|| মারুফ রায়হান ||
কবিতাপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির সুনাম রয়েছে। এর নেপথ্যের সত্যটি এই- বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। তার আবেগমথিত উচ্চারণ অনেক সময়ই কবিতাধর্মী হয়ে ওঠে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরপর্বে ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নয়নের মণি। তিনি নিজেও কি কবি নন?
রাজনীতির কবি তিনি। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ কবিতারই মতো স্পষ্ট ও সংকেতময়, দ্রোহ ও দেশপ্র্রেমের রসে সিক্ত। তাঁকে নিয়ে কবিতা রচিত হতে থাকে সাতই মার্চের বহু আগে থেকেই। তবে সত্য প্রকাশের দায়বোধ থেকে আমাদের বলতেই হবে, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে সপরিবারে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পরই তাঁর প্রতি নিবেদিত কবিতা সহস্র ফল্গুধারায় লিখিত হতে থাকে; এ যেন জাতির সকরুণ অশ্রুরই বাঁধভাঙা জোয়ার।
স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবকে বহু মাত্রায় মহিমান্বিত করার পরিবর্তে তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্যে শোক প্রকাশই মুখ্য হয়ে ওঠে। বাঙালির ঘরে স্বাধীনতার ফসল এনে দেয়ার আগে যুগ যুগ ধরে তাঁর লড়াই ও আত্মত্যাগের বিষয়টি ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে শোকাভিভূত বিলাপ। বস্তুত মুজিবহত্যার বিচারের বিষয়টি স্থগিত থাকার বাস্তবতায় শোক ও ক্রোধই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। বহু বিলম্বে বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলে, এবং পরবর্তীকালে বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার ভেতর দিয়ে সেই পুঞ্জিভূত শোক ও ক্রোধ কিছুটা সান্ত্বনা লাভ করে। সেইসঙ্গে শব্দে ও ছন্দে নেতার চরিত্রচিত্রণের ধরন ও চারিত্র্যেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে।
একটু আগেই বলেছি, বাঙালির আবেগমথিত উচ্চারণ অনেক সময়ই কবিতাধর্মী হয়ে ওঠে। কিন্তু সার্থক কবিতা রচনার জন্যে আবেগ নিয়ন্ত্রিত রাখতে হয়, শিল্পরসের যোগান দিতে হয়। শিল্পের যুক্তি গ্রহণে অপারগ থাকে ভাবাবেগ। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে কবিতার মতো পঙ্ক্তি রচনার জন্যে ছন্দের সুষমা, ভাষার বৈভব কী দরকার? এমনটা বহুজনই মনে করেছেন। অন্তত তাদের কবিতা পাঠ করেই এমনটা ধারণা হয়েছে। নব্বই দশকের প্রথমার্ধে ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনার সূত্রে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাই। দেখেছি শত শত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী প্রিয় নেতার উদ্দেশে কবিতা লিখে নিজেই চলে এসেছেন পত্রিকা অফিসে ছাপানোর দাবি নিয়ে। মানহীন ও দুর্বল রচনা কীভাবে উত্তম নৈবেদ্য হতে পারে নেতার করকমলে!
আপনি যদি সত্যিকারের শিল্পী না হন, সুরের ওপর যদি আপনার দখলই না থাকে, আর কণ্ঠস্বরটি যদি শ্রুতিসুখকর না হয় তাহলে আপনার গান কি শ্রবণযোগ্যতা পাবে? আমাদের সৌভাগ্য যে সেইসব পদ বা পদ্য রচয়িতাকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাতর্পণের জন্যে কিছু রচনার প্রয়াসী হওয়া প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু সেসবের প্রকাশযোগ্যতার জন্যে জরুরি শিল্পবিচার। তাতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে নিজেকে উপযুক্ত করে নেয়াটাই আবশ্যক।
কথাগুলো এজন্যেই বলা যে, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদতি গ্রন্থবদ্ধ সহস্র কবিতার ভেতর খুব সামান্যই প্রকৃত অর্থে বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতার প্রতিকৃতি অঙ্কনে শিল্পসফল হয়েছে। তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে যত পঙ্ক্তি রচিত হয়েছে তার নেপথ্যে যে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আবেগ কাজ করেছে তা সত্যিই মূল্যবান। মানুষের হৃদয়ের ধ্বনির ওপরে তো আর কিছু হতে পারে না। আর ভালোবাসা আপনা আপনি সৃষ্টি হয় না। আমাদের প্রায় সকল প্রধান কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। এসব রচনা বাংলাদেশের সময় ও ইতিহাসেরই শিল্পিত প্রকাশ। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই অবধারিতভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণের নামই চলে আসে। একাত্তর পূর্ববর্তী স্বাধিকার আন্দোলনের কালে তিনি ‘হুলিয়া’ কবিতায় আকস্মিকভাবে উচ্চারণ করেছিলেন-
‘শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’
এই প্রশ্নটি বাঙালি মননের অবচেতনে কখনও না কখনও নিশ্চিতরূপেই গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছিল। কবি একাধারে সত্যদ্রষ্টা ও সত্য-উচ্চারণকারী। আমরা লক্ষ্য করে দেখব এই কবি শেখ মুজিবকে উপজীব্য করে যে কয়টি কবিতা রচনা করেছেন তার ভেতরে রয়েছে সত্যের শক্তি ও সৌন্দর্য।
সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণদানের ঘটনাটিকে কবিতায় গেঁথে রেখেছেন নির্মলেন্দু গুণ যা পাবে দীর্ঘায়ু। দৃঢ় ঋজু শিল্পিত ভাস্কর্যের মতোই দীর্ঘস্থায়ী এই শব্দ-ভাস্কর্য। সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে নানাকৌণিক ভাষ্য ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়ে চলেছে ফি-বছর। কিন্তু এই একটি মাত্র কবিতা শ্রোতা বা পাঠকের কাছে যেভাবে দৃশ্যটি রচনা করে দেয় এবং তার ভেতরকার সারসত্য তুলে ধরে তা শত পাতার গদ্যও স্পষ্ট করে তুলতে অক্ষম। এখানেই কবিত্বশক্তি এবং কবিতা আঙ্গিকটির জয়ডঙ্কা বেজে ওঠে।
মাত্র আটটি চরণসম্বলিত কবিতা লিখে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতাভাণ্ডারে বিশেষ আসনটি পাকাপোক্তভাবে অর্জন করে নিয়েছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। কবিতাটি রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়ছে।
যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/ গৌরি যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান।
আগেই বলেছি দেশের সকল প্রধান কবিই কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলেছেন; বিশেষ করে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর- এই তিন দশকে আবির্ভূত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিগণ অকৃপণভাবেই মুজিব বন্দনা করেছেন। এঁরাই পঁচাত্তরপূর্ব এবং পঁচাত্তর পরবর্তী পর্বে তাঁদের কবিতায় শেখ মুজিবের কথা মমতা ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। এসকল কবির জীবনাভিজ্ঞতার ভেতরেই ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। তবে এটা অস্বীকারের উপায় নেই, পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর আমরা আর তেমনভাবে শেখ মুজিবের কথা উচ্চারিত হতে শুনিনি। উল্লেখিত প্রথম তিন দশকে উত্থিত কবিদের কণ্ঠে প্রবলভাবেই ধ্বনিত হয়েছিলেন মহান নেতা। এর পরবর্তী তিন দশকের কবিদের ভেতর সেই ধারাটি অনেকখানিই অনুপস্থিত। পঁচাত্তরের পরে দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার অপপ্রয়াস শুরু হয়; সে ছিল এক ইতিহাস বিকৃতির কাল। নবীন কবিরা বিভ্রান্ত হয়ে থাকবেন।
যে-মৃত্তিকায় দাঁড়িয়ে তরুণ কবি লিখে চলেছেন আধুনিক কবিতা, সেই তরুণদের বড় অংশের মধ্যেই দেখা গেছে স্বাধীনতার স্থপতিকে স্মরণ করা ও সম্মান জানানোর ব্যাপারে উদাসীনতা। এটাও মানতে হবে যে নিজ রচনার ক্ষেত্রে কবি অবশ্যই স্বাধীন। পাশাপাশি এটাও আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে, দেশ কাল ও জাতির প্রতি কবির দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধ থেকে স্বাধীনতার সপক্ষে কবিতাকে প্রাণিত রাখা সমীচীন। আর স্বাধীনতার কথা মুক্তিযুদ্ধের কথা উচ্চারণ করতে গেলে মহাকালের মহানায়ককে বিস্মৃত হওয়া চলে না।
এ রকম একটি বাস্তবতায় আকস্মিকভাবে কবিদের মধ্য থেকে একজন মহাকাব্য রচনার প্রয়াসী হয়ে লিখে ফেলেন ‘প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু’। গ্রিক পুরাণের চরিত্রের প্রতীকে ইতিহাসের মহানায়ককে চিত্রিত করার কৌশল আমরা দেশের সবচাইতে খ্যাতিমান কবি শামসুর রাহমানের ভেতর প্রত্যক্ষ করেছি। ‘ইলেকট্রার গান’ কবিতায় মুজিব ও মুজিবদুহিতাকে কালের প্রেক্ষাপটে সহজেই শনাক্ত করা যায়। কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা যাক:
‘মাথার ভেতরে ঝোড়ো মেঘ ওড়ে, আমি একাকিনী
পিতৃভবনে, আমার কেবলি শোক পালনের পালা।
পিতৃহন্তা চারপাশে ঘোরে, গুপ্তচরের
চোখ সেঁটে থাকে আমার ওপর, আমি নিরুপায় ঘুরি
নিহত জনক, এ্যাগামেনন, কবরে শায়িত আজ।’
এই দীর্ঘ কবিতাটি রচিত হয়েছে ছয় মাত্রার প্রবহমান মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। মোস্তফা তোফায়েলের ‘মহাকাব্য’ নামাঙ্কিত ‘প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু’ লেখা হয়েছে অমিত্রাক্ষর ছন্দে। এই কাব্যটির আলোচনা করেছেন শামস হক। খানিকটা উদ্ধৃত করছি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করেই:
‘প্রমিথিউস বঙ্গবন্ধু কাব্যে আছে সর্গ বিভাজন। কালিদাসের বিখ্যাত মহাকাব্য মেঘদূত অবলম্বনে পূর্বমেঘ, উত্তরমেঘ নামীয় দু’টি অংশও আছে এ কাব্যটিতে। প্রতীয়মান হয় যে, এর রচয়িতা এটিকে মহাকাব্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।’
কাব্যটির স্বাদ বোঝাতে উল্লেখ করছি কয়েকটি লাইন:
‘ভারত মহাসাগর পার হয়ে পাবে
নিম্নচাপে রুদ্ধশ্বাস বঙ্গোপসাগর,
তীরে যার বঙ্গদেশ। অগ্নি লেলিহান
শাল তমাল তাল বিজল হিজল।
বৃক্ষরাজি সর্বব্যাপী অগ্নিশোভাময়
জ্বলছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে আদিগন্ত সব
শত্রু তাড়িয়ে দিতে। সেখানে গিয়েই
তোমার বিষম গতি, বিদ্যুচ্চমক,
গম্ভীর সংঘর্ষ, নাম্বুনিনাদ
চরম উৎকর্ষ পাবে। তুমি যোগ দেবে
যুদ্ধে, সেখানে গিয়ে। সহায়ক হবে
বাংলাদেশের সেই মানুষের প্রতি।’
লেখক : কবি, সাংবাদিক