শেখ আদনান ফাহাদ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেও ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের ‘স্বাধীনতা ও মুক্তি’ ও স্বাধীনতা অর্জনের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্মৃতিচারণ করে শেখ মুজিব স্বয়ং বলেছেন, ৭ মার্চ তারিখেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’।
ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সেই ভাষণে জাতির জনক উচ্চারণ করেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়- প্রত্যেক ইউনিয়নে- প্রত্যেক সাবডিভিশনে – আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।' এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; জয় বাংলা।’
'আপনারা আমার উপরে বিশ্বাস নিশ্চই রাখেন- জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারেনাই। ফাঁসিকাষ্ঠে আসামী দিয়েও আমাকে নিতে পারেনাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমাকে একদিন জেলের থেকে বাইর করে নিয়ে এসেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম - আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্ত ঋণ শোধ করব - মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মিটিং এইখানেই শেষ। আসসালামু আলাইকুম। জয় বাংলা।'
৭ই মার্চ স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ঘোষণা দেয়ার পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নিয়মিতভাবে মানুষকে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানিয়ে গেছেন। সবাইকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য তাগাদা দিয়েছেন।
সাত মার্চের আগেও নানা ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য আলাদা রাষ্ট্র কায়েমের কথা বলেছেন। যেমন ৪ মার্চ, ১৯৭১ সালের সংবাদ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (বুধবার) বৈকালে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণদানকালে মিলিটারি প্রত্যাহার ও জনতার হাতে ক্ষমতা না দেওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার খাজনা-কর না দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।
সে ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ছয়টা হতে দুপুর দুইটা পর্যন্ত লাগাতার হরতালেরও ঘোষণা দেন। স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর গুলিবর্ষণসহ নানাবিধ অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানানো ছাড়াও উনি ৭ই মার্চ কী বলতে পারেন তারও একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ৩ মার্চের সেই ভাষণে। সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ মুজিব সেদিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘৭ তারিখের মধ্যে সরকারি মনোভাব পরিবর্তন না হইলে রেসকোর্সে আমি আমার ভাষণ দিয়া দিব’।
পাকিস্তানী শাসকদের ধমক দিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মনে রাখিবেন, বাংলার ৭ কোটি মানুষকে গুলি করিয়া মারা যাইবেনা। আর যদি মারেন, তাহলে আমরাও মারিব। যাহারা আমার জন্য জীবন দিয়াছিল, আমি জানি, আমি মরিলে আমার আত্মা দেখিতে পাইবে যে বাংলা স্বাধীন হইয়াছে, বাংলার মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রহিয়াছে’।
আবগেজড়িত কণ্ঠে সেদিন বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যু হইলেও আমি আপনাদের সহিত বেঈমানি করিতে পারিব না। রক্ত দিয়া হইলেও আমি আপনাদের ঋণশোধ করিব’।
সংবাদের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে ১০ মার্চ এক সভায় বসার আমন্ত্রণও বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখান করেন। ইয়াহিয়ার সাথে সেই সভায় বসার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ রাস্তায় রাস্তায় যখন শহীদদের রক্ত শুকায় নাই, যখন লাশ সৎকারের অপেক্ষায় পড়িয়া রহিয়াছে এবং হাসপাতালে যখন শত শত লোক মৃত্যুর সহিত লড়াই করিতেছে, তখন এই আমন্ত্রণ একটি নিষ্ঠুর তামাশা ছাড়া আর কিছুই নহে। অতএব, আমি এইরুপ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিলাম’।
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ঘোষণা করেন,-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সরকারি অফিস, আদালতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ই মার্চ এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘মুক্তির লক্ষ্য বাস্তবায়িত ও স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচিয়া থাকার অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাংলা দেশের মানুষ সংগ্রাম ও সব কিছু ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ় সংকল্প থাকিবে’।
১৪ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আন্দোলন চলবে, হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। সংবাদপত্রে বিবৃতি আকারে ছাপানো সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর আত্মমর্যাদার সাথে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই’।
ইয়াহিয়া খান, বঙ্গবন্ধুর সাথে তৃতীয় দফায় আলোচনায় বসেন ১৮ মার্চ, ১৯৭১ সালে। আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে ১৮ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ সাংবাদিকদের সাথে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথন পুরোটাই ছেপে দেয়। বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক তাঁকে একের এক প্রশ্ন করতে থাকেন। এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে’। তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আমি কি আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি?’
সাংবাদিকদের সাথে আলোচনার শেষ পর্যায়ে শেখ মুজিবকে খুব প্রফুল্ল দেখা যায়। তখন এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘অ্যা হাসি থেকে আমরা কোন কিছু ধরে নিতে পারি? পূর্বদেশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ আমি সবসময়েই হাসতে পারি এবং এমন কি জাহান্নামেও হাসতে পারি’।
স্বাধীনতা অর্জনে বিদেশি সাহায্য চেয়েছেন কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ আমার প্রয়োজন নেই। পাট, চা, ইত্যাদিসহ আমাদের যা প্রয়োজন বাংলাদেশে তা আছে’।
কী নাই, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারই শুধু বাঙালিদের নাই’।
৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, সেদিনই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা এক অর্থে দিয়ে দিয়েছিলেন। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সে স্বাধীনতার ঘোষণাই আবার আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত আকারে পুনরায় দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার সংগ্রাম কথাটা বলেই ক্ষান্ত হননি, মুক্তির সংগ্রামের কথাটাও যোগ করেছিলেন। যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধুর মনে মুক্তির সংগ্রামের তাৎপর্য লুকানো ছিল’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘৭ই মার্চ তারিখেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। স্বাধীনতাকামী মানুষের বোঝার বাকি ছিলনা, বঙ্গবন্ধু কী চাইছেন। ৭ই মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে, ডিফেক্টো ডেক্লেরেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ’।
নিজে স্বাধীন বাংলাদেশে একাধিকবার সাত মার্চের ভাষণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে মূল্যায়নধর্মী বক্তব্য দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। যেমন ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘গত ৭ই মার্চ (১৯৭১) তারিখে আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের ওপর আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈয়ার করো। আমি বলেছিলাম যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো। আমি বলেছিলাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার লোকেরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলেই সংগ্রাম করেছে’।
শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা স্থানে সামরিক হামলা চালায় পাকিস্তানী বাহিনী। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানী বাহিনী। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন।
তার ইপিআর-এ দেয়া ঘোষণপত্র ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স এজেন্সি তাদের প্রকাশিত দলিলে তুলে ধরেছে- শেখ মুজিবই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ১২.৩০ মিনিটে এ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তাদের এই দলিলে বহুজন সিনেটের স্বাক্ষর আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২.৩০ মিনিট অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই শেখ সাহেব ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করার কিছুক্ষণ পরই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস তাদের বৈকালিক সংস্করণে এই ঘোষণাপত্র ছাপিয়ে লিখেছিল “পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্র টাইম ২.৩০ মিনিট (দুপুর) এ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।”
বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন ৩.৩০ মি (রাত) আর তার কয়েক ঘণ্টা আগে অর্থাৎ রাত ১২.৩০ মিনিটে ঘোষণা প্রদান করেন। তার স্বাক্ষরিত ঘোষণাপত্র ইপিআরের (বিডিআর ও পরবর্তীতে বিজিবি) ওয়্যালেসের মাধ্যমে সারাদেশের সরকারি প্রশাসন ভবন ও ফ্যাক্সের মাধ্যমে লিখিত আকারে প্রচার করা হয়। ২৭ মার্চ সকাল থেকেই রেডিওতে বার বার এটি পড়ে শুনানো হয় ।
২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র দখল করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। সেখানে বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মেজর জিয়া বলেছিলেন, ‘ আমি মেজর জিয়া, আমাদের মহান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়