শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হয়ে ওঠা


গোলাম কুদ্দুছ 
ইতিহাসের এক মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। গোপালগঞ্জের এক নিভৃত পল্লীতে জন্ম নেয়া শেখ মুজিব কিভাবে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির জনকে পরিণত হলেন, তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। সাধারণ পরিবারের এ শিশু জরা-ব্যাধিকে অতিক্রান্ত করে তরুণ বয়সেই সাহসী এবং সংগ্রামী ভূমিকার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান জানান দিয়ে নেতৃত্বের সাহচর্যে চলে আসেন।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে বাঙালির অধিকার আদায়ে প্রথম থেকে শেখ মুজিব ছিলেন সোচ্চার। ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে স্বাধীনতালাভের পূর্বেই সে বিতর্ক শুরু হয়। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ এবং তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। সেই সময় লেখক আবদুল হক ও ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালো যুক্তি হাজির করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২২ দিন পর বাঙালি যুবসমাজের প্রগতিশীল অংশ ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার ১৫০, মোঘলটুলীতে এক যুব সম্মেলনের আয়োজন করে এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে।

এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% বাংলা ভাষায় কথা বলে এই হিসাব মাথায় রেখে যুবনেতা শেখ মুজিব সম্মেলনে প্রস্তাব করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অধিকাংশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। রাজশাহীর আতাউর রহমান শেখ মুজিবের এই প্রস্তাব সমর্থন করলে তা সম্মেলনে গৃহীত হয়।

ভাবলে শিহরণ জাগে যে, ধর্মের ভিত্তিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাহাড়সম জনপ্রিয়তাকে অগ্রাহ্য করে সে সময় বাংলা ভাষার পক্ষে এই ধরনের দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ একমাত্র শেখ মুজিবের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখি যে, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার নাম প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়। পূর্ববাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও বাংলার বিরোধিতা করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ায় পূর্ববাংলার সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে ছাত্র ও যুবসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গড়ে উঠে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল এবং আব্দুল গণি রোডস্থ সেক্রেটারিয়েটে (তৎকালীন ইডেন বিল্ডিং) গেটে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেবার সময় গ্রেফতার হন যুবনেতা শেখ মুজিবসহ আরও অনেকে।

প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষর করেন। শর্তানুযায়ী ১৫ মার্চ কারাগার থেকে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য বন্দিদের ছেড়ে দেয়া হয়। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সাধারণ ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবই ছিলেন সভার সভাপতি এবং একমাত্র বক্তা। এই সভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে সম্পাদিত আট দফা চুক্তিনামায় তিনটি সংশোধনী এনে তা ছাত্রসভায় পাস করিয়ে নেয়া হয়। সভা শেষে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্রদের এক জঙ্গি মিছিল পূর্ববঙ্গ পরিষদ ভবন অভিমুখে রওনা হয়। সেখানে তখন পরিষদের সভা চলছিল, পুলিশ লাঠিচার্জ করে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে পরের দিন ১৭ মার্চ ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট ও সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, পরবর্তীতে ১৯ মার্চ জিন্নাহর ঢাকায় আগমন উপলক্ষে সর্বমহলের অনুরোধে শুধু বিক্ষোভ সমাবেশ করে আপাতত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।

বাহান্নে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছুলেও আটচল্লিশেই ছিল তার সূত্রপাত। সেই সময় এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবের সাহসী ভূমিকা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তেমনভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। হয়তো তা পরবর্তীকালে বাঙালির অধিকার আন্দোলনে শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব ও ঐতিহাসিক ভূমিকার কাছে আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি আর তেমন গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসেনি। এক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যারা লিখেছেন তাঁরাও দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না।

বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে যে আপসহীন শেখ মুজিবের জন্ম হয়েছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তা অক্ষুণ্ন ছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার হন। পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষের সময় ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দান ও গ্রেফতার, চুয়ান্নয় যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন, বাষট্টির হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান— প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও আপসহীন ভূমিকা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসনামলে শেখ মুজিব প্রায় ১৩ বছর কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। কিন্তু, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে আসেননি। অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতার মোহ কিংবা ফাঁসির রজ্জু কোনো কিছুই বঙ্গবন্ধুকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। শেখ মুজিব সেই বিরল নেতা যিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নিজের কথা বাদ দিলেও স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এবং পরিবারের সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের কথা কখনো আলাদাভাবে ভাবেননি, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ভাগ্যের সাথে তাদের কাতারবন্দি করেছিলেন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী যখন কোনোভাবেই শেখ মুজিবকে বাগে আনতে পারলো না তখন বেছে নিলো অন্যপথ। দায়ের করা হলো তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। শেখ মুজিব রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত এক নম্বর আসামি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভাবলো শেখ মুজিবকে কোনোভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারলেই, সব শেষ।

বাঙালিদের শোষণ-নির্যাতনে আর কোনো বাধা থাকবে না– দাসত্বের শৃঙ্খলে অবরুদ্ধ করবে অনন্তকাল। কিন্তু, পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খান দেখলেন বাঙালির আরেক রূপ। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পুরো বাঙালি জেগে উঠলো স্ফূলিঙ্গের মতো। সৃষ্টি হলো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া— একই স্লোগান উচ্চারিত হলো, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। প্রবল আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে গেলেন আইয়ুব খান। পলায়নের রাস্তা খুঁজলেন- সাথে চক্রান্তও। প্রস্তাব এলো প্যারোলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবেন- যদি রাওয়ালপিণ্ডিতে সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। প্যারোলে মুক্তিলাভে অস্বীকার করলেন শেখ মুজিব। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।

কারামুক্তির পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ডাকসুর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে লক্ষ লক্ষ মানুষের এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তৎকালীন সভাপতি আব্দুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণের সম্পাদক শামসুদ্দোহা, পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ ও ছাত্র ফেডারেশনের একাংশের নেতা মাহবুবুল হক দোলন।

গণসংবর্ধনা সভার সভাপতি তোফায়েল আহমেদ তার ভাষণে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে কারা নির্যাতিত আপসহীন নেতা, বাঙালি জাতির দুর্দিনের পথ প্রদর্শক শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করে।

সংবর্ধনার জবাবে ৫০ মিনিটের এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে চলে যাব।’ রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খান আহুত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ নিয়ে ছাত্র নেতাদের ভিন্নমত থাকলেও কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধু বৈঠকে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেনকে।

২৬ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয় এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি সভা শেষে ১০ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাকিস্তানে বিরাজিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের আহবান জানান। তিনি ৬ দফার একটি শব্দও পরিবর্তন করতে অস্বীকার জানান। আইয়ুব খান ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তিনি ওয়াকআউট করে সোজা ঢাকায় চলে আসেন।

এইভাবে আইয়ুব খান আহুত গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সেনা প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতির ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে ১ জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা, সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর বহু প্রতিশ্রুত জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে বিজয়ী হয়ে সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন উপলক্ষে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম চলেবেই। কারণ, আমাদের মূল লক্ষ্যে আমরা এখনও পৌঁছাইনি। জনগণকে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। মানুষের উপর শোষণ, অঞ্চলের উপর অঞ্চলের শোষণের অবসান ঘটাতেই হবে। যে শক্তিশালী চক্র গত ২২ বছর ধরে পাকিস্তান শাসন করেছে, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তারা সম্ভাব্য সকল প্রকারের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এরা এইসব গোষ্ঠী যারা সাধারণ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি নির্বাচনের পরেও তারা শোষণের অবসান ঘটানোর প্রত্যেকটা প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার জন্য সক্রিয় থাকবে। তাদের অর্থ আছে, প্রভাব আছে, জনসাধারণের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মানুষ আপসহীনভাবে সাফল্যের সাথে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং শেষ পর্যন্ত জনতার জয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে’।

নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে গণরায় বানচালের যে ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তারা জানে শেখ মুজিব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব পেলে বাঙালিদের শোষণ করার সব রাস্তা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। শুরু হলো নতুন করে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া খানের সাথে এ চক্রান্তে যুক্ত হলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্রো। নানা টালবাহানার পর স্থির হয়েছিল ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু, অকস্মাৎ ১ মার্চ দুপুর বেলা রেডিওতে প্রদত্ত এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।

ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সকল বাঙালি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ থেকে রাস্তায় নেমে আসে। মিছিলে বিক্ষোভে উত্তাল সারা দেশ। বঙ্গবন্ধু সে সময় হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে ছিলেন। ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারী ঘোষণার প্রতিবাদে ২ ও ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। বিক্ষুব্ধ জনতার উপর পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলি চালায়। দেশের সর্বত্র নিহত ও আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে প্রতিদিন। এমনি উত্তাল পরিস্থিতিতে ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত আরেক ভাষণে ইয়াহিয়া খান পুনরায় ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। এটি যে একটি ষড়যন্ত্র এবং বাঙালিদের নিধন করবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ মওজুদের জন্য সময় ক্ষেপণ পরবর্তীতে বিশ্ববাসী তা বুঝতে পারে।

রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর করণীয় নির্ধারণে সামান্যতম ভুলও করেননি। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের এক জঙ্গি সমাবেশে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণাই দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

বঙ্গবন্ধু দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। প্রতিটি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলল। পূর্ব পাকিস্তানের সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, আদালত সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হয়। এমনি উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ থেকে আলোচনার নামে নতুন নাটকের সূচনা করলেন। বঙ্গবন্ধু আলোচনায় বসতে সম্মত হলেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি আলোচনায় না বসেন তবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আন্দোলন এবং স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচার চালাবে এবং তাদের বর্বর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার চেষ্টা করবে।

আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা এবং তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার থেকে একটুও ছাড় দিতে রাজি হননি- বাঙালিদের অধিকারের চাইতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁর কাছে কখনোই বড় হয়ে দেখা দেয়নি। আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হলো না। বাঙালি নিধনের নীলনকশা চূড়ান্ত করে ২৫ মার্চ বিকেল ৪টায় গোপনে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। চলতে থাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রণপ্রস্তুতি-নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পরিকল্পনা। ২৫ মার্চ শুরু হয় মানব ইতিহাসের এক বর্বর নির্মম হত্যাকাণ্ডের সূচনা। মধ্যরাতে গ্রেফতার হবার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিডিআর অয়ারলেস সেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন।

তারপরের ইতিহাস সবার জানা। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাজউদ্দিন আহম্মদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার গঠন এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তিসেনারা বিজয় অর্জন করে। গ্রেফতার করার পর ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অটল থাকেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিজয়ে অবশেষে শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়ে।

আন্তর্জাতিক চাপ ও বাংলাদেশের বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১০ জানুয়ারি পুরো জাতিকে উদ্বেলিত করে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন তার আজন্ম লালিত স্বাধীন স্বপ্নের বাংলাদেশে। সেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না, বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম- ফাঁসি কাস্টে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু, আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না । আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে।’

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির ঋণের শেষ নেই। কিশোর বয়সে যে সংগ্রামের দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। বাঙালির অধিকার, মানুষের মুক্তিই ছিল তাঁর পরম চাওয়া। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন থেকে যে সংগ্রামী আপসহীন সাহসী মুজিবের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল- পাকিস্তানি তেইশ বছরের শাসনামলে শত নির্যাতন, নিপীড়নেও তা ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়নি। অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতার মোহ কিংবা ফাঁসির রজ্জু কোনো কিছুই বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তার দেশপ্রেম, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, অমিত সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা অধিকার বঞ্চিত একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। তারই আহবানে সাড়া দিয়ে ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করল বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। এ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, কারিগর একজনই- তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতি অবনত মস্তকে তাঁকে অভিষিক্ত করল জাতির জনকে। এইভাবেই টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এক শিশু বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে পরিণত হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে।

লেখক: সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

SUMMARY

815-1.jpg