কাজল রশীদ শাহীন
প্রত্যয় ছাড়া সম্ভব নয় মহৎ কোনো কিছু অর্জন। বাঙালি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেটা ছিল বলেই হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে যে অর্জন সম্ভব হয়নি, তাঁর নেতৃত্বে সেই অধরা অর্জন হয়েছে সম্ভব। যে কোনো ব্যক্তি, রাজনীতিক ও দেশপ্রেমিকের চেয়ে তার ব্যতিক্রমিতা হলো- তিনি প্রত্যয়ী ছিলেন। যাকে আমরা বলতে পারি নিজ বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, সংশপ্তকের ভূমিকা পালন করা।
বঙ্গবন্ধু মানুষের অধিকার আদায় ও পূরণে কতটা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর পক্ষপাত, নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা ছিল কতটা- তা এ লেখায় আমরা তাঁর দেওয়া কতিপয় বক্তব্যের আলোকে চেষ্টা করব উপস্থাপন করার। জন অধিকার পূরণে সক্রিয় ও সোচ্চার হওয়ার গুণ বা বৈশিষ্ট্য তার ছাত্রজীবন তথা মাধ্যমিকেই হয়েছিল উন্মোচিত।
পাকিস্তানের ২৪ বছরের জিঞ্জিরে বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে কারান্তরে। জেলগেট থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে অন্য মামলায় আবার করা হয়েছে গ্রেপ্তার। তবুও তিনি কখনই করেননি আপস। মুচলেকা দিয়ে মুক্তির সুযোগ এসেছে অজস্রবার, কিন্তু সেসবে করেননি ভ্রক্ষেপ।
নিজের চাওয়া, স্বপ্নের প্রতি থেকেছেন অবিচল। আর বিরল এই গুণই তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উষ্ণীষ দেওয়ার পর জাতির জনকের মহিমা ও মর্যাদায় করেছে অধিষ্ঠিত। বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের স্বতন্ত্র ঠিকানা।
পৃথিবীর যে সব জাতির জনক রয়েছেন, তাদের জীবন-কর্ম ও আত্মত্যাগের প্রতি দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন জাতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ। এক্ষণে আমরা স্মরণ করতে পারি মেক্সিকো ও ভারতের জাতির জনকের দুটি অমূল্য উক্তি।
মিগুয়েল হিডালগো মেক্সিকোর স্বাধীনতার জন্য অসাধারণ ভূমিকা ও অবিশ্বাস্য আত্মত্যাগের কারণে মেক্সিকানদের কাছে জাতির জনক এবং মেক্সিকোর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত ও সর্বজনস্বীকৃত। ঊনবিংশ শতকের প্রারম্ভে মিগুয়েল হিডালগোর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনই মেক্সিকো স্পেন থেকে লাভ করে স্বাধীনতা।
স্পেনের অন্যায়-অবিচার ও নিষ্ঠুরতা এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে হিডালগো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পরিবর্তে শুরু করেন সশস্ত্র ও সংঘাতমূলক রাজনীতি। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন:
‘যেভাবে হোক, দখলদার অপশক্তির নৃশংস থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে, তাড়াতে হবে সাম্রাজ্যবাদী শকুন, হয় স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু।’
১৮১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিডালগো এক বক্তৃতায় বলেন, ‘মেক্সিকানরাই মেক্সিকো শাসন করবে। কোনো বৈদেশিক শক্তি নয়।’
হিডালগোর মৃত্যুর একশ বছরের অধিক সময় পর বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর সংগ্রামের সঙ্গে অতি সহজেই সমান্তরাল একটা রেখা টানা যায়। বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বক্তৃতার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয় যে, তিনি হিডালগোর মতোই হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় নেতার প্রতিভূ। বিশেষ করে সময়, পরিস্থিতি, ভৌগোলিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার আলোকে হিডালগোর বক্তৃতার সাথে বিস্ময়কর রকমের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি চর্চায়, কর্মে ও বক্তৃতামালায়।
হিডালগো যেমন বলেছিলেন, হয় স্বাধীনতা নয় মৃত্যু। বঙ্গবন্ধু তেমন বলেছিলেন: ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।’
এ যেন ভিন্ন ভিন্ন স্থান ও সময়ে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করছেন একই উক্তি। একই ইশতেহারেই তাঁরা একাগ্র ও অবিচল। তবে একথাও মনে রাখতে হবে সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংশপ্তকের ভূমিকা পালন করলেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে কখনই বিচ্যুত হননি।
সশস্ত্র ও সংঘাতমূলক রাজনীতির পথে মাড়াননি পা। সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে থেকেই সশস্ত্র এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে করেছেন বাস্তবায়ন, দিয়েছেন সফল ও সার্থক এক পরিণতি।
ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট ‘Quit India’ শিরোনামে দেওয়া এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেন:
‘আজ আমাদের বৈরিতা ব্রিটিশ জনগণের সাথে নয়, আমরা লড়াই করছি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশের পক্ষ থেকে ক্ষমতা প্রত্যাহারের প্রস্তাব বৈরিতার মাধ্যমে আসবে না। আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আত্মত্যাগের ও তার মূল্যবোধের পবিত্র প্রেরণাকে আহ্বান করতে পারি না যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে না পারছি।’
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায়ও একই কথার প্রকাশ ঘটেছে প্রোজ্জ্বলভাবে। মহাত্মা বলেছেন ব্রিটিশ জনগণের কথা। বঙ্গবন্ধু বলেছেন পাকিস্তানের জনগণের কথা। এভাবেই যেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতির জনকের সমান্তরালে আমরা খুঁজে পাই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি পাকিস্তান আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট প্রণীত ২১ দফা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, জনগণ তাদের ২১ দফার জন্যই ভোট দিয়েছে এবং সেই দফাসমূহের একটি হচ্ছে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। তিনি তখন থেকেই কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রার ভার অর্পণ করে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকেন।
তিনি স্বায়ত্তশাসন চাওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান কেন্দ্রের পাঞ্জাবি শাসকদের শোষণকে। এদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তারা পাকিস্তানের এক হাতকে (পশ্চিম পাকিস্তানকে) শক্তিশালী করে অপর হাতকে (পূর্ব পাকিস্তানকে) দুর্বল করছে। এই নীতি ভুল এবং এটাই দেশকে (পাকিস্তানকে) ধ্বংস করবে।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, তার অভিযোগ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিপক্ষে।
বঙ্গবন্ধু সর্বদাই গণমানুষের পক্ষে থেকে আম-জনতার চাওয়া আর তাদের অধিকার আদায়কে করেছেন রাজনীতির ব্রত। তিনি জনগণকে ভালোবাসতেন এবং তাদের কল্যাণে যে কোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকারেও ছিলেন সদা প্রস্তুত এক সংশপ্তক।
১৯৫৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন:
‘...তাঁরা (গণপরিষদ সদস্যরা) যদি সুন্দর কাপড়-চোপড় পরিধান করেন তাতে আমাদের মনে করার কিছু নেই। কিন্তু জনগণেরও তা পাওয়া দরকার। মহোদয়, প্রকৃত অবস্থাটা কী? জনগণ কাফনের কাপড় পাচ্ছে না। পূর্ব বাংলায় কবর দেওয়ার সময় সেই লাশগুলো এক টুকরো কাফনের কাপড়ও পায় না এবং সেগুলোকে হয় নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নতুবা কাফন ছাড়াই দাফন করা হয়। এই হলো গিয়ে অবস্থা।
জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়া উচিত এবং তাদের কর্মসংস্থান করা দরকার।
মহোদয়, শাসনতন্ত্রে এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি সভ্য দেশেই এসব বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়। জনগণ একস্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কাজ পাচ্ছে না। তাদের কর্মসংস্থান অবশ্যই করতে হবে। আপনারা বেতন, ভাতা কমিয়ে নিন, তাদেরকে যেভাবেই হোক চাকরি দিন।’
নিজের বেতন কম করে হলেও তিনি জনগণের কল্যাণার্থে কিছু করার তাগিদ যেমন দিচ্ছেন, তেমনি চীনের সমাজতান্ত্রিক নেতা মাও সে তুংয়ের উদাহরণ টেনে বলছেন, জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য গভর্নরের বেতন প্রয়োজনে কম দেওয়া হোক। তিনি জানাচ্ছেন চীনের মতো দেশের অভিভাবক যদি ৫শ টাকা মাসিক বেতন নিতে পারেন, তাহলে আমরা কেন আমাদের অভিভাবক তথা গভর্নরকে ৬শ টাকা দিচ্ছি। ওখানে থেকে ১শ টাকা কমিয়ে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য দিয়েছেন জোর তাগিদ ও উদাত্ত আহ্বান। এই ঘটনার নিরিখে যেমন বঙ্গবন্ধুর জনগণের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতার নজির পাওয়া যায়- তেমনি দৃষ্টান্ত মেলে ছাত্রজীবনের একটি ঘটনাতেও।
তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশে ধর্মঘট ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে তাঁকে জরিমানা করে। তিনি এ অন্যায় নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। বঙ্গবন্ধুর এই ত্যাগও প্রকারান্তরে জনগণের জন্যই। এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয়, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে আমাদের বন্ধু নয়, তা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর যত দিন গেছে তত স্পষ্ট করে হয়েছে প্রতিভাত। তাদের কূটকৌশল ও চক্রান্ত শেখ মুজিব পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্নেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল যৌক্তিক। যার অকাট্য প্রমাণ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। যে স্বপ্ন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে প্রথম দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে প্রায় দুই যুগ অপেক্ষা করার পর, নানামুখী লড়াই আর সংগ্রাম শেষে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুই হলেন অনন্য এক রাজনীতিক যিনি অহিংস উপায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে জনমত সংগঠিত করেছেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন।
জনমতকে সংগঠিত করে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ প্রতিহত করেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন। যেমন স্বপ্ন একদিন দেখেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮)। ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ শিরোনামে ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে দুই লক্ষ নিগ্রো শ্বেতাঙ্গের উপস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন:
‘বন্ধুগণ যদিও হতাশায় নিমগ্ন আমাদের ভবিষ্যৎ, তবুও আমি স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন আমাদের সত্তার উৎস থেকে উঠে আসা স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন প্রকৃত সত্যের মূলে- এই জাতি একদিন সোজা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের মুক্তির জন্য একসাথে রুখে দাঁড়াতে পারব এই আশায়, একদিন আমরা স্বাধীন হব। সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন সমগ্র মানুষ মুক্তির আনন্দে নতুন করে গাইবে, ‘জয় হে স্বাধীনতা।’
বঙ্গবন্ধুও তাঁর স্বদেশকে নিয়ে এরকম স্বপ্নই দেখেছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান), বাংলাভাষা আর বাঙালির সুখ-দুঃখ-স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে তাঁর জীবন ও রাজনীতি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বলেন:
‘... স্যার আপনি দেখবেন ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য।’
‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’-এর মতো বঙ্গবন্ধুও এখানে স্বপ্নের কথা বলেছেন, এ কারণেই প্রিয় জন্মভূমিকে ‘বাংলা’ নামে ডাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বাংলা নামের ঐতিহ্যের কথা বলে তার সুবর্ণ অতীতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এটাই সত্যি যে, বঙ্গবন্ধুরও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো একটা স্বপ্ন ছিল, যার পুরোটাই আবর্তিত ছিল বাংলাভাষা, বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ ও তার জনগণকে ঘিরে।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করেছিলেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে। সক্রিয় ছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। অসাম্প্রদায়িক সমাজ বাস্তবায়নের স্বপ্ন ছিল তাঁর। সেই লক্ষ্যেই তিনি ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করেন।
স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই তিনি ৬৬ সালে ৬-দফা দাবি পেশ করেন। যা ছিল প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।
স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার জন্য, সেই লক্ষ্য থেকে ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বলেন: এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। ... একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যাই নাই। ... জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।
তাত্ত্বিক ও নেতা দ্বিবিধ এই গুণের সমাহার একজন মানুষের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। অর্থাৎ বড় কোনো তাত্ত্বিকের মধ্যে খুব কমই একজন বড়মাপের সংগঠক ও নেতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আবার বড় কোনো নেতার মধ্যে একজন তাত্ত্বিক কিংবা দার্শনিক উপস্থিতি খুব কমই পরিলক্ষিত হয়।
বাঙালি জাতির সৌভাগ্য হলো- শেখ মুজিবের মতো একজন রাজনীতিবিদকে পাওয়া, যিনি একই সঙ্গে একজন বড়মাপের রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ‘পোয়েট অব পলিটিক্স।’ যার সবটাই সম্ভবপর হয়েছিল তাঁর দেশ ও জাতির প্রতি প্রত্যয়ের কারণে।
ড. কাজল রশীদ শাহীন : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক।