহফিল উদযাপন হয়ে আসছে।
৩. হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা
পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোন সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন।
৪. মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন
ইসলামি আকিদা ভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন। পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্ত্বশাসিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করে এর নাম রাখেন “বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড”।
৫. বেতার ও টিভিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রচার
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত ও তাফসীর প্রচার শুরু হয়। ফলে, বেতার ও টিভির অনুষ্ঠান সকালের সূচনা ও দিবসের কর্মসূচি কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত এ ব্যবস্থাই বাংলাদেশে চালু রয়েছে।
৬. ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা।
ইসলামের ধর্মীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। উল্লিখিত দিনসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন।
৭) মদ, জুয়া, হাউজ ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান করা।
ইসলামে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অবাধে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান জারি করেন।
৮) ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতা নিষিদ্ধকরণ
পাকিস্তানি আমলে ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। সেখানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতার নামে চলত জুয়া, হাউজি ও বাজিধরা প্রতিযোগীতা। এই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে বাজিতে হেরে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যেতো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতা বন্ধ করেন এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের প্রিয় নবী (স) বৃক্ষরোপণের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যদি মনে কর আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি বৃক্ষের চারা রোপন কর।” মহানবী (স) এর এই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে রেসকোর্স ময়দানের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি সেখানে বৃক্ষরোপণ করে সেই স্থানের নাম রাখেন “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।” ঢাকা মহানগরীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষরাজি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবহণ করে চলেছে।
৯. বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জায়দা বরাদ্দ
তাবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামের পথে দাওয়াত দেওয়াই হচ্ছে এ সংগঠনের একমাত্র কাজ। এই সংগঠনটি যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দাওয়াতি কাজে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার তাবলীগী ভাই এ জামাতে সমবেত হন। বঙ্গবন্ধু টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার এই স্থানটি বরাদ্দ করেছিলেন বলেই ইজতেমায় আগত লক্ষ লক্ষ মুসলিম এখানে সমবেত হয়ে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
১০) কাকরাইলের মারকাজ মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ।
বর্তমানে কাকরাইলের যে মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলীগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এ মসজিদটি ছিল খুবই অপ্রশস্ত। বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের তাবলীগ জামাতের মারকাজ মসজিদের জন্য স্থান বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তারই নির্দেশে সম্প্রসারিত হয়।
১১. রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা
রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিস্ট দেশ। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে তাবলীগ জামাতের যেসব দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১২) আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আবর বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখর চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে এক লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করা হয়।
১৩) ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা সমুন্নত হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে।
এভাবে পর্যলোচনা করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে বিপুল অবদান রাখেন, গোটা পৃতিবীতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। তবু ইসলামের লেবাসধারী একটি গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে, যা এখনও চলছে-নানা কৌশলে, নানা আঙ্গিকে।
(ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত)