আহসান হাবিব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, কেউ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়নি- এমন প্রচার চলেছে বেশ কিছু দিন। এ অপপ্রচার তারাই চালিয়েছে যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। এ অপরাধ তারাই করেছিল, যারা বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির মন থেকে মুছে ফেলার জন্য সামরিক বিধি জারি করেছিল যাতে 'জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া কোনো প্রকার ব্যক্তিপূজার উদ্রেক বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য প্রচার অথবা বিকাশ' সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। যারা সামরিক আইন জারি করে বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল, সংবাদপত্র-বেতার-টেলিভিশনকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলেছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনের সহযোগী আলবদর-রাজাকারদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল- তাদের কাছ থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়। খুনিচক্র জাতির পিতা এবং তার পরিবারের নারী-শিশুসহ সকল সদস্যকে হত্যা করেছিল। জেলখানায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছিল। শত শত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। এ সবের প্রতিবাদ হচ্ছে, সেটা কেন তারা জনগণকে জানতে দেবে?
বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। এখন ইতিহাসের অনেক সত্য বের হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামরিক আইনের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে শোক মিছিল গেছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে আনুষ্ঠানিক শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকায় হরতাল পালিত হয়েছে। এ সবই আমরা জানতে পারি নূহ-উল-আলম লেনিন ও অজয় দাশগুপ্তের 'বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড :প্রতিবাদের প্রথম বছর' গ্রন্থ থেকে। দু'জনেই সে সময়ে জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। তারা ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত করেছেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০০১ সালে, এ বছর বইমেলায় এসেছে বর্ধিত সংস্করণ, যাতে নিষ্ঠুর দমননীতির পরিবেশেও কীভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে তার বিবরণ রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন দলের প্রকাশ্যে ও গোপনে প্রচারিত লিফলেট, বুকলেট ও অন্যান্য প্রকাশনা। পাঠক ও গবেষকরা এ থেকে সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে পারেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতার প্রামাণিক দলিল এ গ্রন্থের মূল্যবান সম্পদ। সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের উদ্যোগে 'ইস্পাত' নামে যে পত্রিকাটি গোপনে প্রকাশিত হয়েছিল, তার তিনটি সংখ্যার কয়েকটি লেখা গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল বিচারপতি সায়েম ও জিয়াউর রহমানের সরকার। 'ইস্পাত' সে খবরটি প্রকাশ করেছিল। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য ছাত্রসমাজ বিভিন্নম্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে মিলাদ মাহফিল। দুটি কর্মসূচিতেই সামরিক শাসকদের দিক থেকে প্রবল বাধা আসে। কিন্তু সব বাধা জয় করে সফল হয় কর্মসূচি। এ গ্রন্থ থেকে আমাদের জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্বের দালিলিক বিবরণ পাওয়া যাবে, সন্দেহ নেই যা আকর উপাদান হিসেবে গণ্য হবে।