৭ মার্চ: বঙ্গবন্ধুর কবিতা-প্রতিম ভাষণ


|| যতীন সরকার ||

‘‘শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন নিজের ঘোষণায় নয়, সংগ্রামী জনতার স্নেহ এবং সকৃতজ্ঞ ইচ্ছার প্রকাশে। একথা অবশ্যই ঠিক যে, শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যাটি তাঁর সমকালীন সাথী, অ-সাথীদের সকলে যে আনন্দের দৃষ্টিতে দেখেছে, এমন নয়। অস্বাভাবিকভাবে এই আখ্যাটিতে অনেকের মনে ঈর্ষার উদ্রেক হয়েছে। তাদের মনের ভাবটি এমন: এই অজ্ঞ লোকটিকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলার কী প্রয়োজন? এমন মনোভাবের অবচেতন অনুযোগটি হচ্ছে: আমাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ না বলে শেখকে বলা কেন?

শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি। ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। নানা দিকে বড়: তেজে, সাহসে, স্নেহ,  ভালোবাসায় এবং দুর্বলতায়। সর্বদিকে। এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈর্ষিতকে হত্যা করে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না।’’

কথাগুলো লিখেছিলেন প্রখ্যাত প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট লেখক সরদার ফজলুল করিম, যিনি গত ১৪ জুন ২০১৪, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সরদারের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ সংকলনে গ্রন্থিত ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ শীর্ষক প্রবন্ধটি আমি কয়েকবার পড়েছি। ওই প্রবন্ধটি বিশেষ করে উপরে উদ্ধৃত বাক্য- আমার ভাবনাকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করে তুলেছে। এই ভাবনার বৃত্তটিতে অবস্থান করেই আজ আমি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিকের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করছি, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নিজের ভাবনাকে সংহত করে নিতে চেষ্টা করছি। আবার বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার কার্যকারণ সম্পর্কটিও অবলোকন করতে চাইছি সরদারের বক্তব্যের আলোকেই।

একাত্তরের সাতই মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর যে-ভাষণ শ্রবণের স্মৃতি সরদার ফজলুল করিমকে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ প্রবন্ধটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যে ভাষণটি কোটি কোটি বাঙালির মতো আমিও শুনেছিলাম। তবে রেসকোর্সের ময়দানের সেই অবিস্মরণীয় সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তাঁর স্বকণ্ঠ-নিঃসৃত ভাষণ শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ আমি মফস্বলবাসী। আমাকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে হয়েছিল রেডিওতে। তবে সেটি সাতই মার্চে নয়, পরদিন আটই মার্চ সকালে। সাতই মার্চ বিকেলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার অধীর আগ্রহ নিয়ে বেতারযন্ত্রের সামনে বসে ছিলাম। কিন্তু সে-ভাষণটি যখন সরাসরি রেডিও থেকে প্রচার করতে দেওয়া হলো না, তখনই ঢাকা বেতারের সকল কর্মী বেতারকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন এবং জানিয়ে দেন যে, বঙ্গবন্ধুর পুরো ভাষণটি প্রচার করতে না-দিলে তাঁরা আর বেতারকেন্দ্রে ফিরে যাবেন না। তাঁদের এই অনমনীয়তার কাছে নতি স্বীকার করে শাসন কর্তৃপক্ষ পরদিন সকালে সেই ভাষণটি প্রচার করতে দিতে বাধ্য হয়।

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ কবি নির্মলেন্দু গুণ অত্যন্ত সংগতভাবেই ‘একটি কবিতা’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কী করে আমাদের হলো’ শীর্ষক কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তিগুলোতে নির্মলেন্দু লিখেছেন-

“শত বছরের সংগ্রাম শেষে

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,

হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের!”

এই কবিতাটি যে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বেরিয়ে এসেছিল, কিংবা এর রচয়িতা কেবল একা বঙ্গবন্ধু, তা কিন্তু নয়। হাজার বছর ধরে বাঙালি তাঁর হৃদয়ের গভীরে এর ভাব ধারণ করে আসছিল। হাজার বছর ধরেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত রূপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল যে-আকুতি, সেই আকুতিটিই সুনির্দিষ্ট ও সংহত দিকনির্দেশনামূলক কথার মধ্যে রূপ পেতে চাইছিল। গণমনে যুগ যুগ লালিত সেই আকুতিটিই অস্ফুট ভাবনার ভয় ভেঙে অসীম শক্তিধর অবিনাশী কথামালা তথা কবিতা হয়ে বেরিয়ে এলো যাঁর কণ্ঠ থেকে, সেই শেখ মুজিব শুধু তখন একজন কথাকার বা কবি হয়েই রইলেন না, হয়ে গেলেন সেই জনগোষ্ঠীর পরিত্রাতা ও ভয়ত্রাতা। তাই ‘নিজের ঘোষণায় নয়’, তিনি ‘বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন সংগ্রামী জনতার স্নেহ ও সকৃতজ্ঞ ইচ্ছার প্রকাশেই’।

বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে এতদিন যা ‘ইচ্ছা হয়ে ছিল মনের মাঝারে’, সেই ইচ্ছাকে যিনি অমর কবিতায় রূপ দিলেন, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা- যে শত ধারায় উৎসারিত হয়ে উঠবে- তেমনটিই তো স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু যে-কবিতা রচনা করলেন তা তো বহুমাত্রিক। যে-কোনো মহৎ কবিতার মতোই সেটি অভিধাকে অতিক্রম করে বহুমুখী ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ। সাতই মার্চের সেই কবিতাটিতে যেমন ছিল অনেক সুস্পষ্ট উচ্চারণ, তেমনই এতে সন্নিবিষ্ট হয়েছিল এমন ইঙ্গিতগর্ভ শব্দাবলী যা ছিল স্পষ্ট কথার চেয়েও অনেক বেশি ব্যঞ্জনাবহ। প্রকৃত কবিতা তো মানুষের ভাষাকে ‘অর্থের বন্ধন হতে ভাবের স্বাধীন লোকে’ পৌঁছিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর সেই অমর কবিতাটিও তা-ই করেছিল। সেই কবিতার ব্যঞ্জনায় ‘রাজনৈতিক কৌশলের কাছে’ চূড়ান্ত মার খেয়েছিল ‘পাকিস্তানি জেনারেলদের রণকৌশল।’

স্বাধীনতা-প্রাপ্তির প্রায় অব্যবহিত পরেই, ১৯৭২ সালে, মার্কিন সাংবাদিক ডেভিট ফ্রস্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘রণকৌশলটি’ স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন এভাবে-

“৭ মার্চ যখন আমি ঢাকা রেসকোর্স মাঠে আমার শেষ মিটিং করি, ঐ মিটিং-এ উপস্থিত দশ লাখ লোক দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানকে ‘স্যালুট’ জানায় এবং ঐ সময়ই আমাদের জাতীয় সংগীত চূড়ান্ত রূপে গৃহীত হয়ে যায়।

... আমি জানতাম কী ঘটতে যাচ্ছে। তাই আমি ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছিলাম এটাই স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার মোক্ষম সময়।

... আমি চেয়েছিলাম, তারাই (অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) প্রথম আমাদের আঘাত করুক। আমার জনগণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত।”

জনগণ-যে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ তারা রেখেছিল পাকিস্তানি শাসন কর্তৃপক্ষের আদেশ-নিষেধ উপেক্ষা করে, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের ডাকে সাড়া দিয়ে, এবং ২৬ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর আনুষ্ঠানিক অর্থেই মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়ে। সাতই মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর কবিতা-প্রতিম ভাষণই সে-সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেছিল এতে কোনো ভুল নেই।

লেখক: অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

SUMMARY

835-1.jpg