আবেদ খান
পঁচাত্তরের আগস্টে মানবতার বহ্ন্যুৎসব ঘটিয়ে জিয়া-মোশতাক চক্র সময়ের চাকাকে উল্টোদিকে ঘোরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কুক্ষিগত করে। তাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট এবং হিংস্র। একটা হিসাব নেওয়া যাক তাদের চক্রান্তের। তা থেকেই প্রতীয়মান হবে, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির নির্মম নীলনকশা কীভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
প্রথমত, তারা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটানোর পরপরই বেতারকেন্দ্র দখল করে বদলে ফেলেছিল বাংলাদেশ বেতারের নাম; জয় বাংলা ধ্বনি বদলে চালিয়ে দিয়েছিল জিন্দাবাদ শব্দ, ঘোষণা দিয়েছিল ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার;
দ্বিতীয়ত, তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান এবং কেন্দ্রীয় শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করেছিল হত্যা, গুপ্তহত্যা, বিতাড়নের মাধ্যমে একাত্তরের পাকিস্তানি ঘাতকচক্রের মতো একই ধরনের কৌশলে এবং বঙ্গবন্ধু অথবা আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের নির্মূল করার পাকিস্তানি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি;
তৃতীয়ত, তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানকারী ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে শত্রু গণ্য করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিল;
চতুর্থত, প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ব্যক্তি ও ব্যবস্থাপনার পুনর্বাসন ঘটিয়েছিল। যাদের নাগরিকত্ব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য চলে গিয়েছিল তাদের নির্লজ্জভাবে দেশে ফেরত এনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বসিয়েছিল। তথাকথিত ভারসাম্যের রাজনীতির নামে শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়েছিল, এক নম্বর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত গোলাম আযমকে দেশে ফেরত এনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জামায়াত রাজনীতির পুনর্বাসন ঘটানো হয়েছিল, চিহ্নিত ঘাতকদের মিডিয়া শক্তি উপহার দেওয়া হয়েছিল এবং শিক্ষামন্ত্রীর পদে পর্যন্ত বসানো হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে একাত্তরের ঘাতকদের– এভাবেই অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপচিন্তার;
পঞ্চমত, প্রশাসনকে সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি আদলে সাজানোর লক্ষ্যে কুখ্যাত আমলা শফিউল আজমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারই অভিভাবকত্বে স্বাধীনতাবিরোধী এবং পঁচাত্তরের নৃশংস ঘাতকদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল এবং এভাবে অতি সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাকিস্তানি করদরাষ্ট্র তথাকথিত এবং অঘোষিত মুসলিম বাংলায় পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছিল;
ষষ্ঠত, ঘটনাক্রমে জাতির জনকের দুই কন্যা দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বলে নানাভাবে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছিল। পক্ষান্তরে পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিভিন্ন দূতাবাসে ঢুকিয়ে তাদের ওপর বারবার গুপ্ত হামলার ছক কষা হয়েছিল, যার প্রত্যক্ষ মদদ-দাতা ছিল বিভিন্ন স্থানের পাকিস্তানি দূতাবাসগুলো। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য গোপন সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন দেশে– গোপন লিয়াজোঁ কেন্দ্র পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছিল;
সপ্তমত, এতকিছুর পরও যদি আওয়ামী লীগের নেতারা কোনও প্রক্রিয়ায় জাতির জনকের কোনও উত্তরাধিকারকে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার ব্যবস্থা করেন তা হলে যেভাবেই হোক তার প্রাণসংহার করার নিষ্ঠুর ছক তৈরি করেছিল জিয়া-মোশতাকের সক্রিয় চক্র।
অষ্টমত, এই দুষ্টচক্র অতি দ্রুত সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করে প্রতিরক্ষা নীতিমালাকে পাকিস্তানি আদলে সাজিয়ে ফেলে এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়াকে চীন-পাকিস্তানের অধীনস্থ করে ফেলে, এমনকি প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে পর্যন্ত পাকিস্তানি মাইন্ডসেট অনুসৃত হতে থাকে;
নবমত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ যাবতীয় রাষ্ট্রীয় উপাদান থেকে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বিষয়াবলি এবং বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত যাবতীয় কার্যক্রম অপসারিত করা হয়। বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছদ্মবেশী পাকিস্তানি চরদের দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা;
দশমত, বাংলাদেশের ভেতরে প্রশাসনযন্ত্র থেকে শুরু করে সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি এবং বিপক্ষ শক্তির এমন একটা মাইন্ডসেট গঠন করা হয় যা দ্বারা প্রতীয়মান হতে পারে যে, জাতি বিভক্ত, মানুষ বিভক্ত কাজেই এই বিভাজনকেই সাংবিধানিক এবং সংসদীয় রূপ প্রদান করতে হবে।
দুই.
এত ভয়াবহ নীল নকশা এবং নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির যাবতীয় অপচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেই সাঁয়ত্রিশ বছর আগে এই দিনে জন্মভূমির মাটি যার পদচুম্বন করেছিল তিনি বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং বিশ্ববন্দিত রাষ্ট্রনায়ক আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননন্দিত শেখ হাসিনা। তখন গণশত্রু নির্দেশিত ঘোষণা ছিল; যেভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করে বিধ্বস্ত করতে হবে, রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করাকে অসম্ভব করে তুলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধকে বিপর্যস্ত করার জন্য অর্থ কোনও সমস্যা হবে না, ভাগ করতে হবে, সব ভাগ করে করে এক সময় ক্ষয় করে ফেলতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, ভুয়া দেশপ্রেমিক, চতুর রাজনীতিক, ভুয়া ব্যবসায়ী, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী দিয়ে ছেয়ে ফেলতে হবে দেশ এবং পাশাপাশি অতি সন্তর্পণে চালাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নিধনপট। তাদের কৌশল, এভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে করা যাবে বিতর্কিত, দুর্বল করে দেওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।
পঁচাত্তরের পরপরই কাজ তো সেভাবেই শুরু হয়েছিল। ভাগ করা হতে থাকল আওয়ামী লীগকে, আওয়ামী লীগের নামের পাশে লেগে গেল ব্র্যাকেট, বাড়তে থাকল সেই ব্র্যাকেটের সংখ্যা– মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য সংগঠনগুলোতেও গজিয়ে উঠতে থাকলো ব্র্যাকেটের রাজনীতি। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তখন বিদেশের মাটিতে দ্বারে দ্বারে আশ্রয় প্রার্থনা করে চলেছেন গুপ্তঘাতক চক্রের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে। আজ যারা বাংলাদেশের মাটিতে বসে দেশ বিক্রি করে, মুক্তিযুদ্ধ বিক্রি করে, বঙ্গবন্ধুকে বিক্রি করে নিরাপদ জীবনযাপন করছেন তারা কি আজ কল্পনা করতে পারবেন ওই সর্বস্বহারা-স্বজনহারা দুই নারীর সেই অসহায় অবস্থার কথা?
এরই মধ্যে ঘাতকের রোষণকষায়িত লোচন এবং নির্মম প্রহারের শ্যেনদৃষ্টিকে পদদলিত করে সাঁয়ত্রিশ বছর আগের এই দিনে তিনি এসে দাঁড়ালেন তমসাবিনাশী আশার প্রদীপ নিয়ে হতাশা-সংক্ষুব্ধ জাতির সামনে। অন্তরের গভীরে বেদনার ফল্গুধারা আর হৃদয়ে শুভকর্মের প্রদীপ্ত চৈতন্য ধারণ করে শেখ হাসিনা যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন এ দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির নির্ভরযোগ্য সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠলো। বারবার আক্রমণে জর্জরিত কর্মীরা দেখল এক সাহসী নারীর অবয়বে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মুখচ্ছবিই যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত সৃষ্টির পরিকল্পনাকারীরা এবার শঙ্কিত হলো, কারণ তারা এটা বুঝেছিল যে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার যদি কোনোভাবে বাংলাদেশের মাটিতে আসতে পারে তবে সে তার স্বপ্নের ডালা বহন করেই আনবে এবং মুমূর্ষু জাতির দেহে প্রাণসঞ্চার করবেই। তাই তারা তাঁর যাত্রাপথে কণ্টক বিছিয়ে যেতে থাকলো। বারবার তার জীবনের ওপর হামলা চালানো হতে থাকলো। অদৃশ্য ঘাতকের আগ্নেয়াস্ত্রের নল দিবানিশি তাকে অনুসরণ করতেই থাকলো।
কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা তো ষড়যন্ত্রের এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে অমিত বিক্রমে এগিয়েই চলেছেন। জেল-বেয়নেট-বোমা-গুলি দিয়ে তার যাত্রাপথ রুদ্ধ করার যে কোনও চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব অসামান্য মেধা, সততা এবং নিষ্ঠা তার কার্যক্রমের ক্ষেত্রকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানাকে অতিক্রম করে উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে অধিকতর বিস্তৃত হয়েছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার স্বপ্নসৌধ সোনার বাংলা সৃষ্টির প্রয়াস।
তিন.
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র কতিপয়ের ভোগবিলাসের উপকরণ নয়, শোষিত-অবহেলিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মন্ত্রের নামই গণতন্ত্র। তার আজন্মলালিত বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার আগেই তাকে ঘাতকের হিংস্র হামলার শিকার হতে হয়। পিতার সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণের সুদৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েই তিনি একের পর এক বাধা অতিক্রম করেই চলেছেন। বদলে দিচ্ছেন মানুষের ভাগ্য, বদলে দিচ্ছেন বাংলাদেশকে।
এসবই সম্ভব হতে পারলো আজ থেকে সাঁয়ত্রিশ বছর আগে এই দিনে তিনি স্বদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন বলেই। তার অঙ্গিকার তিনি এই দেশকে উজ্জ্বল মানুষের বাসযোগ্য করে দিতে চান।
তাই এ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা ঊর্ধ্বে দুহাত তুলে বলবেই– ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছো জ্যোতির্ময় তোমারই হোক জয়’।
লেখক: সাংবাদিক