‘শিল্প-সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু’

.......................................................

উদীচী প্রযোজিত ও মাহমুদ সেলিম রচিত ‘ইতিহাস কথা কও’-এ বঙ্গবন্ধু উন্মোচিত হয়েছেন এবং নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের নাটক শেকসপিয়ারের হ্যামলেটের উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধুকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এছাড়া শামসুদ্দিন আহমেদ রচনা করেছেন ‘বাংলাদেশের শেখ মুজিব’ নামে একটি দীর্ঘ শ্রুতিনাটক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখনো নতুন নতুন গান রচিত ও ক্যাসেটবদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি আবৃত্তির ক্যাসেটও।’২৯ তবে ১৫ আগস্টের পরে ক্যাসেটের মাধ্যমে গান-কবিতার সম্মিলনে প্রতিবাদী শিল্পচর্চা শুরু হয়েছিল।
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা’ এ ধারার একটি ক্যাসেট বের করা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এটি গ্রন্থনা করেছিলেন কবি কামাল চৌধুরী, ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সাজেদ আকবর এবং সংগীত পরিচালনায় ছিলেন লিয়াকত আলী আখন্দ।৩০ ঢাকার ‘প্রত্যয় সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন’ বের করেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দশটি গানের একটি অ্যালবাম(ক্যাসেট)। ‘ধ্রুবতারা তুমি দেখাও নিশানা’ নামের গানগুলোর কথা ও সুর ড. এস. কে. চৌধুরীর। গীতিকার ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামের রচনায় ২০১০ সালে ১২টি গান নিয়ে বের হয়েছে ‘বাঙ্গালী জাতির সেরা গর্ব’ শীর্ষক ক্যাসেট। এ ধরনের আরো অনেক অ্যালবামের গানে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে।

৫. 
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকা হয়েছে। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের রঙ-তুলির আঁচড়ে বঙ্গবন্ধুকে আমরা নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখেছি। সাম্প্রতিককালে বিমূর্ত চিত্রকলার অন্যতম শিল্পী নাজমা আক্তার অনেকগুলো মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে রঙ-রেখায় শিল্পিত করে তুলেছেন। পোস্টার তৈরি হয়েছে ষাটের দশক থেকে। নতুনতর মর্যাদায় মহান নেতাকে মুক্তিযুদ্ধের পোস্টারে শিল্পীরা তুলে ধরেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গ্রন্থের প্রচ্ছদে জাতির পিতার সরব উপস্থিতি ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। গ্রন্থের প্রচ্ছদ ও পোস্টার শিল্পীরা হলেন- কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, সমর মজুমদার, সৈয়দ ইকবাল ও ধ্রুব এষ প্রমুখ। শিল্পীরা সৃজনশীল মাধ্যমে জাতির পিতার সৌম্যময় দৈহিক অবয়ব ও মুখের অভিব্যক্তিতে নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

জাতির জনকের বিভিন্ন সময়ের আলোচনা ও বক্তৃতা থেকে ১৬টি কথার সঙ্গে ১৬ জন শিল্পীর আঁকা ছবি আছে শুভেচ্ছা পত্র-১ সিরিজে।৩১ এই শিল্পীরা হলেন- কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ ইকবাল, ফরিদা জামান, সামসুদ্দোহা শেখ আফজাল, কনকচাঁপা চাকমা, রব্বানী শামীম, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, আবদুল মোমেন মিল্টন, এস কে মেহেদী কামাল, সোহাগ পারভেজ। শাহাবুদ্দিন আহমেদ অঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত তেজে দাঁড়িয়ে থাকা তেলরঙের ছবিটি অনন্য সাধারণ। শাহাবুদ্দিন থেকে শুরু করে কাইয়ুম চৌধুরী, বীরেন সোম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, সৈয়দ ইকবালের ছবিতে চশমাহীন বঙ্গবন্ধুর মুখ-অবয়ব চিত্রিত হয়েছে। এর মধ্যে সৈয়দ ইকবাল বঙ্গবন্ধুর তাকিয়ে থাকার পাশে কবুতর ও বাংলাদেশের পতাকা স্থাপন করায় ‘আমি বিশ্বাস করি না ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি, ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে’- এই ভাষণের অনিবার্যতাকে প্রকাশ করেছে। কনকচাঁপার চিত্রকর্মে বঙ্গবন্ধু ভিন্ন মাত্রায় উদ্ভাসিত। তিনি জাতির পিতার তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণের ভঙ্গিটি ঠিক রেখে পুরো কম্পোজিশনে আরো অনেককিছু প্রদর্শন করেছেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও জনতার রেখাগুলো তাৎপর্য নিয়ে অঙ্কিত।

একইভাবে জাতির জনকের বিভিন্ন সময়ের আলোচনা ও বক্তৃতা থেকে ১৬টি কথার সঙ্গে ১৪ জন শিল্পীর আঁকা ছবি আছে শুভেচ্ছা পত্র-২ সিরিজে।৩২ এই শিল্পীরা হলেন- কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, বীরেন সোম, রব্বানী শামীম, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, রবিউল ইসলাম, আবদুল মোমেন মিল্টন, এস কে মেহেদী কামাল, মাতুরাম চৌধুরী, মো. মাঈনউদ্দীন, সুমন বৈদ্য, রাসেল কান্তি দাস, অমিত নন্দী। কাইয়ুম চৌধুরী স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কথার সঙ্গে মিল রেখে তাঁর প্রতিকৃতি আঁকতে গিয়ে প্রাজ্ঞ পরিণত চেহারার চিত্র উপহার দিয়েছেন। শিশুদের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়েছেন হাশেম খান। শান্তির কপোত উড়ানো বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন রফিকুন নবী। বীরেন সোম অঙ্কিত তর্জনি উঁচানো বঙ্গবন্ধুর ছবিটি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে প্রত্যেক শিল্পী অন্তর্গত তাগিদ থেকে চিত্রগুলো অঙ্কন করেছেন।

‘বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের প্রতীক’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমীতে ২০১২ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত। ১৩ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীতে পোর্ট্রেট শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো চিত্র প্রদর্শিত হয়। পেপার এবং ক্যানভাসে ৪০টি শিল্পকর্মে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপস্থাপনা ছিল তাৎপর্যবহ। ছবিগুলোতে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়বের দৃঢ়তা এবং সাহসী অভিব্যক্তি চিত্রিত হয়েছে। শিল্পী বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টির গভীরতা ও চিন্তার গাম্ভীর্যকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু ছবি আছে যাতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন মুহূর্তের স্মরণীয় প্রকাশভঙ্গী ও বিরল চাহনি অঙ্কিত হয়েছে। কিছু স্কেচে কিছুটা বাস্তববাদ ও অনুপুঙ্খ মুখাবয়ব চিত্রিত হয়েছে। মূলত শিল্পী বঙ্গবন্ধু চরিত্রের বহুমাত্রিকতাকে ধরতে চেয়েছেন বহুকৌণিক প্রকাশভঙ্গিতে।

ঢাকা আর্ট সেন্টারে ‘জাগো অন্তর মম’ শিরোনাম দিয়ে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট প্রদর্শিত হয়েছে ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু চিত্রকলা। দেশের বিখ্যাত এবং নতুন শিল্পীর ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পায়। বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রণজিৎ দাস, খালিদ মাহমুদ, নাইমা হক, মাসুদা খানম প্রমুখ চিত্রশিল্পীর ছবি এখানে ছিল। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো হয়; যিনি তাঁর জীবদ্দশায় কিংবদন্তি ছিলেন। এসব শিল্পীরা বিশ্বাস করেন তিনি বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একীভূত সত্তা। শিল্পীরা তাঁর ছবি এঁকে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন। তাঁরা নিজের অস্তিত্বে বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করেছেন। প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একইসঙ্গে দেখানো হয়েছে তিনি শ্রমজীবী এবং বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিভিন্ন শিল্পী তাঁকে বিচিত্রভাবে অঙ্কন করেছেন। কেউ কেউ তাঁর ধ্যানমগ্ন, চিন্তাশীল মুখমণ্ডল, কেউ বা তাঁর চোখের জ্যোতি ধরতে চেয়েছেন ক্যানভাসে। তাছাড়া জাতির পিতার নির্ভীক মুহূর্তগুলো ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। তেল রঙ, এ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, মিক্সড মিডিয়া, জলরঙ প্রভৃতি মাধ্যম ও আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। এখানে মনে রাখা দরকার অধিকাংশ শিল্পীদের চিত্রকলার মূল প্রেরণা বা অবলম্বন ছিল বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্রসমূহ। বিভিন্ন বয়সের, বিচিত্র মাধ্যমের কাজ ও একটি বিষয়ে আলোকপাত ছিল এই প্রদর্শনীর মূল বৈশিষ্ট্য।

প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া আহমেদ শামসুদ্দোহার চিত্রে বঙ্গবন্ধুর জনতার উদ্দেশ্যে পরিচিত অভিবাদনের ভঙ্গি আছে। ক্যানভাসের ফোকাল পয়েন্টে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। শেখ আফজালের চিত্রে মহান নেতাকে দেখা যাচ্ছে একজন ক্ষুদে বালকের সঙ্গে কথা বলতে। মোহাম্মদ ইকবালের কালো, ধূসর আর পরিচিত আলোছায়ায় নেতার চিন্তান্বিত অবয়ব ধরা পড়েছে। অন্য একটি চিত্রে জাতির পিতা পাইপ মুখে ধোয়া উড়ছে, লাল এবং কালো রঙ ব্যবহৃত হয়েছে এখানে। বঙ্গবন্ধুর চোখকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন এই শিল্পী। আনিসুর রহমানের চিত্রে স্পেস একটা প্রধান বিষয়। তাঁর চিত্রকলায় লাল এবং কালোর ব্যঞ্জনায় চিত্রের বুননে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। নাজিব মোহাম্মদের ক্যানভাসের মাঝখানে বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র মানচিত্র ও হিজিবিজি কালির আঁচড় লক্ষণীয়। এভাবে অজস্র চিত্রে বঙ্গবন্ধু এখন মহিমান্বিত একটি নাম।

৬. 
ম্যুরাল ও ভাস্কর্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এখন জনগণের কাছে পরিচিত একটি চেতনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জাতির পিতার প্রতিকৃতি ধ্বংস করা হয়েছিল, নষ্ট করা হয়েছিল তাঁর যাবতীয় নিদর্শন। সেসবের পুনর্স্থাপন আবার শুরু হয়েছে। যেমন, ১৯ এপ্রিল ২০১১ সালে মহাজোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বিল্ডিং-এ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন লনে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি ম্যুরাল। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনে যান এবং কৃষিতে ডিগ্রিধারীদের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন। এখানে ম্যুরালের মূল অবয়বে একটি প্রতিকৃতি এবং নিচে কবিতার চরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ২০১২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি ম্যুরাল। বাংলাদেশ জাতীয় স্টেডিয়ামে স্থাপিত ম্যুরালটি নির্মাণ করেছে জাতীয় স্পোর্টস কাউন্সিল। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে দৃষ্টিনন্দন আরেকটি ম্যুরাল উন্মোচিত হয়েছে। সিটি মেয়রের উদ্যোগে দশ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ম্যুরালটি সে অঞ্চলের জনগণের ভালোবাসার নিদর্শন। এভাবে বঙ্গবন্ধু তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছেন।

সোনারগাঁও জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। ৩৫ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ ধাতু নির্মিত ভাস্কর্যটি ৭ মার্চের ভাষণের প্রেরণা থেকে উপস্থাপিত। যা সাধারণ মানুষকে এখনো প্রদীপ্ত করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি(২০১২) এটি উদ্বোধন করা হয়। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ একটি ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। শামীম সিকদারের ডিজাইনে এটি নির্মিত। বঙ্গবন্ধু স্মরণে ২০০৬ সালের ৭ আগস্ট উদ্বোধন করা হয় ঢাকার গুলিস্তান ক্রসিং-এ স্থাপিত ‘বঙ্গবন্ধু স্কোয়ার মনুমেন্ট’। ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই পাড়ে স্থাপিত হয়েছে জাতির পিতার বিশাল প্রতিকৃতি। ভৈরবের কমলপুর বাস স্ট্যান্ডে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে। শামীম সিকদার জগন্নাথ হল, উদয়ন স্কুল ও এস এম হলের কোল ঘেঁষে অনেকগুলো ভাস্কর্য স্থাপন করেছেন। তার মধ্যে জাতির পিতার অবয়ব সুউচ্চ। তাঁর মাথার ওপর দেশের পতাকা উড়ছে। শিখা চিরন্তনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে স্বাধীনতা চত্বরে রয়েছে পোড়ামাটির ম্যুরাল; মুক্তিযুদ্ধের চিত্রণের ভেতর বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক প্রতিকৃতি রয়েছে এখানে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণাধীন স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিবৃত করা হয়েছে ম্যুরালের মাধ্যমে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্বমহিমায় স্থান পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালায় বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরাল ও একটি স্থাপত্য রয়েছে। আর বত্রিশ নম্বর ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ কিংবা টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধি ক্ষেত্রের ম্যুরাল বহুল প্রচারিত, দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম। এছাড়া ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে ভাষণদানরত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।  

৭. 
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘পলাশি থেকে ধানমণ্ডি’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত একমাত্র মঞ্চ নাটক। এটি প্রথম অভিনীত হয় ২০০৪ সালে লন্ডনে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে নাটক লেখার পরিকল্পনা ছিল তাঁর অনেক আগে থেকেই। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর লন্ডনের ‘বাংলার ডাক’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় ‘মুজিব হত্যার নেপথ্যে’ নামে একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ লেখেন। পরে এটি ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ : ১৫ আগস্ট পঁচাত্তর’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটির কাহিনি নিয়ে নাটক ‘পলাশি থেকে ধানমণ্ডি’র সৃষ্টি। তিনি লিখেছেন, ‘পলাশির যুদ্ধ ও সিরাজউদ্দৌল্লাকে হত্যার ঘটনা নিয়ে নাটক লেখা হয়েছিল ঘটনার পৌনে দু’শ বছর পর। আমি বঙ্গবন্ধু-হত্যা নিয়ে এই নাটক লিখেছি ঘটনার মাত্র ঊনত্রিশ বছর পর। এই কাহিনির অনেক চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন। ফলে আমাকে অনেক সতর্কতার সঙ্গে ঘটনা-বিন্যাস ঘটনাতে হয়েছে। যতদূর সম্ভব আমি বাস্তব সত্যের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি।

এ জন্যে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা(কারণ আমি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলাম), নিজের সংগৃহীত তথ্য, নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য এবং বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার যে রায় প্রকাশিত হয়েছে তার উপর নির্ভর করেছি। ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনো চরিত্রকে উজ্জ্বল বা মসিমলিন করার চেষ্টা করিনি। সেদিক থেকে এটিকে একটি ডকুড্রামা বলা চলে। তবে সম্মিলিত পাঠকদের আমি সতর্ক করে নিচ্ছি যে, এটি বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ জীবন-ভিত্তিক নাটক নয়। এটি তার মর্মান্তিক হত্যা সম্পর্কিত নাটক। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ও সম্পূর্ণ জীবন-ভিত্তিক নাটক রচনার ইচ্ছা আমার আছে।’৩৩

১৭৫৭ সালের জুন মাসের পলাশি-ট্রাজেডির মতোই বিয়োগান্ত নাটক অভিনীত হয়েছে ১৯৭৫ সালের আগস্টে স্বাধীন বাংলাদেশে। সিরাজের পরিণতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণ সাদৃশ্যপূর্ণ। ঘটনা ও চরিত্রের মিলও অনিবার্য। খোন্দকার মোশতাক আহমদের চরিত্রের সঙ্গে মীর জাফরের চরিত্রের এবং ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সঙ্গে সিরাজের দরবারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি রবার্ট ক্লাইভের চরিত্রেরও মিল রয়েছে। পলাশির যুদ্ধের পর তখনকার বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা যেমন স্বাধীনতা হারিয়েছিল তেমনি ধানমণ্ডি হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এজন্যই এই নাটকের নাম ‘পলাশি থেকে ধানমণ্ডি’ যথার্থ।

নাটকটি পনেরটি দৃশ্যে রচিত। প্রথম দৃশ্যে সিরাজ ও বঙ্গবন্ধুর কথোপকথনের বিন্যাস রয়েছে। সিরাজ বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, বাংলাদেশে পলাশির বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।(পৃ ২০) যুগে যুগে বিভিন্ন বেশে ভণ্ড, শয়তান, প্রতারকরা পৃথিবীতে জন্ম নেয়, তারাই বিচিত্র দেশে অভিন্ন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দৃশ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এভাবে দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা একই সমান্তরালে বিন্যস্ত করেছেন। পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় দৃশ্য থেকে অন্যান্য দৃশ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে খোন্দকার মোশতাক গ্যাংদের কর্ম তৎপরতা এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন ও তাঁর পাশে বেগম মুজিব-শেখ হাসিনাসহ কিছু চরিত্রের উদ্ভাসন লক্ষ করা যায়।

অপরদিকে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বীরাঙ্গনা কুলসুম ও সৈনিক জাহান চরিত্রের নির্মম মৃত্যু ঘটনা নাট্যকাহিনির জটিল আবর্ত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। দৃশ্যের পর দৃশ্য উন্মোচনে জিয়াউর রহমানসহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের চিনতে যেমন সুবিধা হয় তেমনি জাতির পিতা কেন্দ্রিক ঘটনাগুলো মানবিক হয়ে উঠেছে। সংসারের ছোট ছোট বিষয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নানা প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে এ নাটকে; যেখানে প্রেম-দ্রোহ-মমতা ও মঙ্গল কামনায় উজ্জীবিত একদল শ্রেষ্ঠ মানুষের কথাও শুনতে পাই আমরা। তবে দেশি-বিদেশি রাষ্ট্রের আগ্রহ ও ষড়যন্ত্রের জটিল আবর্তে জিয়া, ফারুক আর মোশতাকের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত হয় আমাদের। তাদের আচরণ দেখে ও তাদের সংলাপ শুনে নিষ্ঠুর মানুষদের চিত্র আমরা স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখি। তেমনি কয়েকটি দৃশ্যে সাধারণ মানুষ(সপ্তম দৃশ্য) এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী কিংবা অপপ্রচারে বিশ্বাসী ধর্মাশ্রিত ইমামদের চরিত্রও(নবম দৃশ্য) জীবন্ত করে তুলেছেন নাট্যকার। অন্যদিকে কর্নেল তাহের অনুকম্পা পেয়েছেন নাট্যকারের। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিঃস্বার্থভাবেই ভালোবাসতেন। আবার বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের কথোপকথন থেকে দেশের প্রশাসনের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা বিরোধী পক্ষের অবস্থানও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। একটি অংশ-

তাজউদ্দীন: এবারের যুদ্ধ অনেক বেশি কঠিন লীডার। একাত্তরের যুদ্ধ ছিলো একটা বিদেশি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এবারের যুদ্ধ একসঙ্গে অনেক শত্রুর বিরুদ্ধে। এই শত্রুরা আপনার প্রশাসনের মধ্যেও ঘাঁটি গেড়েছে।

বঙ্গবন্ধু: আমি কি তা বুঝি না? সরকারি আমলা, পুলিশ—এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও এরা ঢুকে গেছে। তা না হলে দেশময় সন্ত্রাস চলছে, পুলিশ তাদের ধরতে পারে না? দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায় মানুষের জন্য বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে খাদ্য, বস্ত্র, ওষধ আনি, সেগুলো গরীব দুঃখীকে না দিয়ে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়?(পৃ ১৩১)

এই পরিস্থিতি উত্তরণে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত জানান বঙ্গবন্ধু কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার আগেই তাঁকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। মূলত ১৭৫৭ সালের পলাশি চক্রান্তের খলনায়করাই ১৯৭৫ সালে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল তারই নাট্যরূপ দৃশ্যায়ন করেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর ‘পলাশি থেকে ধানমণ্ডি’তে। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাস্তব চরিত্রের মুখে যে সংলাপ নির্মাণ করেছেন তাতেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রয়েছে। এমনকি মোশতাক ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের কথায় তুলে ধরেছেন ইতিহাসের পারম্পর্যকে। তাহের ঠাকুরের দু’টি সংলাপ-

ক) (আত্মগত ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে) ইতিহাসের কি বিচিত্র পুনরাবৃত্তি। ইতিহাসে পড়েছি, দু’শ বছর আগে এই আগামাসি লেনের একটি বাড়িতে গোপন বৈঠক সিরাজউদ্দৌল্লা বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আজ সেই একই এলাকায় আমরা এক হয়েছি আরেক ষড়যন্ত্রের খেলায়।(পৃ ৩৫)

খ) (আবার আত্মগত ভাবে) ইতিহাস বলে, দু’শ বছর আগে লর্ড ক্লাইভ নারীবেশে পাল্কিতে চেপে মুর্শিদাবাদের মীর জাফরের গোপন বৈঠকে যেতেন। আজ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বোস্টার এসেছেন আমাদের বৈঠকে একই নারী বেশে।(পৃ ৩৬)

চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরার প্রয়াস একেবারে সাম্প্রতিক। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ‘পলাশি থেকে ধানমণ্ডি’ মঞ্চ নাটকটি চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাহিনি, সংলাপ ও পরিচালনা করেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। পলাশির প্রান্তরে পরাজয়ের পর নবাব সিরাজদ্দৌলার নির্মম মৃত্যু হয়েছিল তাঁর স্বদেশীয় কিছু লোভী ও ষড়যন্ত্রকারী কাছের মানুষের দ্বারা। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মদদ তো ছিলই তার পিছনে। নবাবের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসন নিয়ে শুরু হয় আরো অনেক ষড়যন্ত্র, হত্যা আর ক্যু। সিরাজের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রকার বিষয়টিকে সেভাবেই উপস্থাপন করেছেন।

‘চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে। যেখানে জাতির পিতার জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনা ও কর্ম তুলে ধরা হয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সিদ্ধান্ত জানা যায় হলিউডে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইংরেজিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হবে। ‘গান্ধী’ ছবির অনুরূপ একটি ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে সাব-টাইটেলে বাংলাসহ হিন্দি, ফরাসি, স্প্যানিশ, রুশ, চীনা, কোরিয়ান, হিব্রু, আরবি থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন, রাজনীতি, হত্যাকাণ্ড ও বিচার সবই এখানে তুলে ধরা হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে চলচ্চিত্রের গল্প সংগ্রহ শেষ পর্যায়ে; ৭০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রটির। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এটির মূল উদ্যোক্তা। বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শুরু হবে এর কাহিনি। আন্তর্জাতিক এই চলচ্চিত্রের নাম হবে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’(রাজনীতির কবি)। ৮০টির মতো চরিত্রের সমাবেশ ঘটবে এখানে। এ ছবি তথ্যবহুল এবং সামগ্রিক বিন্যাসে অনন্য হবে।

ভারতের হায়দ্রাবাদে ইনডোর এবং গোপালগঞ্জে আউটডোর শুটিং হবে বলে জানা গেছে। পূর্বে আলোচিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রের মতো আরো কিছু মঞ্চনাটকে বঙ্গবন্ধু উন্মোচিত হয়েছেন, যাত্রাতেও। তবে সংখ্যায় কম। সৈয়দ শামসুল হকের ‘গণনায়ক’(১৯৭৬) এর মধ্যে অন্যতম। এই নাটকে তিনি উইলিয়াম শেকসপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’-এর ট্রাজিক ঘটনার অন্তর্নিহিত সত্যের সংবাদ দেওয়ার জন্যই বঙ্গদেশীয় পটভূমি ব্যবহার করেছেন।৩৪ নাটকে রাষ্ট্রপতি ওসমানকে খুনের যে পরিপ্রেক্ষিত নির্মিত হয়েছে তা বঙ্গবন্ধুর ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মমতাজউদদীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ (এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম) ১৯৭১ সালের রচনা এবং বঙ্গবন্ধুর কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও সেই আন্দোলনের শিরায় আন্দোলিত।৩৫

৮.
মুদ্রণশিল্পের মধ্যে ডাকটিকেটে বঙ্গবন্ধু চিত্রিত হয়েছেন বহুবর্ণিলরূপে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর ব্রিটেনের সাবেক পোস্টমাস্টার জেনারেল ও মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ সেখানে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় বাংলাদেশ সরকারের ডাকটিকেট প্রকাশের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। ২৬ জুলাই ১৯৭১ কলকাতা ও লন্ডনের বাংলাদেশ মিশনের উদ্যোগে ডাকটিকেট প্রকাশের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৯ জুলাই কলকাতা ও লন্ডন থেকে একসঙ্গে ৮টি ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। ১০ পয়সা থেকে শুরু করে ১০ রুপি মূল্যমানের টিকেট বাজারে ছাড়া হয়। ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রথম সিরিজের ৮টি ডাকটিকেটের মধ্যে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করা হয়। ডিজাইন করেন বিমান মল্লিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিসহ ৫টাকা মূল্যমানের ডাকটিকেটটি ছিল আকর্ষণীয়। টিকেটের ওপরের অংশে ‘বাংলা দেশ’ শব্দটি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ছিল। এ দুয়ের মাঝখানে ‘পোস্টেজ রেভিনিউ’ শব্দ এবং ডানে ৫রুপি অঙ্কিত। নিচের অংশে সোনালি জমিনের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধুর সাদা-কালো ছবি, ছবির বামদিকে সাদা কালিতে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখা ছিল।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ পোস্টকার্ড ছাপানো হয়। মুদ্রিত হয় ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। হালকা হলুদে সবুজ পোস্টকার্ডের আকার ছিল ৮৮x১৪০ এম. এম। একই সময় জাতির পিতার ছবিসহ বিমান ডাকের ২০, ৩০, ৭৫ ও ৯০ পয়সা মূল্যের ৪টি এ্যারোগ্রাম মুদ্রিত হয়। এগুলোর ডিজাইন করেন শিল্পী কাজী মুস্তাফা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে বিচিত্রভাবে। ১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে প্রকাশ করা হয় ৪টাকা মূল্যের বর্ণিল ডাকটিকেট। এটির মূল রঙ ছিল কালো এবং সবুজ সাদা। অলংকরণ করেন মো. মতিউর রহমান। ছাপা হয় দেশের গাজীপুরস্থ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। ১৯৯৭ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক দিবসটি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দানরত অবস্থার ছবিসহ ৪ টাকা মূল্যের ডাকটিকেট বাজারে ছাড়া হয়।

আনোয়ার হোসেনের ডিজাইন করা এতে মুজিবকোট পরিহিত এবং ডান হাত ওঠানো বঙ্গবন্ধুর ভাষণদানের ছবি মুদ্রিত। এটির মাপ ছিল ৪৮x৩২ এম. এম। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে ৪টাকার ডাকটিকেট সাদা সবুজ ও লাল মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল অবয়ব দিয়ে মুদ্রিত হয়। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর তর্জনি উঁচানো লাল-সবুজের পতাকায় শোভিত প্রতিকৃতি নিয়ে ৪টাকা মূল্যের আরো একটি ডাকটিকেট প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর চেতনা তৃণমূলে এভাবে ছড়িয়ে যায়। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবমুক্ত করেন স্মারক ডাকটিকেট। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ৩ টাকা মূল্যের একটি ডাকটিকেট প্রকাশিত হয় সে সময়। লাল-সবুজ ও গোলাপি রঙে আঁকা টিকেটে রয়েছে জাতির পিতার তর্জনি। প্রতিকৃতির পিছনে একাত্তরের মানচিত্রের দৃশ্যপট। এখানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দানরত ও কিছু মানুষের আবছা অবয়ব সমবেত জনতার অংশ হিসেবে চিত্রিত।৩৬ 

৯. 
এভাবে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিস্তৃত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমে আন্তরিকতা, সচেতনতা এবং নান্দনিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিল্পের মধ্য দিয়ে দেশ ও জনতার প্রতি এই মহামানবের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ শিল্প-আস্বাদনকারীদেরও তৃপ্ত করেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির দর্শন ছিল ভালোবাসা, মানবপ্রেম - ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’৩৭ জাতির পিতার এই ভাবনাকেই শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে দেখেছি আমরা। 
(বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ছিল শুক্রবার। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধুর জীবন-কর্মের উপস্থিতি, চর্চা ও মূল্যায়ন নিয়ে আমাদের এই আয়োজন। আজ প্রকাশিত হল দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি)

 তথ্যনির্দেশ ও টীকা 
১.মোনায়েম সরকার[সম্পা.], বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, ১ম ও ২য় খণ্ড, (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০৮), প্রথম অধ্যায়

২. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, (ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২), পৃ ৪৭-৪৮

৩. ড. সুনীল কান্তি দে[সম্পা.], বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র, (ঢাকা: অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০১০), দ্রষ্টব্য পুরো গ্রন্থ

৪. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ১০৩ 

৫. মোনায়েম সরকার[সম্পা.], বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, প্রাগুক্ত, দ্রষ্টব্য: ১ম ও ২য় খণ্ড

৬. দ্রষ্টব্য: প্রাগুক্ত

৭. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ২০৯-১০ 

৮. দ্রষ্টব্য: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত

৯. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ১০৯

১০. দ্রষ্টব্য: Koyel Chakrabarty, 2007, “Gandhian Influence on Indian Writing in English: An assessment of the effects of developmental Communication, as used in the Political Campaigns by Gandhiji, portrayed by the Contemporary Indian English Novelists.”, Journal of Hooghly Mohsin Govt. College, Chinsurah, West Bengal, Vol-3; ISSN: 0973-6212.

১১. ‘শিল্প কী’ অধ্যায়ে কান্ট ও হেগেলের শিল্পের জগতকে তিনভাগে ভাগ করতে দেখা যায়। কান্টের বিভাজনে রূপশিল্প অংশে- মূর্তিশিল্প যথাক্রমে -ভাস্কর্য, স্থাপত্য, অন্যদিকে চিত্র এবং বাহ্যেন্দ্রিয়বেদ্য শিল্পের মধ্যে সংগীত ও বর্ণশিল্প উল্লিখিত। বাকশিল্পে কবিতা ও বাগ্মিতা। বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য-বিবেক, (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮৯), পৃ ১৭

১২. অন্নদাশঙ্কর রায়, ‘‘ইন্দ্রপাত’’, শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ(১৯৭৯), মোনায়েম সরকার ও অন্যান্য সম্পাদিত, (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১০), পৃ ২১

১৩. গোলাম শফিক, ‘‘লোকসংগীত ও বঙ্গবন্ধু’’, সচিত্র বাংলাদেশ, (ঢাকা: চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, আগস্ট ২০১২), পৃ ৮

১৪. প্রাগুক্ত, পৃ ১১

১৫. গান ও স্বরলিপি, কবিতায় বঙ্গবন্ধু, (ঢাকা: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ২০১২), পৃ ৮৫

১৬. প্রাগুক্ত, পৃ ৯০

১৭. গোলাম শফিক, প্রাগুক্ত, পৃ ১১

১৮. গান ও স্বরলিপি, কবিতায় বঙ্গবন্ধু, প্রাগুক্ত, পৃ ৮১

১৯. গোলাম শফিক, প্রাগুক্ত, পৃ ১০

২০. গান ও স্বরলিপি, কবিতায় বঙ্গবন্ধু, প্রাগুক্ত, পৃ ৯২

২১. আবুবকর সিদ্দিক, রুদ্রপদাবলী: গণমানুষের গান, (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৮), পৃ ১০৩

২২. গান ও স্বরলিপি, কবিতায় বঙ্গবন্ধু, প্রাগুক্ত, পৃ ৯৫

২৩. প্রাগুক্ত, পৃ ৯৪

২৪. প্রাগুক্ত, পৃ ৯৬

২৫. আখতার হুসেন, দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু, (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৫), পৃ ২১৬

২৬. প্রাগুক্ত, পৃ ২১৪

২৭. প্রাগুক্ত, পৃ ২১৩

২৮. শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ(১৯৭৯), প্রাগুক্ত, পৃ ৫৪

২৯. আখতার হুসেন, প্রাগুক্ত, পৃ ১৯

৩০. ড. মোহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ: প্রথম মিছিল প্রথম সাহিত্য প্রতিক্রিয়া, (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১০), পৃ ৫৭

৩১. সম্পাদক হাশেম খান, (ঢাকা: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ২০১১)

৩২. প্রাগুক্ত

৩৩. ভূমিকা, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, পলাশি থেকে ধানমণ্ডি, (ঢাকা: জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ২০১১), পৃ ১০

৩৪. সবিনয় নিবেদন, সৈয়দ শামসুল হক, কাব্যনাট্য সংগ্রহ, (ঢাকা: চারুলিপি প্রকাশ, ২০০৬), পৃ ২২৯

৩৫. সৈয়দ শামসুল হক ও রশীদ হায়দার সম্পাদিত, শতবর্ষের নাটক(২য় খণ্ড), (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪), পৃ ৪৯৭-৫৪৪

৩৬. পল্লব ইয়াসির, ‘‘পোস্টকার্ড এ্যারোগ্রাম ও ডাকটিকিটে বঙ্গবন্ধু’’, নবারুণ, (ঢাকা: চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, জুলাই-আগস্ট ২০১১), পৃ ৩২-৩৩

৩৭. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, (ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২), ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা থেকে গ্রন্থপঞ্জি

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, (ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২)

কবিতায় বঙ্গবন্ধু, বেলাল চৌধুরী ও অন্যান্য সম্পাদিত, (ঢাকা: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ২০১২)

দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু, আখতার হুসেন সম্পাদিত, (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৫)

পলাশি থেকে ধানমন্ডি, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, (ঢাকা: জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ২০১১)

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক  ও পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

SUMMARY

820-4.jpg