|| অজয় দাশগুপ্ত ||
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা সত্যি কঠিন। তাঁকে ঘিরে এত এত আয়োজন আর আওয়ামী শোক বা উচ্ছ্বাসের কারণে আমি মনে করি, চুপ থাকাটাই শ্রেয়। তাছাড়া একজন মানুষের জীবন ও আদর্শ ঠিকভাবে চেনা-জানা বা অনুসরণের বাইরে রেখে লেখালেখি মূলত মাতম। আর এখন এটাই দস্তুর। আওয়ামী লীগ যখন দেশ শাসনে ছিলো না, যখন ধারণা করা হয়েছিল, তারা আর কোনো দিন হয়তো দেশ চালানোর সুযোগ পাবে না, তখন রাজপথে তার শক্তি দেখেছি আমরা। সে শক্তির উৎস ছিলেন তিনি। তাঁকে ঘিরে আবর্তিত আওয়ামী লীগের তখনকার রাজনীতি একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আরেক দিকে বঙ্গবন্ধু- দু'য়ে মিলে হয়ে উঠেছিল আলোকবর্তিকা। আজ আর তা নেই।
কীভাবে, কেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল সে ইতিহাস আমাদের সবার জানা। আমরা ধারণা করেছিলাম আওয়ামী লীগ কোনো সময় দেশশাসনে এলে প্রকৃত ঘটনা, প্রকৃত খুনী আর ইতিহাস জানা যাবে। বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল। শেখ হাসিনার অকুতোভয় নেতৃত্বে খুনীদের বিচার হয়েছে। ফাঁসিও হয়েছে। এরপর বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে ‘একাত্তরের জল্লাদ’ নামে পরিচিত রাজাকারদেরও ফাঁসি হয়েছে। তফাৎ এই, এদের ফাঁসির পর কিছু কিছু মানুষের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখে গেছে। তাদের ‘শহীদ’ হিসেবে উল্লেখ করে ফলক লাগানোর ছবিও দেখেছি আমরা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ব্যাপারে কেউ কোনো সহানুভূতি দেখিয়েছেন এমন ঘটনা ঘটেনি। কারণ ঐ হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীতে ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ডের পর দেশ যে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে সেটাই আজ যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ। এই ঘটনা মানুষ বুঝতে পেরেছে। তারা এও জানে আগামী একশ বছরেও পদ্মাপাড়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল কোনো ঘটনা ঘটবে না। আর কোনো বঙ্গবন্ধুরও জন্ম হবে না।
এই জানা বা বোঝা যে কতটা বাস্তব সেটা আমরা টের পেলেও বঙ্গবন্ধুর দল বোঝে না। সময়ের সাথে সবকিছু বদলায় এটাই প্রকৃতি ও ইতিহাসের নিয়ম। আওয়ামী লীগকেও বদলাতে হবে বৈকি। কিন্তু এভাবে? আজ আমরা দেখি আওয়ামী লীগে তাদের ত্যাগী নেতাদের মূল্য নেই। জাসদ, বাসদ বা বাম নেতারা যারা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলতেন না , যারা তাঁর মৃত্যুর পর লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিতে চেয়েছিলো বা আনন্দে নেচেছিল তারাই আজ মুখর। তারাই আজ আওয়ামী লীগের মাখনভোগী। আমি বলবো এজন্যে দায়ী আওয়ামী লীগ। তাদের নেতারা সঠিক ইতিহাসের কথা বলেন না। তারা সত্যাশ্রয়ী হলে পঁচাত্তরের পর যাঁরা দলের হাল ধরেছিলেন তাঁদের কথা বলতেন।
তিনজনকে খুব মনে পড়ে। জোহরা তাজউদ্দীন, আব্দুর রাজ্জাক ও মিজানুর রহমান চৌধুরী। তখন বঙ্গবন্ধুর নাম বলাও পাপ। তাঁর দল বা চারনেতার কথা উচ্চারিত হলে কারাগার নিশ্চিত। মানুষ বরাবর এক ধরনের- তাদের মনে করিয়ে দিতে হয়। সেই কাজে নেমেছিলেন এঁরা। আব্দুর রাজ্জাক গর্জন করতেন। সন্ধ্যার মায়াবি আলোয় জোহরা তাজউদ্দীনের কান্না মানুষের চোখ ভিজিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতো। মিজান চৌধুরীর বলা কবিতায় যখন ‘শিশুকে মেরেছো কেন?’ উচ্চারিত হতো বাঁধ ভেঙে পড়তো মানুষের ধৈর্যের। একটু একটু করে শোককে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন এঁরা। না দল, না আমরা কেউই মূল্যায়ন করিনি এঁদের। কেউ মনেও রাখে না সে দিনগুলোর কথা।
তবু সেই দুঃখের দিনগুলোতেই খাঁটি মানুষ, খাঁটি নেতা আর ত্যাগের মহিমা ছিলো দেশে। আজ যারা বড় বড় কথা বলেন তারা সেদিন কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা পালন করেননি। আজ পথহারা কাদের সিদ্দিকী সেদিন একমাত্র নেতা যিনি ভারতে চলে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। জীবনের একটা বড় সময় তিনি এই ঘটনা- পিতার মৃত্যু মেনে নিয়ে মাংস খেতেন না। সেসব কি মিথ্যা? আমরা কি ভুলে গেছি আওয়ামী লীগের সব বড় বড় নেতা মোশতাকের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেছিলেন? যাঁরা করেননি সেই চারনেতা বা তোফায়েল আহমেদরা কি দল থেকে তার কোনো স্বীকৃতি বা সম্মান পান? যেদিকে তাকাই শুধু মোসাহেবী আর স্তুতি। অথচ বঙ্গবন্ধুকে যারা জানেন তারা মানবেন তিনি এসব পছন্দ করতেন না। আমাদের মনে আছে, স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের পোলোগ্রাউন্ড ময়দানের এক জনসভায় অকারণে মাইক আঁকড়ে বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিতে থাকা এক সাংবাদিক তাঁর হুমকি বা ধমকের চোটে মাটিতে বসে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। এমন অজস্র ঘটনা আছে যেখানে তিনি এসব বিষয় তুচ্ছ করে দেখতেন। তবে দিলখোলা বলে অনেক অমানুষকেও প্রশ্রয় দিতেন। যেমন মোশতাক।
বিষয়টা খুব ভাবনার। আওয়ামী লীগ প্রচ্ছন্ন দুশমন বা ঘাতক হিসেবে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার মোশতাকের ব্যাপারে ততটাই নীরব। এর কারণ কী? মোশতাক গংদের ষড়যন্ত্র আর আমেরিকা পাকিস্তানের ইশারা ছাড়া কি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব ছিল? সে জায়গাগুলো লবিং, আন্তর্জাতিক প্রেসার বা দলীয়কারণে নিস্তেজ করে রাখলে ভবিষ্যত ছেড়ে কথা বলবে না। মোশতাক এদেশের মীরজাফর। ঘরের শত্রু বিভীষণ। তাকে চিহ্নিত না করলে দলের ভেতরকার মোশতাকরা ধরে নেবে তারা নিরাপদ। তিনি দলের ছিলেন বলেই কি তাকে এই ছাড় দেওয়া?
এই মোশতাকই লিখিত ভাষণে খুনীদের সূর্যসন্তান বলে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর শাসনভার গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ চোখে ঠুলি পড়লেই এই সত্য মিলিয়ে যাবে না। যুগে যুগে কাছের মানুষরাই পারে দল বা দেশকে ডুবিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র সফল করতে। এটা স্বীকার করা মানে নিজেদের আগামীর পথ সুগম করা। বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তির জন্য ওএটা জরুরি।
আজকাল এমন পরিবেশ যে, সবাই আওয়ামী লীগ। যতদিন দলের হাতে শাসনভার ততদিন তারা দল ঘিরে, নেত্রীকে ঘিরে থাকবে। এভাবে তারা বঙ্গবন্ধুকেও ঘিরে রেখেছিল। যখন তিনি নাই হলেন, এরাও আর নাই। সেই দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এদেশের সুশীল সমাজ। বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানারে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বড় বড় শহরের শোক মিছিলগুলো ছিলো মানুষের ভরসা ও শক্তির উৎস। তাদের কথ কেউ বলে না। কেউ জানে না সামরিক শাসনের বেড়াজাল ভেঙে কি করা তারা আন্দোলন করেছিল? সংস্কৃতি ও শিল্পের সেই রুদ্ররূপ আজ উধাও। এখন নেতার নামে দালালী আর লঙ্গরখানা খুলে ভোজনের নামে বিরিয়ানি বিতরণের শোকানন্দ আমার মতো অনেকের কাছে ভয়ের ব্যাপার।
আমি এটা নিশ্চিত জানি- তিনি অমর। আমাদের দেশের কোনো নেতা, কোনো শক্তির সাধ্য নাই তাঁকে অপমান করে টিকে থাকে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের কাল হচ্ছে এমন দিনে কেক কাটা। ভুয়া জন্মদিন পালন করে তিনি মানুষের মনে যে ঘৃণার জন্ম দিয়েছেন, যে পাপ করেছেন আজ তার মাশুল দিতে হচ্ছে তাঁকে। দলও প্রায় শেষের পথে। অথচ তাদের রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী বা আবদুর রহমান বিশ্বাস কৌশলে বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিয়ে টিকে আছেন। এসব সত্য জানার পরও আওয়ামী লীগ মানে না। তাদের মাতমে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি রক্ত টগবগ করানোর শক্তি হারাতে বসেছে। তাদের অতি উৎসাহে বঙ্গবন্ধুকে মনে মনে ভালোবাসার বাইরে আর কিছু করার উৎসাহ হারাচ্ছে মানুষ। অথচ কত কাজ বাকী। তাঁর আন্তর্জাতিক ইমেজ, তাঁকে নিয়ে গবেষণা সব এখনো অধরা।
আর একটা কথা মানতেই হবে, তিনি জাতির জনক। তিনি সবার। সে কারণে খালি আওয়ামী লীগের মাতমে তিনি থাকবেন আর কারো অধিকার নাই এটা মানা যায় না। এই বাংলাদেশের শ্যামল মাটি তাঁর রক্তধারায় ভিজে যাওয়া পবিত্র মাটি। আমি জানি রাত ঘন হলে আগস্টের মায়াময় দেশে তিনি নীরবে এসে দাঁড়ান। কেউ তাঁকে দেখে না বটে, কিন্তু তিনি সব দেখেন। তিনি জানেন কে কেন কী করছে। হয়তো বজ্রকণ্ঠে আর একবার বলার জন্য মুখিয়ে থাকেন- যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
বাংলাদেশের তারুণ্য তোমরা জেনো উপমহাদেশে এমন নেতা আগে আসেনি। সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা সহজ জীবনের বড় মানুষ বঙ্গবন্ধুকে আমরা যেন দলের বেড়াজালে সাম্প্রদায়িকতায় বা কোনো ষড়যন্ত্রে ছোট না করি। তিনি না থাকলে ইতিহাস ঘোর অন্ধকার। আর এটাও জানবে তিনি সূর্য, বাকীরা ছিলেন চাঁদ, তারা। যাঁরা সবাই মিলে আমাদের আকাশ। এখন যা দেখছি তাতে আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন মনে পড়ছে- তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল।
জয়তু বঙ্গবন্ধু।
লেখক: প্রাবন্ধিক