|| মিনার মনসুর ||
ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের ঐতিহাসিক বাড়িটির সামনে এখন তুমুল ব্যস্ততা। ধোয়ামোছার কাজ চলছে। সেই সঙ্গে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটি। ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। বহু বাধার বিন্ধ্যাচল পার হয়ে, প্রতীক্ষার দীর্ঘ রক্তাক্ত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, দিনটি এখন জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। রাষ্ট্রপতি আসবেন। প্রধানমন্ত্রী আসবেন। আসবেন প্রজাতন্ত্রের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। রাষ্ট্র অবনত চিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে তার প্রতিষ্ঠাতার প্রতি। জনতার ঢল নামবে ধানমন্ডি ও টুঙ্গীপাড়ায়। দেশের আনাচে কানাচে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে তাঁর বজ্রকণ্ঠ বাণী। সংবাদপত্রগুলো ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে চলবে শোকের মাতম।
আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি ৩২ নাম্বারের রাস্তায়। লোকজনের ছুটোছুটি দেখি। লেকের পাড় ঘেষে স্থাপিত তাঁর আবক্ষ ছবিটি দেখি। চোখ বেয়ে নেমে আসে লোনা জলের ধারা। আমি কিছুতেই তা ঠেকিয়ে রাখতে পারি না। শোকে শুধু নয়, অনির্বচনীয় আনন্দেও মানুষ কাঁদে। একি তবে আনন্দাশ্রু? জানি না। আমার কেবলই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী দুর্বহ সেই দিনগুলোর দুঃসহ মর্মযাতনার কথা মনে পড়ে যায়। সেই বেদনা সেই শূন্যতা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই আগস্টের আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন দেখে সেইসব আগস্টের পর্বতপ্রমাণ দীনতা ও অসহায়ত্ব কল্পনা করাও কঠিন বৈকি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখন বই ও সংকলনের ছড়াছড়ি। দেশে-বিদেশে তাঁর নামে গড়ে উঠছে নিত্যনতুন সংগঠন। ভক্ত-অনুরাগীর আকাশস্পর্শী উচ্ছ্বাস চারপাশে। কখনও কখনও তা স্বাভাবিকতার সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সর্বস্তরের মানুষের এই যে আবেগ-উচ্ছ্বাস তার সবটাই স্বার্থগন্ধবর্জিত- এমন বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। ফলে জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত আবেগের সঙ্গে হয়তো স্বার্থগন্ধী কিছু কিছু আতিশয্যও যুক্ত হচ্ছে। ভারী হচ্ছে অতিভক্ত ও স্তাবকের কাফেলা। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ও তাই হয়েছে। কিন্তু সপরিবারে তিনি নিহত হওয়ার পরের দৃশ্যপট ছিল একেবারেই অন্যরকম। ঘটনার আকস্মিকতায় সাধারণ মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল এটা সত্য। তবে সর্বক্ষণ যারা তাঁকে ঘিরে থাকতেন, স্তাবকতার মধু বর্ষণ করতেন তাঁর কানেÑ তাদের অনেকের বেলায় এ কথা খাটে না। চরম দুঃসময়ে তারা শুধু মুখ ফিরিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত হননি, সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত এই মহান নেতার বিরুদ্ধে বিরামহীন বিষোদ্গারের পাশাপাশি জঘন্য অপপ্রচারেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন প্রকাশ্যে। এটাই বোধ করি কিছু মানুষের জন্য নিয়ম। সুসময় যেমন ভক্ত-সমর্থকের বাঁধভাঙা ঢল নিয়ে আসে, তেমনি দুঃসময়ও একা আসে না। শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিশাল ডালা ভরে নিয়ে আসে খা খা শূন্যতা।
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা আরও বিভীষিকাময়। একদিকে সেনা শাসনের রক্তচক্ষু, অন্যদিকে ঘাতকের সদম্ভ উল্লাস। মনুষ্যরক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো তারা তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে জনপদে। নারী ও শিশুসহ অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের রক্তে স্নাত তাদের হাত। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করেও নিরস্ত হয়নি হিংস্র এ ঘাতকের দল, বাংলার মাটি থেকে তাঁর অস্তিত্ব মুছে ফেলার ভয়ংকর খেলায়ও মেতে উঠেছিল তারা। এমন একটা আবহ তৈরি করেছিলো যে, বঙ্গবন্ধু যেন নিষিদ্ধ এক নাম। তাঁর নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্রই ছুটে আসে রক্তলোলুপ হায়েনার পাল।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একমাস পর এমনই এক চরম বৈরি পরিবেশে শুরু হয় আমার কলেজ জীবন। এই পরিবেশের ভয়াল ছায়া বিস্তৃত হয়েছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও। নিষেধের রক্তচোখ সর্বক্ষণ আমাদের তাড়া করছিল। ভীতি আর আতঙ্ক ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। রাজনীতির সঙ্গে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম না। ঝোঁক ছিল সাহিত্যের দিকে। যৎসামান্য লেখালেখিও করতাম। সেই সূত্রে সারা দেশের লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল আমার। স্বঘোষিত ঘাতকদের এ বর্বরতা, এ ঔদ্ধত্যের রক্তচোখ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমরা।
মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কিছু একটা করার জন্যে আমরা তখন টগবগ করে ফুটছিলাম। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু কথাবার্তা হলেও কী করবো, কীভাবে করবো তার কোনো কুলকিনারা পাচ্ছিলাম না। এ সময়ে অভিনব এক আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে আসেন আমাদের এক বড়ভাই। তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে (১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট) আমরা ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত একটি গানের পঙ্ক্তি সংবলিত এক পৃষ্ঠার একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করি। সেই পঙ্ক্তি হলো- ‘বলো কী তোমার ক্ষতি/জীবনের অথৈ নদী/পার হয় তোমাকে ধরে/দুর্বল মানুষ যদি।’
প্রচারপত্রের অর্ধেকটা জুড়ে ছিল কাঠের ব্লকে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ একটি ছবি। তার নিচে ৩৬ পয়েন্ট টাইপে এই পঙ্ক্তি ছাপা হয়েছিল। গোপনে বিলি করা প্রচারপত্রটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে আমাদের হাতে আসে কবি নির্মলেন্দু গুণের সেই অসামান্য কবিতাটি- ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি’। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতাটির শত শত কপি গোপনে মুদ্রিত করে আমরা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেই। এ দুটি ঘটনা শুধু যে আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল তা-ই নয়, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো আমরা প্রতিবাদের সর্বোত্তম পথটিও পেয়ে যাই। সেই শুরু।
‘বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদাৎ বার্ষিকী স্মরণিকা’ হিসেবে ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট আমরা প্রথম প্রকাশ করি ‘এপিটাফ’। এ নামকরণের মূলেও ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষাদময় পটভূমি। ডিমাই ১/৮ সাইজের ৪০ পৃষ্ঠার এ সংকলনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৪টি প্রবন্ধ, একটি সম্পাদকীয় (পুনর্মুদ্রিত) এবং ১২টি কবিতা ছাপা হয়। প্রচ্ছদে তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় কিছু বাণী। পরের বছরই আমরা প্রকাশ করি ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রতিবাদী কবিতা ও ছড়া সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ প্রকাশিত হয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্বল্প পরিসরের এ-প্রকাশনাটি তখন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রতিবাদী তরুণ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে প্রায় একই সময়ে আরও কিছু স্মরণিকা-সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে সারা দেশে। তবে আমার জানা মতে, পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ই হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম স্মারক সংকলন। সর্বমোট ১৩২ পৃষ্ঠার এ-স্মারকগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে। বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা এটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু যে-প্রেসে সংকলনটি ছাপার কাজ চলছিল শেষ মুহূর্তে সেখানে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু হওয়ায় এর প্রকাশনা একমাস পিছিয়ে যায়। তবে আমাদের উদ্দেশ্য আশাতীত সফল হয়েছিল।
আমাদের জানা মতে, তখন কোনো গ্রন্থই পাঁচশ কপির বেশি ছাপা হতো না। আমরা সাহস করে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’-এর বারোশ পঞ্চাশ কপি ছেপেছিলাম। প্রকাশের মাত্র এক মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল সবক’টি কপি। তার পরও চাহিদা ছিল বিপুল। সারা দেশ থেকে অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কপির জন্যে আমাদের ক্রমাগত তাগাদা দিয়েছেন। অগ্রিম টাকাও পাঠিয়েছেন অনেকে। দেশের বাইরে থেকেও আমরা বহু চিঠি পেয়েছি। তার মধ্যে আমেরিকার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’-এর চিঠিও ছিল। তারাও বেশকিছু কপি কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু কড়া গোয়েন্দা নজরদারির কারণে কোনো প্রেসই গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করতে রাজি হয়নি। পরে অবশ্য ১৯৯৮ ও ২০১০ সালে গ্রন্থটির আরও দু’টি ঢাউস সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তবে স্মারকগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশের অভিজ্ঞতা আমাকে আজও শিহরিত করে।
আমাদের মধ্যে তীব্র ক্রোধ ছিল এ কথা সত্য। ছিল ঘাতকদের প্রতি পর্বতপ্রমাণ ঘৃণা। কিন্তু ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ কোনো তাৎক্ষণিক আবেগের ফসল ছিল না। বহু বিনিদ্র রাত আমরা উৎসর্গ করেছি এর পেছনে। আমাদের সাধ ছিল আকাশচুম্বী। প্রথমে আমরা ভেবেছি, বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবো বাংলা ও ইংরেজিতে। আমাদের বন্ধু কবি কামাল চৌধুরীও (বর্তমান জনপ্রশাসন সচিব) ছিলেন এ-পরিকল্পনার অন্যতম ভাবসঙ্গী। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাধ্য আমাদের ছিল না। ফলে আমরা আমাদের ভাবনার বৃত্তকে সংকুচিত করে ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ প্রকাশে উদ্যোগী হই। আমাদের প্রাথমিক চিন্তা ছিল, বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সকল বিবেকবান মানুষের প্রতিবাদ ও ঘৃণাকে একত্রে সংকলিত করে গ্রন্থাকারে তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা। আমাদের পথ যে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তা বলা বাহুল্য মাত্র।
গ্রন্থটি প্রকাশের উত্তেজনায় আমরা এতোটাই আচ্ছন্ন ছিলাম যে, শুরুতে টাকার কথা আমরা একবারও ভাবিনি। এ কারণে পরে আমাদের অনেক ভুগতেও হয়েছে। কিন্তু আমরা তা গ্রাহ্য করিনি। লেখার জন্যে লেখক, কবি ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিয়েছি। চট্টগ্রাম থেকে এসে দিনের পর দিন ঢাকায় পড়ে থেকেছি। ঢাকার পথঘাট ভালো চিনতাম না। অগ্রজ কবীর আনোয়ার (চলচ্চিত্র নির্মাতা), কবিবন্ধু জাফর ওয়াজেদ, রেজা সেলিম ও মুজাহিদ শরীফকে নিয়ে খ্যাত-অখ্যাত প্রায় সব বুদ্ধিজীবী ও লেখকের দরোজার কড়া নেড়েছি। অভিজ্ঞতা তিক্ত-মধুর। প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী ও সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনসহ কেউ কেউ সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। কেঁদেছেন শিশুর মতো। আবার অনেকে মুখের ওপর দরোজা বন্ধও করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুগ্রহভাজন ব্যক্তির সংখ্যাও কম ছিল না। তবে আমরা হাল ছেড়ে দেইনি। আমাদের সৌভাগ্য যে অন্নদাশঙ্কর রায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাও আমরা পেয়েছিলাম।
‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলাম আমি ও আমার সহপাঠী দিলওয়ার চৌধুরী। আমরা উভয়ে তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছিলেন ক্ষ্যাপাটে তরুণ কবি ও শিল্পী খালিদ আহসান। প্রচ্ছদের বিষয়বস্তু ছিলÑ লাল পটভূমিতে কালো একটি পাথর। সেই পাথর ফুঁড়ে ফুটে আছে একটি গোলাপ। এটা ছিল স্বদেশের রক্তাক্ত বুকের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদের একটি প্রতীকী রূপ। শেষ প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত বঙ্গবন্ধুর সৌম্য একটি ছবি। গ্রন্থটির নাম নিয়ে আমাদের মধ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দ্বিধা ছিল। আমি চেয়েছিলাম কড়া প্রতিবাদী একটি নাম দিতে। আমার পছন্দের একটি শিরোনাম ছিল ‘আবার যুদ্ধে যাবো’। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। দেশকে রাহুমুক্ত করতে হলে আমাদের আরও একটি মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।
পরে ১৯৮০ সালের ১৫ আগস্টে আমরা ‘আবার যুদ্ধে যাবো’ নামেও একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করি। এতে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবদুল মতিন চৌধুরী, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, দেবদাস চক্রবর্তী, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, আলী আকসাদ, রাহাত খান, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আলী যাকের, আবদুল জব্বার, কবীর আনোয়ার ও কবি কামাল চৌধুরীসহ অনেক বিশিষ্ট জনের স্বাক্ষর সংবলিত প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়। আমার বিশ্বাস, এই বুলেটিনটি বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে প্রকাশিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম একক কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হয় এপিটাফ প্রকাশনী থেকে। মহাদেব সাহার সাড়া জাগানো এই গ্রন্থটি আমরা প্রকাশ করি ১৯৮২ সালে। চার ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত অনেক কবিতা তখন প্রতিবাদী তরুণদের মুখে মুখে ফিরতো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’। বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করা এই গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াতে হয় আমাকে। দেশে তখন লে. জে. এরশাদের স্বৈরশাসন। সামরিক শাসনের কোপানলে পড়ে মাঝপথে থেমে যায় আমাদের এ প্রতিবাদী প্রকাশনার উদ্যোগ। তবে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র পরিসরে ‘ভয় হতে অভয় মাঝে’ শিরোনামে আমাদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা দেশে। সেদিনের সামান্য চারাগাছটি পরিণত হয়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অসামান্য এক মহীরুহে।
minarmonsur@gmail.com
লেখক : কবি