মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.)
১৫ আগস্ট ভোরে আমার বাড়ির আর্মির টেলিফোনটি বেজে ওঠে। আমি তখনো বিছানায়। আমার স্ত্রী টেলিফোন উঠান এবং আমাকে জানান যে মেজর জেনারেল জিয়া আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি টেলিফোন ধরামাত্রই জিয়ার কণ্ঠ শুনি। টেলিফোনের ওই প্রান্ত থেকে জিয়া বললেন, তুমি কিছু শুনেছ? আমাকে জবাব দেওয়ার অবকাশ না দিয়েই তিনি ইংরেজিতে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব হ্যাজ বিন কিল্ড।’ আমি হঠাৎ এতই হতবাক হয়ে যাই যে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কীভাবে এ খবর জানেন। উত্তরে তিনি জানান, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তাঁকে এইমাত্র ফোনে জানিয়েছেন এবং সেসঙ্গে আমাকে তাড়াতাড়ি আর্মি হেডকোয়ার্টারে যেতে বলেছেন। আমার পায়ে তখনো ব্যান্ডেজ, চলাফেরায় অসুবিধা এবং শরীরও দুর্বল। তবুও আমি বিছানা থেকে উঠে আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। প্রায় চার সপ্তাহ পর আমি সামরিক পোশাক পরলাম। আমি এবং মেজর জেনারেল জিয়া সেনানিবাসে শহীদ মইনুল হোসেন রোডে মুখোমুখি বাড়িতে থাকতাম। তিনি ৬ নং বাড়িতে (বর্তমানে খালেদা জিয়া থাকেন) এবং আমি ৭ নং বাড়িতে থাকতাম।
কারা খুনি
আর্মি হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হয়েই জানতে পারি, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ও উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান দুজনেই তখন মেজর ডালিমের সঙ্গে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গেছেন। হেডকোয়ার্টারে বসেই আমি খোঁজখবর নিয়ে জনিতে পারি, প্রথম ল্যান্সারের মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান এবং দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির মেজর রশিদের নেতৃত্বে কিছু চাকুরিরত আর্মি অফিসার, কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং সৈনিক রাতের বেলা নৈশ প্রশিক্ষণের ছলে নতুন বিমানবন্দরে জড়ো হয়। সেখান থেকে রাতে তারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার, মন্ত্রী সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবার এবং শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর পরিবারকে স্ব স্ব বাড়িতে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আমি ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক থাকাকালে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক প্রত্যক্ষভাবে আমার অধীনে কাজ করেছিল। আমি তাদের ভালোভাবেই জানি। এরা দুজনেই পাকিস্তান আর্মিতে স্বল্পমেয়াদি (ছয় মাসের) প্রশিক্ষণে ১৯৬৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। মেজর রশিদ ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে ঢাকায় ‘ছুটিতে এসে’ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। মেজর ফারুক ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ বিজয়ের তিন দিন আগে যশোরে তত্কালীন মেজর মঞ্জুরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। আমি যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল, তখন মেজর ফারুককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমার কাছে ফাইল আসে। সে পাকিস্তানের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে থেকেও ৯ মাসেও স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদান করেনি। দেশের স্বাধীন হওয়া যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর যশোরে মুক্তিবাহিনীতে সে যোগদান করে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমি তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হইনি। তাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেজর ফারুক সামরিক বাহিনীতে স্বীকৃতি পায়নি। যদিও অনেক সিনিয়র অফিসার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য আমাকে সুপারিশ করেছেন, কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। অ্যাডজুটেট জেনারেল হিসেবে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও কে এম সফিউল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
বিদ্রোহ দমনের উদ্যোগ ছিল না
১৫ তারিখ রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। ততক্ষণে আমি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে পারি। রাত দুটোর পর বাড়িতে আসি। যদিও আমি অত্যন্ত দুর্বল ও ক্লান্ত, শরীর অত্যন্ত খারাপ, তবুও আমার ঘুম আসছিল না। সর্বক্ষণ আমার এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কথা মনে হচ্ছিল। সৈনিক হিসেবে স্বাভাবিকভাবে আমি একজন সামরিক ইতিহাসের ছাত্র। এ বিষয়টি আমার খুবই প্রিয়। কাজের অবসরে দেশ-বিদেশের সামরিক ইতিহাস পড়া আমার নিয়মিত অভ্যাস। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করা থেকে অদ্যাবধি আমি সামরিক ইতিহাস পড়ে আসছি। আমার জানামতে, এমন জঘন্য কলঙ্কময় ঘটনা কোনো দেশের সামরিক ইতিহাসে নেই। আমি আবাক হই যে চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত গুটিকয়েক জুনিয়র অফিসার ঢাকায় এত বড় একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে কীভাবে সক্ষম হলো। একজন পেশাদার সৈনিক হিসেবে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এককথায় আমার অভিমত হচ্ছে, উচ্চপদস্থ অধিনায়কদের নিয়ন্ত্রণে বিপর্যয়ের জন্য এ ঘটনা ঘটা সম্ভব হয়েছে, যদিও তাঁরা পরে এ সম্পর্কে নানা গবেষণা, তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন।
এখানে বলতে হয়, যদি এই ঘটনার জন্য দায়ী অফিসার ও অন্যদের সামরিক আদালতে (কোর্ট মার্শাল) বিচার করার ব্যবস্থা হতো, তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দণ্ডবিধি আইনের ৩১ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিরূপে গণ্য হতেন: ১. যিনি বিদ্রোহ আরম্ভ করেন কিংবা বিদ্রোহে অন্যকে উত্সাহিত করেন অথবা ২. যদি উপস্থিত থাকেন এবং সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিদ্রোহ দমন না করেন। এ আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি এই বিদ্রোহের কাজে জড়িত থাকলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৭ নং অনুচ্ছেদের ১৩৯ নং ধারা অনুযায়ী তারাও সামরিক আদালতে বিচারের আওতায় আসবে।
তাই এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে চেইন অব কমান্ডে মুজিব হত্যার ঘটনার পর মেজর রশিদ ও ফারুকের অধিনায়কগণও সামরিক আদালতে দোষীরূপে গণ্য হতেন। কেননা, আমার জানামতে, তাঁরা তত্ক্ষণাৎ এ বিদ্রোহ দমনের জন্য মোটেই কোনো প্রচেষ্টা চালাননি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
মুজিব হত্যাকাণ্ড: কারণ অনুসন্ধান
গুটিকয়েক উচ্ছৃঙ্খল ও উচ্চাভিলাষী অফিসার কীভাবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হলো, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমার বিশ্লেষণমতে আমি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে হত্যাকাণ্ডের কারণগুলো তুলে ধরছি।
ক. সে সময় দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব পড়ে। এমনকি ওই দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে যদি আদেশ দেওয়াও হতো, সৈনিকেরা সে আদেশ কতটুকু পালন করত, তা নিয়ে অধিনায়কদের মনে বেশ সন্দেহ ছিল। অনেক সৈনিক তখন নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করত বলে মনে করা হতো। তবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও মর্মাহত হয়েছিলেন। তবে এই অজুহাতে অধিনায়কদের বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা না করা সামরিক আইনে গুরুতর অপরাধ।
খ. কোনোরূপ পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই না করে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক পদে অদক্ষ, অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগদান।
গ. সেনাবাহিনীতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং অযোগ্য অধিনায়কত্ব। তাই সহজেই হত্যাকারী অফিসারগণ নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য সাধারণ সৈনিকদের বিপথগামী করতে সক্ষম হন।
ঘ. এ পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পূর্বে নৈশ প্রশিক্ষণের নামে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপুল সৈন্য নতুন বিমানবন্দরে জড়ো হলো। স্বভাবতই এ নৈশ প্যারেডের সময় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারও এ প্রশিক্ষণে উপস্থিত থাকার কথা। অথচ আমার মনে হয় না, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের অফিসারগণ নৈশ প্যারেডে উপস্থিত ছিলেন।
ব্যস্ত সময়ে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
ঙ. রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব সামরিক সচিব ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার। অথচ সে সময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো স্থায়ী আদেশ (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) ছিল বলে অদ্যাবধি জানা যায়নি।
চ. কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে প্রথম ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকদের ঢাকায় এনে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। তা ছাড়া নিরাপত্তা ও আনুষ্ঠানিক গার্ড দুটোই ভিন্ন বিষয়। এ দুটোকে এক করার কথা নয়। ওই প্রথম ফিল্ড আর্টিলারির তত্কালীন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ছিলেন ওই ইউনিটেরই অ্যাডজুটেন্ট। ফলে তিনি প্রহরারত সৈনিকগণকে ধোঁকা দিয়ে হত্যাকারীদের নিয়ে অনায়াসে রাষ্ট্রপতির বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হন।
ছ. সেনানিবাসে এবং রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশপাশে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দাদের নজর রাখার কথা, বিশেষ করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এটা আরও জরুরি ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি যে সে সময় সেনানিবাসে কিংবা রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশপাশে গোয়েন্দা সংস্থার কেউ কর্তব্যরত ছিল।
পরিস্থিতির এই সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের পর মনে হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা আগে থেকে না জেনে থাকলেও নতুন এয়ারপোর্ট (বর্তমান বিমানবন্দর) থেকে যখন সৈন্যরা ট্যাংক ও কামান নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলো, তখনো গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা জানলে (যা উচিত ছিল) সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হতো না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির নিজের পক্ষ থেকেই ফোন করে তাঁর ওপর আক্রমণের খবর সংশ্লিষ্টদের জানাতে হলো, যদিও ওই মুহূর্তে প্রতিরোধ প্রচেষ্টা চালানো হলে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হতো না। তবে খবর পাওয়ার পরপরই সামরিক আইনকানুন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সব রকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত ছিল। আর এটা না করা সামরিক আইনে অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য।
পরে শুনেছি, অনেকে মনে করতেন বা এখনো করেন, ওই সময় কোনো রকম ব্যবস্থা নিলে নিজেদের মধ্যে অনেক রক্তপাত হতো। কথা হলো, সামরিক শৃঙ্খলা আইনে এ ধরনের অজুহাত দেখিয়ে অধিনায়কদের নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে প্রত্যাবর্তনের দিনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও লেখক। ছবি: সংগৃহীত
খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ
শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সরকার গঠন করে তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি প্রচলন করেন। বাংলাদেশবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন। এ সময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তত্পর হয়ে উঠল।
ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো। উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য। তত্কালীন ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হলো। এই নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণে থাকাকালে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি কর্নেল থেকে দুটি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন, যা সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময় জার্মানিতে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে এসে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হলো। বিমানবাহিনীর তত্কালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের চাকরি রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো। বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদে নিযুক্ত করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বহাল করা হলো। সামরিক বাহিনীর এসব পরিবর্তনে জেনারেল ওসমানী ও শেখ মুজিব হত্যাকারী মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শরীফুল হক (ডালিম) এবং তাদের সহযোগীরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। কারণ, তখন এই অফিসারগণ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের আশপাশে থাকত।
মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদেরই সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ ছিল। খন্দকার মোশতাক এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনেই থাকতে উত্সাহিত করতেন। এর মধ্যে তিনি সেনাবাহিনীর কোনো সুপারিশ ছাড়াই মেজর ফারুক ও রশিদকে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দেন। ডালিমকেও সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিয়ে লে. কর্নেল করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে মোশতাক এক অধ্যাদেশ বলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কোনোরূপ বিচার বা শাস্তি দেওয়া যাবে না—এই মর্মে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেন।
(লেখাটি মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.)-এর এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য-স্বাধীনতার প্রথম দশক বই থেকে সংগৃহীত। বইটির প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স। লেখাটির বানানরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)