জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জীবনের শেষ ভাষণে যা বলেছিলেন

 
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলাদেশ নামে এই মানচিত্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বপ্নের রূপকার। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ তার জীবনের শেষ ভাষণ দেন। পত্রিকায় প্রকাশিত ওই ঐতিহাসিক ভাষণের বিজ্ঞাপনে একে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির ব্যাখ্যা’ হিসেবে। দুঃখজনকভাবে এই ভাষণটিই হয়ে যায় তার জীবনের শেষ ভাষণ। কেননা একই বছরে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

ওই ভাষণে নতুন বাংলাদেশকে গড়ার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু খুনিরা আর সেই সুযোগ দেয়নি।

৭৫ সালের ২৬ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটির পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চের দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়। পাঠকদের জন্য দৈনিক সংবাদের প্রকাশিত ভাষণটির পূর্ণ অনুলিপি তুলে দেওয়া হলো।

আমার ভাই ও বোনেরা, আজ ২৬শে মার্চ। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষকে আক্রমণ করেছিল। হাজার হাজার, লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছিল। সেদিন রাতে বিডিআর-এর ক্যাম্পে, পুলিশ ক্যাম্পে, আমার বাড়িতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চারদিকে আক্রমণ চালানো হয় ও নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশবিক শক্তি নিয়ে।

বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়েছিলাম। ৭ই মার্চ আমি তাদের প্রস্তুত করে দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে সেই মুহূর্তে আবার আমি ডাক দিয়েছিলাম যে আর নয়, মোকাবিলা কর; বাংলার মানুষ যে যেখানে আছ, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা কর। বাংলার মাটি থেকে শত্রুকে উৎখাত করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীন করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

দুনিয়ার মানুষের কাছে আমি সাহায্য চেয়েছিলাম। আমার সামরিক বাহিনীতে যারা বাঙ্গালী ছিল, আমার বিডিআর, আমার পুলিশ, আমার ছাত্র, যুবক ও কৃষকদের আমি আহ্বান করেছিলাম। বাংলার মানুষ রক্ত দিয়ে মোকাবিলা করেছিল। ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছিল। শত শত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। দুনিয়ার জঘণ্যতম ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানি শোষক শ্রেণী। দুনিয়ার ইতিহাসে এত রক্ত স্বাধীনতার জন্য কোন দেশ দেয় নাই, যা বাংলার মানুষ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা এমনভাবে পঙ্কিলতা শুরু করল, যা কিছু ছিল ধ্বংস করতে আরম্ভ করেছিল। ভারতে আমার এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল; তার জন্য আমরা নিশ্চই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব।

আমি তাদের স্মরণ করি, খোদার কাছে মাগফেরাত কামনা করি যারা এদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, আত্মাহুতি দিয়েছে। আমি তাদের কথা স্মরণ করব যে সকল মুক্তিবাহিনীর ছেলে, যে সব মা-বোনেরা, আমার যে কর্মী বাহিনী যারা আত্মাহুতি দিয়েছিল শহীদ হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। এদেশ তাদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে। আজ আমি স্মরণ করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা জীবন দিয়েছিল বাংলার মাটিতে। তাদের কথাও আমি স্মরণ করি।

একটা কথা। আপনাদের মনে আছে, তারা যাবার পূর্বে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে, কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করব, সম্পদ ধ্বংস করব, বাঙ্গালী স্বাধীনতা পেলেও এই স্বাধীনতা রাখতে পারবে না। ইনশা আল্লাহ, বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা হয়েছে। বাংলার লোক স্বাধীন হয়েছে। বাংলার পতাকা আজ দুনিয়ায় উড়ে। বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘের সদস্য। বাংলাদেশ জোট-নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সদস্য, কমনওয়েলথের সদস্য, ইসলামী সামিট (Summit)-এর সদস্য। বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে; বাংলাদেশ থাকবে; কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।

ভাইয়েরা, বোনেরা আমার, আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। আমরা জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাস করি; আমরা কো-এক্সিস্টেন্সে (co-existance) বিশ্বাস করি, আমরা বিশ্ব শান্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা ভেবেছিলাম পাকিস্তানিরা নিশ্চই দুঃখিত হবে, আমার সম্পদ ফেরত দেবে। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি, তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এই জন্য যে এশিয়ায়, দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানীরা আমার সম্পদ এক পয়সাও দিল না, আমার বৈদেশিক মুদ্রার কোনো অংশ আমাকে দিল না। আমার গোল্ড রিজার্ভের কোনও অংশ আমাকে দিল না। একখানা জাহাজও আমাকে দিল না। একখানা প্লেনও আমাকে দিল না। কেন্দ্রীয় সরকারে সম্পদ এক পয়সাও আমাকে দিল না এবং যাবার বেলায় পোর্ট ধ্বংস করলো, রাস্তা ধ্বংস করলো, রেলও ধ্বংস করলো, জাহাজ ডুবিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত কারেন্সী নোটও জ্বালিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানীরা মনে করেছিল যে, বাংলাদেশকে যদি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের মানুষকে আমরা দেখাতে পারবো যে, তোমরা কি করেছো।

ভুট্টো সাহেব বক্তৃতা করেন। আমি তাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলাম লাহোরে আমাকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বলে। ভুট্টো সাহেব বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কি? ভুট্টো সাহেবকে আমি জিজ্ঞেস করি, ফ্রন্টিয়ারের পাঠানদের অবস্থা কি? ভুট্টো সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করি বেলুচিস্তানের মানুষের অবস্থা কি? এরোপ্লেন দিয়ে গুলী করে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর মানুষের অবস্থা কি। ঘর সামলান বন্ধু, ঘর সামলান। নিজের কথা চিন্তা করুন, পরের জন্য চিন্তা করবেন না। পরের সম্পদ লুট করে খেয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। আমার সম্পদ ফেরত না দেয়া পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না। তোমরা আমার কি করেছ। আমি সবার বন্ধুত্ব কামনা করি।

পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু আমার সম্পদ তাকে দিতে হবে। আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই, কারো সঙ্গে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই। আমার মানুষ দুঃখী, আমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন জেল থেকে বের হয়ে আসলাম, তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। গত তিন-চার বছরে নাহলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে। বাইশ’শ কোটি টাকার মত বিদেশ থেকে হেল্প আমরা পেয়েছি। সেজন্য যারা আমাদের সাহায্য করেছেন সে সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্রকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

কিন্তু আর একটি কথা। অনেকে প্রশ্ন করেন আমরা কি করেছি? আমরা যখন ক্ষমতায় আসলাম, দেশের ভার নিলাম তখন দেশের রাস্তা-ঘাট যে অবস্থায় পেলাম তাকে রিপেয়ার করার চেষ্টা করলাম। সেনাবাহিনী নাই, প্রায় ধ্বংস করে গেছে; পুলিশ বাহিনীর রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই খারাপ অবস্থা থেকে ভাল করতে কী করি নাই? আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। আমাদের এখানে জাতীয় সরকার ছিল না, আমাদের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল না, বৈদেশিক ডিপার্টমেণ্ট ছিল না, প্লানিং ডিপার্টমেন্ট ছিল না। এখানে কিছুই ছিল না। তার মধ্যে আমাদের জাতীয় সরকার গঠন করতে হলো। যারা শুধু কথা বলেন তারা বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করে বলুন আমরা কি করেছি। এক কোটি লোককে ঘরবাড়ী দিয়েছি। রাষ্ট্রের লোককে খাওয়ানোর জন্য বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়েছে। পোর্টগুলোকে অচল থেকে সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন যায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে।

তাই আজ কথা আছে। আমি মানুষকে বললাম, আমার ভাইদের বললাম, মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের বললাম তোমরা অস্ত্র জমা দাও। তারা অস্ত্র জমা দিল। কিন্তু একদল লোক আমার জানা আছে যাদের পাকিস্তান অস্ত্র দিয়ে গিয়েছিল তারা অস্ত্র জমা দেয়নি। তারা এসব অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ লোককে হত্যা করতে আরম্ভ করল। এমনকি পাঁচজন পার্লামেন্টের সদস্যকেও তারা হত্যা করল। তবুও আমি শাসনতন্ত্র দিয়ে নির্বাচন দিলাম। কিন্তু যদি বাংলার জনগণ নির্বাচনে আমাকেই ভোট দেয় সেজন্য দোষ আমার নয়। ৩১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩০৭ সিট বাংলার মানুষ আমাকে দিলেন। কিন্তু একদল লোক বলে, কেন জনগণ আমাকে ক্ষমতা দিল? কোন দিন কোন দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কেউ কাউকে এভাবে অধিকার দেয় না। কিন্তু অধিকার ভোগ করতে হলে তার জন্য যে রেসপনসিবিলিটি আছে সেটা তারা ভুলে গেলেন। আমি বললাম তোমরা অপজিশন সৃষ্টি করো, সৃষ্টি করলো। বক্তৃতা করতে আরম্ভ করলো। অন্ধকারে মানুষ হত্যা করতে আরম্ভ করলো। দরকার হলে অস্ত্র দিয়ে আমাদের মোকাবিলা করতে চায়। অস্ত্রের হুমকি দেয়া হলো। মানুষ হত্যা থেকে আরম্ভ করে রেললাইন ধ্বংস করে, ফারটিলাইজার ফ্যাক্টরী ধ্বংস করে, জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করল যাতে বিদেশী এজেন্ট যারা দেশের মধ্যে আছে তারা সুযোগ পেয়ে গেল। আমাদের কর্তব্য মানুষকে বাঁচানো। চারিদিকে হাহাকার, স্বাধীনতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দুনিয়ার সমস্ত জিনিসের দাম আস্তে আস্তে বেড়ে গেল।

সমস্ত দুনিয়া থেকে আমাদের কিনতে হয়। খাবার কিনতে হয়, কাপড় কিনতে হয়, ওষুধ কিনতে হয়, তেল কিনতে হয়। আমরাতো কলোনী ছিলাম, দুইশ বছর ইংরেজদের কলোনী ছিলাম, পঁচিশ বছর পাকিস্তানের কলোনী ছিলাম। আমাদেরতো সবকিছুই বিদেশ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু তার পরেও বাংলার জনগণ কষ্ট স্বীকার করে কাজ করতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু তারা এগুবার দেয় না, কাজ করতে দেয় না। আর একদল বিদেশে সুযোগ পেল, তারা বিদেশ থেকে অর্থ এনে বাংলার মাটিতে বিশৃংখলার সৃষ্টি করলো। স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলো। আজ এই দিনে কেন বলছি একথা। অনেক বলেছি, এত বলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমার চোখের সামনে মানুষের মুখ ভাসে, আমার দেশের মানুষের রক্ত আমার চোখের সামনে ভাসে। আমারই মানুষেরই আত্মা আমার চোখের সামনে। সে সমস্ত শহীদ ভাইরা ভাসে যারা ফুলের মত ঝরে গেল, শহীদ হলো। তাদের আত্মার কাছে রোজকিয়ামতে কি জবাব দিব ‘আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম তোমরা স্বাধীনতা নস্যাৎ করেছো, তোমরা রক্ষা করতে পার নাই।’

কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃংখলা ফিরিয়ে আনবার জন্য। কথা হলো এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, অফিসে যেয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে যায়, সাইন করিয়ে নেয়, ফ্রি-ষ্টাইল। ফ্যাক্টরীতে যেয়ে কাজ না করে টাকা দাবী করে। সাইন করিয়ে নেয়। যেন দেশে সরকার নাই। শ্লোগান হল, বঙ্গবন্ধু কঠোর হও।

বঙ্গবন্ধু কঠোর হবে। কঠোর ছিল, কঠোর আছে। কিন্তু দেখলাম, চেষ্টা করলাম। এত রক্ত, এত ব্যথা দুঃখ, দেখি কি হয়, পারি কি না। আবদার করলাম, আবেদন করলাম, অনুরোধ করলাম, রিকোয়েস্ট করলাম, কামনা করলাম, কথা শুনে না। চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী।

ভাইয়েরা, বোনেরা আমার, আজকে যে সিস্টেম করেছি তার আগেও ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। আমি বিশ্বাস করি না ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগণ যেদিন বলবে ‘বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও’, বঙ্গবন্ধু একদিনও রাষ্ট্রপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালবেসে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য।

দুঃখের বিষয়, তারা রাতের অন্ধকারে পাঁচজন পার্লামেন্টের সদস্যকে হত্যা করেছে, তিন চার হাজারের মতো কর্মীকে হত্যা করেছে। আরেকদল দুর্নীতিবাজ টাকা, টাকা, পয়সা, পয়সা করে পাগল হয়ে গেছে। তবে যেখানে খালি দুর্নীতি ছিল গত দুই মাসের মধ্যে সেখানে, ইনশা আল্লাহ, কিছুটা অবস্থা ইম্প্রুভ করেছে। দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য আজকে কিছু করা হয়েছে। হ্যাঁ, প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গভর্ণমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন, দুইজন, তিনজনকে নমিনেশন দেয়া হবে। জনগণ বাছবে কে ভাল, কে মন্দ। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাই না শোষকের গণতন্ত্র, এটা পরিষ্কার।

আমি প্রোগ্রাম দিয়েছি। আজকে আমাদের সামনে কাজ কি? আজকে আমাদের সামনে অনেক কাজ। আমি সকলকে অনুরোধ করব। আপনারা মনে কিছু করবেন না আমার কিছু উচিত কথা কইতে হবে। কারণ আমি কোনদিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই। সত্য কথা বলার অভ্যাস আমার আছে। মিথ্যা বলার অভ্যাস আমার নাই। কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় কথা বলব। বন্যা হল। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেল, হাজার হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনলাম। ৫,৭০০ (পাঁচ হাজার সাতশ’) লঙ্গরখানা খুললাম মানুষকে বাঁচাবার জন্য। সাহায্য নিয়েছি মানুষকে বাঁচাবার জন্য। আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কি স্বাধীনতা? আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে দুইটা কথা ছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায় যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তা হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না। আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে হোর্ড করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। আমি কেন ডাক দিয়েছি? এই ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানী আমলের যে শাসন ব্যবস্থা তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সেজে গড়তে হবে। তাহলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে, না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখে শুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি। এবং তাই জনগণকে পৌঁছিয়ে দিতে হবে শাসনতন্ত্রের মর্মকথা।

আজকে জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। আমার চেয়ে অধিক কে জানতে পারে? বাংলার কোন থানায় আমি ঘুরি নাই, বাংলার কোন যায়গায় আমি যাই নাই, বাংলার মানুষকে আমার মত কে ভালো করে জানে?

আপনারা দুঃখ পান, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, আপনাদের গায়ে কাপড় নাই, আপনাদের শিক্ষা দিতে পারছি না। কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস, খাদ্য।

দুর্নীতিবাজদের খতম করুন একটা কথা বলি আপনাদের কাছে- সরকারী আইন করে কোন দিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয় জনগণের সমর্থন ছাড়া। আজকে আমার একমাত্র অনুরোধ আপনাদের কাছে সেটা হলো এই। আমি বলেছিলাম প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে? আইন চালাবো। ক্ষমা করবো না। যাকে পাব ছাড়ব না। একটা কাজ আপনাদের করতে হবে। গণআন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামবো। এমন আন্দোলন করতে হবে, যে ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিক বয়কট করতে হবে। একথা মনে রাখতে হবে। গ্রামে গ্রামে মিটিং করে দেখতে হবে, কোথায় ঐ চোর, ঐ ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার, ঐ ঘুষখোর। ভয় নাই কোন ভয় নাই আমি আছি। ইনশাআল্লাহ আপনাদের উপর অত্যাচার করতে দিব না। কিন্তু আপনাদের গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে পারে কে ছাত্র ভাইরা পারে, পারে কে যুবক ভাইরা পারে, পারে কে বুদ্ধিজীবীরা পারে, পারে কে জনগণ পারে। আপনারা সংঘবদ্ধ হন। ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য, বাংলার দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন তা হলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে কিন্তু এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম। এই চোর রেখে গিয়েছে। কিছু দালাল গিয়েছে, চোর গেলে বেঁচে যেতাম।

জমির উৎপাদন বৃদ্ধি করুন দ্বিতীয় কথা, আপনারা জানেন- আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুন বেশী ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে ‘ডবল’ ফসল করতে পারব না। দ্বিগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না, ভিক্ষা করতে হবে না।

ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। একটা লোককে আপনারা ভিক্ষা দেন এক টাকা কি আট আনা। তারপর তার দিকে কিভাবে চান, বলেন “ও বেটা ভিক্ষুক, যা বেটা, নিয়ে যা আট আনা পয়সা।” একটা জাতি যখন ভিক্ষুক হয়, মানুষের কাছে হাত পাতে, আমারে খাবার দাও, আমারে টাকা দাও, সেই জাতির ইজ্জত থাকতে পারে না। আমি সেই ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না।

আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে যারা সত্যিকার কাজ করে যারা প্যানট পরা, কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই- জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ঐ শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাব, ইনশাআল্লা, হবে না। ভিক্ষুকের মত হাত পাততে হবে না। আমি পাগল হয়ে যাই চিন্তা করে। এ বৎসর ’৭৫ সালে আমাকে ছয় কোটি মণ খাবার আনতে হবে। কি করে মানুষকে বাঁচাবো? কি করে অন্যান্য জিনিস কিনবো? অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্র সাহায্য দিচ্ছে বলে বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে পায়ের উপর দাড়াতে হবে জাতি হিসেবে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

ভাইয়েরা আমার,

একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার যায়গা হল ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলায় কোনও জমি থাকবে না চাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। এই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্লানিং করতে হবে। এটা হল ৩ নম্বর কাজ। এক নম্বর হল- দুর্নীতিবাজ খতম কর, দুই নম্বর হল- কলকারখানায়, ক্ষেতে খামারে প্রোশাকশন বাড়ান, তিন নম্বর হল- পপুলেশন প্লানিং, চার নম্বর হলো- জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য একদল করা হয়েছে। যারা বাংলাকে ভালোবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানে সৎপথে চলে, তারা সকলেই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশী এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয়, এতে তাদের স্থান নাই। সরকারী কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এই জন্য সকলে যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগতে হবে।
জাতীয় দলের ব্রাঞ্চ

ভাইয়েরা, বোনেরা, আমার,

এই জাতীয় দলের আপাততঃ ৫টা ব্রাঞ্চ হবে। একটা শ্রমিক ভাইদের অংগদল, কৃষক ভাইদের একটা, যুবক ভাইদের একটা ছাত্রদের একটা এবং মহিলাদের একটা। এই ৫টা অংগদল মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। আমাকে অনেকে বলে, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ হল আমাদের কি হবে। আমি বলি আওয়ামী মানে তো জনগণ। ছাত্র, যুবক, শিক্ষিত সমাজ, সরকারী কর্মচারী সকলে মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।
শিক্ষিত সমাজকে আমি অনুরোধ করব আমরা কতজন শতকরা শিক্ষিত লোক? আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লোক। তারমধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আমি যে এই দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্লাকমার্কেটিং করে কারা? বিদেশী এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যে এর বাইরে নয়। শিক্ষিত সমাজকে একটা কথা বলব, আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে আমরা বলব, এই বেটা কোন্থেকে আইছিসস, বাইরে বয়, বাইরে বয়। একজন শ্রমিক যদি আসে বলি, এখানে দাঁড়া। এই রিকশাওয়ালা, ঐভাবে বলিস না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে। তুচ্ছ করে। এর পরিবর্তন করতে হবে। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। আমরা গাড়ী চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে। সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখ এটা স্বাধীন দেশ। এটা বৃটিশের কলোনী নয়। পাকিস্তানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভায়ের মত, ওরই পরিশ্রমের পয়সা, ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়। একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি কিছু মনে করবেন না, আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? আমার বাপ-মা, আমরা বলি বাপ-মা। লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? ইনজিনীয়ারিং পাস করায় কে? সায়েন্স পাস করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? অফিসার করে কে, কার টাকায়?

বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়। একজন ডাক্তার হতে সোয়া লাখ টাকার মত খরচ পড়ে। একজন ইনজিনীয়ার হতে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকার মত খরচ পড়ে। বাংলার জনগণ গরীব। কিন্তু এরাই ইনজিনীয়ার বানাতে টাকা দেয়, মেডিক্যালের টাকা দেয় একটা অংশ। আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, শিক্ষিত ভাইয়েরা যে আপনার লেখা পড়ার খরচ দিয়েছে তা শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়। আপনার ছেলেমেয়েদের দেখার জন্য নয়। দিয়েছে, তাদের জন্য আপনি কাজ করবেন, তাদের সেবা করবেন বলে। তাদের আপনি কি দিয়েছেন? কি ফেরত দিয়েছেন, কতটুকু দিচ্ছেন? তার টাকায় ইনজিনীয়ার সাহেব, তার টাকায় ডাক্তার সাহেব, তার টাকায় অফিসার সাহেব, তার টাকায় রাজনীতিবিদ সাহেব, তার টাকায় মেম্বার সাহেব, তার টাকায় সব সাহেব। আপনি দিচ্ছেন কি? কি ফেরত দিচ্ছেন? আত্মসমালোচনা করেন, বক্তৃতা করে লাভ নাই। রাতের অন্ধকারে খবরের কাগজের কাগজ ব্ল্যাকমার্কেটিং করে সকাল বেলা বড় বড় করা লেখার দাম নাই। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মদ খেয়ে অনেষ্টির কথা বলার দাম নাই। আত্মসমালোচনা করুন, আত্মশুদ্ধি করুন তা হলেই হবেন মানুষ। এই যে কি হয়েছে সমাজের। সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানীদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে।

কিন্তু একটা কথা, এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে জমি নিয়ে যাব তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যান- এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে কো-অপারেটিভ– এ জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার অংশ যে বেকার প্রত্যেকটি মানুষ যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেষ্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে। ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেয়া হবে তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ-বছরের প্লানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত নিয়ে কম্পালসারী কো-অপারেটিভ হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নণমেণ্টের হাতে। দ্বিতীয়, থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারী যেই হয় একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারী কর্মচারী। তার মধ্যে আমাদের কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে, তারাই থানাকে চালাবে। আর জেলা থাকবে না, সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে এ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। তার চেয়ারম্যান থাকবে। সব কর্মচারী এক সঙ্গে তার মধ্যে থাকবে। এর মধ্যে পিপলস রিপ্রেজেনটেশন থাকবে। পার্টি রিপ্রেজেনটেশন থাকবে। সেখানে তারা সরকার চালাবেন- এইভাবে আমি একটা সিস্টেম চিন্তা করেছি। এবং করবো বলে ইনশা-আল্লাহ আমি ঠিক করেছি। আমি আপনাদের সাহায্য ও সহানভূতি চাই।

ভাই ও বোনেরা আমার, আজকে একটা কথা বলি। আমি জানি শ্রমিক ভাইয়েরা, আপনাদের কষ্ট আছে। এত কষ্ট, আমি জানি। তা আমি ভুলতে পারছি না। বিশেষ করে ফিকসড ইনকাম গ্রুপের কষ্টের সীমা নাই। কিন্তু কোথায় থেকে হবে? টাকা ছাপিয়ে বাড়িয়ে দিলেই তো দেশের মুক্তি হবে না। ইনফ্লেশন হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে পারলে তার পরেই আপনাদের উন্নতি হবে, না হলে উন্নতি হবে না। আমি জানি। যেমন আমরা আজকে দেখেছি। কপাল। আমাদের কপাল। আমরা গরীব দেশতো। আমাদের কপাল- আমার পাটের দাম নাই। আমার চায়ের দাম নাই। আমরা বেচতে গেলে অল্প পয়সায় আমাদের বিক্রি করতে হয়। আর আমি যখন কিনে আনি– যারা বড় বড় দেশ, তারা তাদের জিনিসের দাম অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা বাঁচতে পারি না। আমরা এই জন্য বলি তোমরা মেহেরবানি করে যুদ্ধের মনোভাব বন্ধ করো। আর মামেণ্ট রেস বন্ধ করো। তোমরা অস্ত্র প্রতিযোগীতা বন্ধ করো। ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যয় করো। তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে। আজকে তোমরা মনে করেছো আমরা গরীব-

হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের

করেছো অপমান,

অপমানে হতে হবে তাদের

সবার সমান।

তোমরা মনে করেছ আমরা গরীব, যে দামই হোক আমাকে বিক্রি করতে হয়। এইদিন থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ এদিন থাকবে না। তোমরা আজকে সুযোগ পেয়ে জাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে দাও। জিনিসের দাম বাড়িয়ে দাও। আর তাই আমাদের কিনতে হয়। আমরা এখানে না খেয়ে মরি, আমাদের ইনফ্লেশন হয়, আমরা বাঁচতে পারি না। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাই, তোমরা কিছু খয়রাত দিয়ে একটু মিষ্টি হাসো। হাসো, হাসো, হাসো। দুঃখে পড়েছি, বিক্রীত হয়েছি। তোমাদের কাছে হাত পাততে হবে, হাসো। অনেক হেসেছে- যুগ যুগ ধরে হেসেছে। হাসো। আরব ভাইয়েরাও গরীব ছিল। আরব ভাইদের সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করেছি। প্যালেস্টাইনের আরব ভাইদের ন্যায্য দাবী সমর্থন করে বাংলার মানুষ। আরব ভাইদের পিছনে তারা থাকবে প্যালেস্টাইন উদ্ধার করার জন্য। এও আমাদের পলিসি। যেখানে নির্যাতিত দুঃখী মানুষ সেখানে আমরা থাকব।
শ্রমিক ভাইয়েরা, আমি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান করেছি। আপনাদের প্রতিনিধি ইনডাস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্টের শ্রমিক প্রতিনিধি বসে একটা প্লান করতে হবে। সেই প্লান অনুযায়ী কি করে আমরা বাঁচতে পারি তার বন্দোবস্ত করতে হবে। ছাত্র ভাইয়েরা, লেখাপড়ার কাজ শেখেন। আমি খুশী হয়েছি যে, আপনারা নকল-টকল বন্ধ করেছেন একটু। কিন্তু একটা কথা আমি বলব, আমি পেপারে দেখেছি যে, এবারে প্রায় এক পার্সেন্ট পাস, দুই পার্সেন্ট পাস, তিন পার্সেন্ট পাস। শিক্ষক সম্প্রদায়ের কাছে আমার আকুল আবেদন, ফেল করাবেন না। নকল বন্ধ করেছি। আপনাদের একটা কর্তব্য আছে। বলতে পারেন দুই পার্সেন্ট পাস করিয়ে আপনাদের কর্তব্য পালন করলেন। আপনাদের কর্তব্য আছে, ছেলেদের মানুষ করতে হবে। ফেল করানোতে আপনাদের তেমন বাহাদুরি নাই, পাস করালেই বাহাদুরি আছে। আপনাদের কর্তব্য পালন করুন। খালি ফেল করিয়ে বাহাদুরি নিবেন তা হয় না। তাদের মানুষ করুন। আমি তো শিক্ষকদের বেতন দিব। আমরা সব আদায় করবো। আপনারা লেখাপড়া শিখান, আপনারা তাদের মানুষ করুন। শৃংখলা ফিরিয়ে আনুন, রাজনীতি একটু কম করুন। তাদের একটু মানুষ করার চেষ্টা করুন। একটু সংখ্যা বাড়ান শুধু ১% ২% ৫% দিয়ে বাহাদুরি দেখিয়ে বলবেন খুব ষ্ট্রিকট হয়েছি। আমি ষ্ট্রিকট চাই, নকল করতে দিবেন না। তবে আপনাদের কাছে আবেদন, মেহেরবানি করে আপনাদের কর্তব্য পালন করুন। ছেলেদের মানুষ করার চেষ্টা করুন। পাসের সংখ্যা বাড়াবার চেষ্টা করুন। ওদের মানুষ তৈরি করুন। সেটাই ভালো হবে। রাগ করবেন না। আপনারা আবার আমার উপর রাগ করেন। আমি বুদ্ধিজীবীদের কিছু বলি না। তাদের শুধু সম্মান করি। শুধু এইটুকুই বলি যে বুদ্ধিটা জনগনের খেদমতে ব্যায় করুন। এর বেশী কিছু বলি না। বাবা, বলে কি মারা যাব। আবার কে বই লিখে ফেলবে। খালি সমালোচনা করলে লাভ হবে না।

আমার যুবক ভাইরা, আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর উপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে যেয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করতে হবে। যুবক চাই, ছাত্র চাই সকলকে চাই।

আর একটি কথা বলতে চাই। বিচার।। বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লার মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে, সেই মামলা শেষ হতে লাগে ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস দিয়ে যাই। ঐ মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়, চার বছর তিন বছরের আগে শেষ হয় না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে হবে যে থানায় ট্রাইব্যুনাল করার চেষ্টা করছি এবং সেখানে মানুষ এক বছর দেড় বছরের মধ্যে বিচার পাবে তার বন্দোবস্ত করছি। আশা করি সেটা হবে। তাই আমি একথা জানতে চাই, আপনাদের কাছ থেকে জানতে চাই একটি কথা। এই যে চারটি প্রোগ্রাম দিলাম, এই যে আমি কো-অপারেটিভ করব, থানা কাউন্সিল করব, সাব-ডিভিশনাল কাউন্সিল করব, আর আমি যে আপনাদের কাছ থেকে ডবল ফসল চেয়েছি, জমিতে যে ফসল হয় তার ডবল, কলে-কারখানায় কাজ- সরকারী কর্মচারী ভাইয়েরা একটু ডিসিপ্লিন এসে গেছে। অফিসে যান, কাজ করেন। আপনাদের কষ্ট আছে, আমি জানি। দুঃখী মানুষ আপনারা। আপনারা কাজ করেন। তাদের পেটে খাবার নাই। তাদের উপর ট্যাকস বসিয়ে আমি আপনাদের পুষতে পারব না। প্রোডাকশন বাড়লে আপনাদেরও এদের সঙ্গে উন্নতি হবে। এই যে কথাগুলি আমি বললাম আপনারা আমাকে সমর্থন করেন কিনা, আমার উপর আপনাদের আস্থা আছে কিনা, আমাকে দুই হাত তুলে দেখিয়ে দিন।

ভাইরা, আবার দেখা হবে, কি বলেন ইনশায়াল্লাহ আবার দেখা হবে। আপনারা বহু দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন গ্রামে গ্রামে ফিরে যান। যেয়ে বলবেন, দুর্নীতিবাজদের খতম করতে হবে। ক্ষেতে খামারে কলে-কারখানায় প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। সরকারী কর্মচারী ভাইরা, আপনারাও কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য হবেন। আপনারা প্রাণ দিয়ে কাজ করেন। ইনশা আল্লাহ বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।

আপনারা স্লোগান দিন আমার সাথে।

জয় বাংলা। জয় বাংলা।

বিদায় নিচ্ছি। খোদা হাফেজ।

সূত্র: কালের কণ্ঠ ।

SUMMARY

825-1.jpg