৪২ বছরেও যে-প্রশ্নের উত্তর পায়নি তরুণ প্রজন্ম


|| মিনার মনসুর ||  ২০১৭-০৮-১১ 

আমাদের ছেলে অদম্যর বয়স এখন ১৩। যখন ওর বয়স ৫ বছর তখনই একদিন সকালে নাশতার টেবিলে ও আচমকা প্রশ্ন করে বসেছিল- ‘বাবা, বঙ্গবন্ধুকে ওরা কেন মেরেছিল?’ এমন প্রশ্নের জন্যে আমরা তৈরি ছিলাম না মোটেও। তাই একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। এও উপলব্ধি করেছিলাম যে, পাঁচ বছরের একটি বাচ্চাকে বিষয়টি বোঝানো মোটেও সহজ নয়। তবু তার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্যে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।

কিন্তু তাতে অদম্য পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। যত দিন যায় ওর প্রশ্নের তালিকাও দীর্ঘ হতে থাকে। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে কারা মেরেছে- এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা যখন বলি যে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি তারাই তাঁকে হত্যা করেছে। তখনই সে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, ‘কেন মেরেছে?’ আমরা বলি, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন তাই। ‘তাহলে রাসেলকে মারলো কেন? ও তো কিছু করেনি?’ আমার মা তখন জীবিত ছিলেন। অদম্যর এ-সব প্রশ্ন শুনে তিনি হেসে বলতেন, তোরা ওর নাম ‘অদম্য’ রাখলি কেন? এখন তো ওকে দমানো যাবে না। আমরা হাসতাম।

অদম্য হয়তো একটু অন্যরকম। ওর কৌতূহলের ধরনও হয়তো আর দশটা শিশুর চেয়ে আলাদা। তবে এ-সব প্রশ্ন যে অদম্যর একার নয় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আমার মেয়ে আলোকিতা- বয়সে অদম্যর চেয়ে ৫ বছরের বড়ো। দেশি-বিদেশি নানা বই পড়ে। জটিল সব বিষয় সহজ করে ভাবতে পারে। অথচ তারও সেই একই প্রশ্ন। অবশ্য তার প্রশ্নের পরিধি আরও ব্যাপক। তার প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধুকে যখন মারলো, তোমরা তখন কী করেছো? যে-মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছে তারা তখন কী করেছে? কেন খুনিদের বিচারের জন্যে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হলো? তারা যদি বন্দুক হাতে জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে, শিশু হত্যা করতে পারে, গর্ভবতী নারী হত্যা করতে পারে, তা হলে তোমরা কেন তাদের ধরে গাছের ডালে কিংবা ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দাওনি? আলোকিতার ইচ্ছে ও ব্যারিস্টার হবে। ভাবী এ-ব্যারিস্টারের ক্রমাগত জেরার মুখে অপরাধীর মতো আমরা মাথা নত করে থাকি।

আসলে প্রশ্নগুলো শুধু অদম্য কিংবা আলোকিতার নয়; বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাপরবর্তী গত ৪১ বছরে যাদের জন্ম হয়েছে, সেইসব শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবক সবার মনেই লঘুচাপের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে এইসব প্রশ্ন। হয়তো একদিন তা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রকম্পিত করবে সমগ্র জনপদ। কারণ সেইসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব আজও তারা পায়নি। জবাব দেওয়ার গুরুদায়িত্বটি যাদের ওপর অর্পিত ছিল- সেই রাষ্ট্র, সেই সুশীল সমাজ, সেই নেতৃত্ব তা পালনে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছেন। কেন ব্যর্থ হয়েছেন- তার উত্তর খুঁজতে গেলে হয়তো ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়’ হওয়ার মতো অবস্থা হবে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে হয়, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’

উত্তর সন্ধানের চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। তার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। দীর্ঘ সময় নিয়ে এ বিচারের কাজ চলেছে। অদম্য-আলোকিতারা যে-প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় এবং যে-প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়ার জন্যে পঁচাত্তরের সেই ভয়ালরাত্রির পর থেকে বাংলাদেশ বিনিদ্র ব্যাকুল প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে, মাননীয় আদালতকেও অনিবার্যভাবে সেইসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁরা সাক্ষীদের বক্তব্য শুনেছেন। দলিল-দস্তাবেজ দেখেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদেরও মূল চ্যালেঞ্জ ছিল আদালতের সামনে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর উত্থাপন করা। বিচার শেষ হয়েছে। ঘাতকদের শাস্তি হয়েছে। সাজাও কার্যকর হয়েছে কয়েকজনের। কিন্তু অদম্য-আলোকিতা কি তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে? বিনা দ্বিধায় বলা যায়-না, তারা উত্তর পায়নি।

উত্তর দেওয়ার মূল দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। কিন্তু এ বর্বর হত্যাযজ্ঞ যখন সংঘটিত হয় রাষ্ট্র তখন সেই দায়িত্ব পালন তো করেই নি, বরং খুনিদের নিরাপদে দেশত্যাগে সহায়তা করেছে। বিদেশে তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের যাবতীয় খরচ জুগিয়েছে। সরকারি পদ-পদবি-পদোন্নতি শুধু নয়, সর্বোচ্চ সুরক্ষাও দিয়েছে। যতোভাবে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যায় সবই করেছে রাষ্ট্র। এমনকী ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে তাদের বিচারের পথও রুদ্ধ করে দিয়েছিল রাষ্ট্রের তৎকালীন দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৭৯ দিনের মধ্যে কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চারনেতাকে যে কাপুরুষোচিত পন্থায় হত্যা করা হয়েছে তার নেপথ্যেও ছিল রাষ্ট্রের নজিরবিহীন ইন্ধন।

মুখরক্ষার খাতিরে হয়তো বলা যায় যে, তখন এ-রাষ্ট্র তো ছিল ঘাতকদের দখলে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চিহ্নিত খুনিরা বঙ্গভবন দখল করে রেখেছিল এটা সত্য। কিন্তু সেটার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিনমাস। তাহলে ঘাতক হিসেবে যাদের সাজা হয়েছে তারা পালিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ ২১ বছর যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল, ঘাতকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল, বিচারের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের নাম-পরিচয় ও আদর্শ পর্যন্ত বদলে ফেলার চেষ্টা করেছিল- তারা কারা? তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো না কেন? কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতির পিতা ও দেশের রাষ্ট্রপতিকে খুন করে ফেললো এ কি পাগলেও বিশ্বাস করবে?

রাষ্ট্র মানে তো মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা নয়। বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত গোটা সশস্ত্র বাহিনী তখন কী করেছে? মর্যাদাজনক এ প্রতিষ্ঠানের কমান্ড বা নেতৃত্ব যাদের হাতে ছিল- তারাই-বা কী করেছেন? প্রশাসন, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশের ভূমিকাই-বা কী ছিল? কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনাকর্মকর্তার হাতে দেশের রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন, কিন্তু গোটা রাষ্ট্র তো ছিল। ছিল সংবিধান। সেই সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, এ ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কী করণীয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা কি সংবিধানের সেই নির্দেশ পালন করেছিলেন? যদি না করে থাকেন তাহলে তার দায় তারা এড়াবেন কীভাবে? এ-সব অতি জরুরি প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে, বিচারবিভাগও তো রাষ্ট্রের অঙ্গ। বিলম্বে হলেও তাঁরা তো তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাস্য হলো, যখন দেশের বৈধ রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হলো এবং পদদলিত করা হলো সংবিধান- তখন রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছে কিনা? যদি না করে থাকে সে জন্যে জাতির কাছে তাদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হলো না কেন?

সংবিধান অনুযায়ী, সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। রাষ্ট্র বা সরকার সংবিধানের নির্দেশমতে জনগণের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে মাত্র। অতএব, রাষ্ট্র যখন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তখন জনগণকে এগিয়ে আসতে হয়। লাগাম টেনে ধরতে হয় রাষ্ট্রের। জনগণের পক্ষে বা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সকল সমাজেই জ্ঞানী-গুণী ও বিবেকবান মানুষেরা এ দায়িত্বটি পালন করে থাকে। তাই জাতির বিবেক হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে তাদের। উন্নত দেশগুলোতে তারা ‘সিভিল সোসাইটি’ নামে পরিচিত হলেও আমাদের দেশে কীভাবে যেন তা ‘সুশীল সমাজ’ অভিধা পেয়েছে। নাম যাই-ই হোক, যুগে যুগে দেশে দেশে রাজা বা রাষ্ট্রের অবিমৃষ্যকারিতার বিরুদ্ধে তারাই বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে জীবনও দিয়েছেন অনেকে। উদাহরণ হিসেবে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যায়। প্রতিবাদের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হিসেবে এখনও যিনি বিশ্বাকাশে নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান তিনি হলেন কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো। তাঁর দেশে সামরিক জান্তা যখন সংবিধান পদদলিত করে ক্ষমতা দখল করেছিল, তখন প্রথমে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু বন্দুকের ভয়ে আদালত যখন তাঁর দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন তখন তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। এ ধরনের উদাহরণ অনেক। কিন্তু গ্লানি ও লজ্জার বিষয় হলো, জাতির সেই দুর্যোগময় মুহূর্তে আমাদের সুশীল সমাজের একটি অংশ সরাসরি খুনিদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। ঘাতকদের অনুগ্রহ লাভের জন্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টেই কেউ বেতার ভবনে, কেউ-বা বঙ্গভবনে ছুটে গিয়েছিলেন। বাঙালির ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এ ঘাতকদের ‘সূর্যসন্তান’ অভিহিত করেই ক্ষান্ত হননি তারা, প্রবন্ধ-কবিতা-গানও রচনা করেছেন তাদের নিয়ে। পত্রপত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছে। প্রচারিত হয়েছে বেতার-টেলিভিশনে। ঘাতক এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মন্ত্রী-উপদেষ্টাও হয়েছেন অনেকে। তথাকথিত এ সুশীলদের সেই নির্লজ্জ নির্বিবেক ভূমিকা এখন আরও কদর্য রূপ নিয়েছে। কতকিছুর জন্যেই না তাঁরা মাতম করেন প্রতিদিন! কিন্তু স্বাধীন দেশে যে-কারবালা সংঘটিত হলো, যেভাবে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো এবং শিশু ও গর্ভবতী নারীর রক্তে রঞ্জিত করা হলো জাতির ললাট- তা নিয়ে তাঁরা টুঁ শব্দটিও করেন না।

এ কথা অনস্বীকার্য যে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। তারাই প্রথম প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন প্রতিবাদের সবচেয়ে কার্যকর মশাল। উদাহরণ হিসেবে কবি নির্মলেন্দু গুণের অবিস্মরণীয় কয়েকটি কবিতার কথা বলা যায়। যেমন ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ প্রভৃতি। পঁচাত্তরপরবর্তীকালে লেখা এ-সব কবিতা জনচিত্তে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল- তার আলোড়ন কখনোই থামবার নয়। একইভাবে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যতরুণ গোষ্ঠীর উদ্যোগে প্রকাশিত ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’, চট্টগ্রামের এপিটাফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ কিংবা ‘আবার যুদ্ধে যাবো’-এর কথাও। সেই অন্ধকারে বাতিঘরের মতো কাজ করেছিল এ-সব কবিতা ও প্রকাশনা। সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। অচিরেই পহেলা বৈশাখ ও একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ১৫ আগস্টও পরিণত হয়েছিল প্রতিবাদী কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রেরণা ও সৃষ্টিশীলতার এক অশেষ ঝরনাধারায়। শোক পরিণত হয়েছিল শক্তিতে। শুধু তাই নয়, যতো দিন যাচ্ছে ততোই তা আরও বেগবান হচ্ছে।

এ কথা সত্য যে ইতোমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু প্রকাশনা হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ব্যাপক মাত্রা ও গতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশকিছু বই ও সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ তিনটি উদ্যোগ হলো, ইউপিএল থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি’। তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, অদম্য-আলোকিতারা যে-সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়- এসব গ্রন্থে কি সেইসব প্রশ্নের উত্তর আছে? আমি সবিনয়ে বলতে চাই- নেই। আমার এ মন্তব্যে কেউ কেউ হয়তো অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হতে পারেন এ ব্যাপারে আমি সচেতন। তা সত্ত্বেও আমি বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার তাগিদ অনুভব করছি। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যত বই প্রকাশিত হয়েছে তা পরিমাণ ও পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারে বিপুল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এতে যে-পরিমাণ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো জড়ো করে কয়েকটি মহাকাব্যও হয়তো রচনা করা যাবে। কিন্তু আজকের অতি ব্যস্ত প্রযুক্তিনির্ভর শিশু-কিশোর-তরুণরা যেভাবে তথ্যগুলো জানতে চায় সেভাবে সেগুলো সেখানে উপস্থাপিত হয়নি। মনে রাখা দরকার যে স্কুল-কোচিং-সেমিস্টার এবং কারিকুলামবহির্ভূত নানা রকম কোর্সের চাপে তারা এমনিতেই বিপর্যস্ত। তারপর যে-টুকু সময় তারা পায় সেটা ব্যয় করে প্রধানত টেলিভিশন, ট্যাব, স্মার্টফোন ও কম্পিউটারসহ প্রযুক্তিনির্ভর যে বিশাল মায়াবি জগৎ তার পেছনে। প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবন যেভাবে তাদের নিদ্রাহরণ করে নিচ্ছে, রূপকথার জগৎও পূর্ববর্তী প্রজন্মকে ততোটা আলোড়িত করতে পারেনি। অতএব, তাদের মনোজগতে প্রবেশ করতে হলে এ বাস্তবতা যেমন বিবেচনায় রাখতে হবে, তেমনি তাদের রুচি বা মানসিক গঠনটিও বিস্মৃত হলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে এখনও বড়ো ধরনের শূন্যতা রয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে।

এটা সুবিদিত যে, তথ্যের উপস্থাপনা বা পরিবেশনার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু পরিবেশনার গুণেই একটি তথ্য বা বক্তব্য জনচিত্তে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ হাজির করা যেতে পারে। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কতজন কত কথাই তো বলেছেন এবং বলছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের জনচিত্তপ্লাবী যে-আবেদন- দীর্ঘ ৪৬ বছর পরেও তা এতোটুকু মলিন হয়নি। শত বছর পরেও যে হবে না- তাও নিঃসন্দেহে বলা যায়। আবার পরিবেশনার দুর্বলতার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যও যে বুদবুদের মতো বিনা আলোড়নেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণও অঢেল। সে জন্যেই উন্নত দেশগুলোতে তথ্য ও বক্তব্য উপস্থাপনের রীতি ও কৌশল নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলে আসছে দীর্ঘদিন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় টার্গেট গ্রুপ অর্থাৎ যাদের জন্যে তথ্য বা বক্তব্যটি উপস্থাপিত হচ্ছে তাদের রুচি ও মনমানসিকতার ওপর। অপ্রিয় হলেও সত্য যে আমরা এ-ক্ষেত্রে এখনও ঠিকমতো যাত্রাই শুরু করতে পারিনি- যার জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে আমাদের স্কুল-কলেজের একঘেয়ে পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যক্রম। পাঠদান পদ্ধতিও এর ব্যতিক্রম নয়।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, উপস্থাপনার বিষয়টি আসে পরে। সবার আগে নির্ধারণ করতে হয় বক্তব্য। আমরা কী বলবো সে বিষয়ে ধারণা স্বচ্ছ না হলে উপস্থাপনা যতো ভালোই হোক তা বিফলে যেতে বাধ্য। ধারণা স্বচ্ছ করার সহজ উপায়টি হলো, আমরা যে-বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাই সে বিষয়ে জনমনে বিরাজমান প্রশ্নগুলোকে সামনে রাখা। আজকাল নামিদামি বহু প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইটে ‘এফএকিউ’ (ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চেন্স) নামে একটি মেন্যু সংযোজন করে থাকে। ব্যাপক ও ব্যয়বহুল জরিপের মাধ্যমে এ প্রশ্নগুলো তুলে আনা হয় তাদের লক্ষ্যভুক্ত (টার্গেটেড) জনগণের ভেতর থেকে। সে অনুযায়ী বক্তব্যগুলো বিন্যস্ত করা হয়। এখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘিরে অদম্য-আলোকিতাদের মনে যে-প্রশ্ন পুঞ্জীভূত হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে সেই প্রশ্নগুলোকে ছেঁকে তুলে আনার অতি জরুরি কাজটি এখন অবধি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। শুধু ইতিহাস-বিকৃতি নিয়ে হা-হুতাশ করলে চলবে না। সঠিক ইতিহাস সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। জরুরিভিত্তিতে এদিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া দরকার।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশই হলো শিশু-কিশোর ও তরুণ। সদিচ্ছা থাকলে তাদের যাবতীয় জিজ্ঞাসার যথাযথ উত্তর তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া কঠিন নয়। প্রথম কাজটি হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তারা সব সময় যে-প্রশ্নগুলো করে থাকে সেগুলো চিহ্নিত করা। দ্বিতীয় কাজটি হলো, তাদের রুচি ও মনমানসিকতা অনুযায়ী আকর্ষণীয়ভাবে তা উপস্থাপন করা। এ ক্ষেত্রে ছাপা ও ইলেকট্রনিক উভয় মাধ্যমই ব্যবহার করা যেতে পারে। লাখ লাখ শিশু-কিশোর-তরুণ প্রতিবছর স্কুল-কলেজে পা রাখছে। তাদের জানার আগ্রহ অসীম। অতএব, ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। এখন প্রয়োজন তাতে বীজ বপন এবং তার উপযুক্ত পরিচর্যা। আমরা তাতে ব্যর্থ হলে ক্ষেত্রটি যে বিপজ্জনক আগাছাদের দখলে চলে যাবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

SUMMARY

840-4.jpg