মহাজীবনের কারাভাষ্য


|| পিয়াস মজিদ ||

...আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’! 
(পৃষ্ঠা: ২০৯, কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান)

১৭ই মার্চ ১৯৬৭-তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দায়ের করা ১১ মামলার আসামী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৪৭তম জন্মবার্ষিকীতে লিখেছেন এই একান্ত অনুভবের কথা। ইতিহাসের আশ্চর্য কাকতাল-  এর ঠিক ৫০ বছর পর ২০১৭-এর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর বর্ণময় জীবনের কারাপঞ্জি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করল বাংলাদেশের জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান-  বাংলা একাডেমি। ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা জানাচ্ছেন, এই গ্রন্থের নামকরণ বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহানার। সদ্যপ্রকাশিত কারাগারের রোজনামচা শেখ মুজিবপত্নী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সরবরাহকৃত ৪টি খাতায় লেখা কারাভাষ্যের গ্রন্থরূপ। এই গ্রন্থটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২)’র দ্বিতীয় খণ্ড নয়; এটি বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ নতুন গ্রন্থ। শেখ হাসিনা তাঁর ভূমিকায় আরও জানাচ্ছেন শীঘ্রই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯৫৭-এর চীন সফর নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দু’টি পৃথক বই প্রকাশিত হবে।

১৯৫৮-এর ১২ অক্টোবর সামরিক আইন জারিপূর্বক শেখ মুজিবকে কারাবন্দি করা হয়। ’৫৮-৬০ কালপর্বের রোজনামচা ‘থালা বাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল’ শিরোনামে গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ১৯৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং একই বছরের ৮ই মে পুনরায় গ্রেফতার হন। ’৬৬-এর ২ জুন থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর এবং ১৯৬৭-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুনের কারালিপি পরপর দুটো খাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৮-এর ১৮ জানুয়ারি কারামুক্তির অব্যবহিত পর তাঁকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগেই তাঁর বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা’র ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। এই মামলায় বন্দি অবস্থার বিবরণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গ্রন্থের শেষাংশে।

স্মৃতিঘন ভূমিকায় শেখ হাসিনা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে এবং ১৯৮১-তে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে কীভাবে পিতার লেখার খাতা উদ্ধার করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন- তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। কারাগারের রোজনামচায় যে স্নেহময় পিতা তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা ‘হাসিনা’র পরীক্ষা, বিয়ে ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছেন সেই কন্যা শেখ হাসিনাই যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিয়োগান্ত মৃত্যুর পর তাঁর রাজনীতির হাল ধরবেন এবং এই গ্রন্থ প্রকাশে উদ্যোগী হবেন- একথা হয়তো শেখ মুজিব সেদিন চিন্তাও করেননি।

গ্রন্থের প্রারম্ভভাগেই শেখ মুজিব দার্শনিক প্রাজ্ঞতায় বলেছেন-

জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই- তারা জানে না জেল কি জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা। জনসাধারণ মনে করে চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি এক সাথে থাকে, তাহা নয়। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।
(পৃ. ২৭)

...সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয়- যাকে ইংরেজিতে বলে `Solitary Confinement’ তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।
(পৃ. : ৮৩)

আবার বলছেন সেই চিরকালীন স্বাধীন সত্তার কথা-

সোনার খাঁচায়ও পাখি থাকতে চায় না। বন্দি জীবন পশুপাখিও মানতে চায় না।
(পৃ. ১৮৩)


এখানে তিনি শুধু তাঁর নিজের কারাজীবনের স্মৃতিচারণ করেননি; একইসঙ্গে তখনকার কারাপ্রথা, সামগ্রিক কারাব্যবস্থা ও কারাবন্দিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এমন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন যা সহজেই হতে পারে কারাবিষয়ক গভীর গবেষণার উৎস। তিনি জেলের কিছু শব্দকোষের সন্ধান দিয়েছেন আমাদের, যেমন- রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড়ু দফা, বন্দুক দফা, পাগল দফা, শয়তানের কল, দরজি খাতা, মুচি খাতা, আইন দফা, ডালচাকি দফা, হাজতি দফা, ছোকরা দফা ইত্যাদি। জেলখানায় যারাই এসেছেন- সাংবাদিক মানিক মিয়া, রণেশ মৈত্র থেকে শুরু করে সাধারণ কয়েদি লুৎফর রহমান ওরফে লুদু- সকলের ব্যক্তিজীবন, পরিবার নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়েছেন এভাবে-

পাকিস্তানের ১৯ বৎসরে যা দেখলাম তা ভাবতেও শিহরিয়া উঠতে হয়। যেই ক্ষমতায় আসে সেই মনে করে সে একলাই দেশের কথা চিন্তা করে, আর সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী আরও কত কি! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রেখে অনেক দেশনেতাকে শেষ করে দিয়েছে। তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে, সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কতকাল এই অত্যাচার চলবে কেই বা জানে! এই তো স্বাধীনতা, এই তো মানবাধিকার! 
(পৃ. ১৮৪)

জেলে বন্দি অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিব বলছেন-

মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর ডাকাত পকেটমার হয়। আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না।
(পৃ. ৪৮)


তিনি যে আদ্যন্ত একজন পড়ুয়া মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ফরাসি ঔপন্যাসিক এমিল জোলা,  মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেনরি ডেভিড থরো কিংবা দুই প্রজন্মের বাঙালি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কিংবা শহীদুল্লা কায়সারের বইপত্র পাঠের প্রসঙ্গে-

বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালই... 
(পৃ. ৬৩) 

ভাবলাম রাতটা কাটাতেই কষ্ট হবে। কিন্তু কেটে গেল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকাইয়া ছিলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম ‘অন্ধকারের রূপ’, দেখতে পারলাম না। কারণ আমি শরৎচন্দ্র নই। আর তাঁর মতো দেখবার ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিও আমার নাই।
(পৃ. : ৮০)

ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলা-র লেখা ‘তেরেসা রেকুইন’ পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র- জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়।
(পৃ. ১০১) 

হেনরি ডেভিড থরোর ‘Civil disobedience’ রচনা উদ্ধৃত করে বলেছেন-

মনে রেখ থরোর কথা-`Under a government which impisons any unjustly, the true place for a just man is also a prison.’ 
(পৃ. ২২৫-২৬)

পাশাপাশি রবীন্দ্রপ্রেমী এক রাজনীতিকের দেখা পাবেন পাঠক, যে রাজনীতিক কারাবন্দি অবস্থায় কোনো হতাশ মুহূর্তে শরণ নেন ‘...বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ এমন রবীন্দ্র অভয়বাক্যের।

কারাগারে সীমিত সুযোগে গোগ্রাসে পত্রপত্রিকা পড়তেন তিনি। পত্রিকান্তরে ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট বক্তৃতা পাঠ করে তখনকার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর নামোল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন ‘শোয়েব সাহেব শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে ভোগের ব্যবস্থা রাখিয়াছেন। কিন্তু গরিব জনসাধারণ বোধ হয় আর আলো জ্বালাইয়া রাতের খাবার খেতে পারবে না।’ কারণ শেখ মুজিব জেনেছিলেন সে বাজেটে কেরোসিন তেলের উপর বাড়তি কর ধার্য হয়েছিল। সংবাদপত্রের সূত্রে যেমন দেশের পরিস্থিতি জেনেছেন তেমনি ভেবেছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়েও-

... আজ ইত্তেফাক ও ইত্তেফাক সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা, কাল আবার অন্য কাগজ ও তার মালিকের উপর সরকার হামলা করবে না কেন বলতে পারে!
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই, এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শোসকগোষ্ঠী কোন পথে নিয়ে চলেছে ভাবতেও ভয় হয়! আজ দলমত নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান উচিত।
(পৃ. ১৩৭)

এই দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের অন্যতম অধ্যায় বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলন সম্পর্কে জানা যাবে অনেক অজানা কথা, ৬ দফাকে নস্যাৎ করতে ‘৮ দফা’ নামে অন্য একটি আন্দোলন তৈরির অপচেষ্টার চাঞ্চল্যকর তথ্য বিধৃত করেছেন বঙ্গবন্ধু। ৬ দফা নিয়ে যে জনগণের মধ্যে জোয়ার তৈরি হয়েছিল সেটি কারান্তরীণ তার মাঝে সৃষ্টি করেছে নতুন আশার- 

আন্দোলন যে দল করবে, ত্যাগ যে দল করবে, তারাই জনগণের সমর্থন পাবে এবং শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় হবে। আওয়ামী লীগের যারা এখনও জেলের বাইরে আছে তারাই কাজ করে চলুক। দেখা যাক কি হয়। জনসমর্থন ছয় দফার আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে পারলেই হয়।
(পৃ. ১৮৫)


কারাগারে মায়ের অসুস্থতার সংবাদ শুনেছেন, পিতা-বিচ্ছিন্ন সন্তানদের হাহাকার প্রত্যক্ষ করেছেন। এমনও হয়েছে ১৮ মাসের শিশুপুত্র রাসেল জন্মের পর থেকে পিতাকে কারাগারে থাকতে দেখে কারাগারকে বলতো ‘আব্বার বাড়ি’। নিজের পরিবারের এমন পরিস্থিতিতেও কারাকুঠুরিতে রান্না করেছেন, সহ-কারাভোগীদের সুখ-দুঃখের জীবনকথা জেনেছেন আর সর্বক্ষণ ভেবেছেন গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক অধিকার আর দেশের সার্বিক মঙ্গলের কথা।

একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন বলেই কারাবন্দি মুজিবকে স্পর্শ করেছে প্রবল আন্তর্জাতিকতাবাদ। ভারতে কৃষ্ণ মেননের পদচ্যুতি, ভিয়েতনামের হ্যানয় ও হাই ফং-এ সাম্রাজ্যবাদী বোমাবর্ষণ, সুপ্রিম সোভিয়েত আলেক্সি কোসিগিনের বক্তব্য, চীনের বন্যা পরিস্থিতি, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া সম্পর্ক কিংবা কঙ্গোতে প্যাট্রিস লুমুম্বার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিভিন্ন দিনের ভুক্তিতে শেখ মুজিবের সুচিন্তিত মতামত লক্ষণীয়। ১৯৬৬-এর ১৪ জুলাই স্মরণ করেছেন ১৭৭তম ফরাসি বিপ্লব দিবস। লিখছেন-

১৭৮৯ সালের ১২ই জুলাই ফরাসি দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারি নগরীর জনসাধারণ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে। ১৪ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বৎসর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তাই কারাগারের এই নির্জন কুঠিতে বসে আমি সালাম জানাই সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের, যারা প্যারি শহরে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মুক্তিকামী জনসাধারণ এই দিনটার কথা কোনোদিনই ভুলতে পারে না।
(পৃ. ১৬১)

শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা সমাপ্ত হয়েছে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ‘একাকি বন্দি’ পরিস্থিতির বর্ননায়; যেখানে তাঁর কর্ত্যবরত চিকিৎসক বাঙালি হয়েও প্রশ্নের উত্তর দিত ইংরেজি বা উর্দুতে-

একজন বাঙালি ডাক্তার দেখতে আসতেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা। নাম মেজর সফিক (ডা.)। তিনি কখনও একাকী আমাদের কামরায় আসতেন না। সাথে ডিউটি অফিসারকে নিয়ে আসতেন। কখনও বাংলায় কথা বলতেন না। ইংরেজি বা উর্দু। আমি তার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি পূর্ব বাংলার লোক। বাংলায় আমি কথা বললে ইংরেজি বা উর্দুতে জবাব দিতেন। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, বোধ হয় বাংলা ভুলে গেছেন তাই উর্দু বলেন। তিনি বেহায়ার মত হাসতে লাগলেন। মনে হতো ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। পরে তার সম্বন্ধে জানলাম তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বিবাহ করেছেন। বাড়ির সাথে কোনো সম্বন্ধ নাই। নিজকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ভয় পান। যদি কেহ মনে প্রাণে বাঙালি হয় তবে তার ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ। এই ষড়যন্ত্র মামলা ইনকোয়ারী শুরু হওয়ার পরে যে কয়েকজন সামান্য বাঙালি কর্মচারী সামরিক বাহিনীতে আছেন তাদের অবস্থা বড় করুণ। কখন যে গ্রেপ্তার হবে কে বলতে পারে! তাই তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়।
(পৃ. ২৬৭) 

পাঠবুভুক্ষ শেখ মুজিব সেখানে কোনো বাংলা বই বা খবরের কাগজ খুঁজে পাননি। কিন্তু এভাবে বাংলা ও বাঙালিত্ব থেকে তাঁকে দূরে রাখার পাকিস্তানি প্রয়াস সফল হয়নি। তিনি নিজে কারামুক্ত হয়েছেন, নিজের প্রিয় দেশবাসীকে পরাধীনতার অন্ধকার কারা থেকে মুক্তি দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সোনার আলোয়।


নিপুণ ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টার মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২০ জুন ১৯৬৬-র দিনলিপি বাঙালি চরিত্রের এক অন্ধকার দিক ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা যে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তাঁর সাথেই সংঘটিত হবে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে; তা হয়তো তিনি কল্পনাও করেননি-

বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল।... এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এত উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা আর আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাঁচানো যাবে কিনা।
(পৃ. ১১২)

বাংলার লোকবয়ানে, সরল সহজ উপস্থাপনায় আর গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কারালিপির বিভিন্ন ভুক্তিতে নানা প্রসঙ্গে এমন অনেক মন্তব্য করেছেন যা সাময়িক পরিসর ছাপিয়ে হয়ে ওঠে স্মরণযোগ্য চিরায়ত বাক্যে। এমনই কিছু বক্তব্য :

১.    রক্তের পরিবর্তে রক্তই দিতে হয়। একথা ভুললে ভুল হবে। মতের বা পথের  মিল না হতে পারে, তার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিরুদ্ধ দলের বা মতের লোককে হত্যা করতে হবে এ বড় ভয়াবহ রাস্তা। এ পাপের ফল অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে। (পৃ. ৫৯)
২.     ডিকটেটররা যখন দরকার হয় খুব ব্যবহার করে, আর যখন দরকার ফুরিয়ে যায়, ছেঁড়া কাপড়ের মতো ফেলে দেয়। ছেঁড়া কাপড় তো অনেক সময় দরকারে লাগে, স্বৈরশাসকদের সে দরকারও হয় না। একদম বিদায়। টু শব্দ করার ক্ষমতা নাই। (পৃ. ৬৩)
৩.    এই দেশের মানুষ তারা ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। (পৃ. ৭৩)
৪.    জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে। (পৃ. ৭৪)
৫.    পরাধীন জাতির কপালে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা হয়েই থাকে। এতে আর নতুনত্ব কি? (পৃ. ৮৩)
৬.    আন্দোলন কখনও বাইরে থেকে আমদানি হয় না... পারমিটের টাকা দিয়া গণআন্দোলন হয় না। (পৃ. ১০০)
৭.     গলা টিপে মারো, তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি নাই। শুধু শোষণ বন্ধ কর। জনগণের অধিকার ফেরত দাও। (পৃ. ১৩১)
৮.   গুটিকয়েক লোকের সম্পদ বাড়লেই জাতীয় সম্পদ বাড়া হয় বলে যারা গর্ব করে তাদের সম্বন্ধে কি-ইবা বলব! (পৃ. ১৫৩)
৯.    জনসাধারণেরও আর ‘নেতাদের ঐক্যের’ ওপর বিশ্বাস নাই। জনগণের ঐক্যই প্রয়োজন। (পৃ. ১৭২)
১০.  শোষকের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই। একই ধর্মের বিশ্বাসী লোকদেরও শোষণ করে চলেছে ছলে বলে কৌশলে। (পৃ. ১৮৭)

কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থের পরিশিষ্টাংশে- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন পরিচয় (১৯৫৫-১৯৭৫)’, প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এনায়েতুর রহিম ও ড. জয়েস রহিম লিখিত ‘বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক পরিচিতিমূলক প্রবন্ধ, দিনলিপিতে উল্লেখিত সূত্রের টীকা এবং ১৯৬৬’র ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ও প্রচারিত ‘আমাদের বাঁচার দাবী ৬ দফা কর্মসূচী’ পুস্তিকার অনুলিপি এবং বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রাসঙ্গিক কিছু আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থাকারে প্রকাশ-নেপথ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে আরও যারা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ড. এনায়েতুর রহিম, ড. জয়েস রহিম, প্রয়াত লেখক- সাংবাদিক বেবী মওদুদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান প্রমুখ। ভূমিকা থেকে জানা যাচ্ছে ড. ফকরুল আলমের ভাষান্তরে এ গ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশিত হবে।


কারাগারের রোজনামচা পাঠ-শেষে শেখ হাসিনার মতো আমাদেরও মনে হয়েছে ‘এ ডায়েরি পড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাবে।’

 

SUMMARY

841-1.jpg