আবদুল মান্নান
১৯৭৭ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিমানবন্দরের বাইরে আসতেই একটি ট্যাক্সি এগিয়ে এলো। চালক কালো আমেরিকান। আমার ব্যাগ ট্যাক্সির পেছনের হোল্ডে তুলে সিটে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে চালক তার নাম জানালো হ্যারি। জানতে চাইলো আমি ভারতীয় কিনা। বলি, না বাংলাদেশের। ওটা আবার কোথায়? তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করি। হ্যারির ভূগোল বা ইতিহাস অথবা রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই সীমিত। হওয়ারই কথা। কারণ, তখন পর্যন্ত আমেরিকার কালোরা শিক্ষাদীক্ষা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। হ্যারিকে বোঝানোর জন্য বললাম বাংলাদেশ আর পাকিস্তান এক দেশ ছিল। কিছু দিন আগে তাকে স্বাধীন করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। এবার হ্যারির টনক নড়লো। ‘ও বুঝেছি। মুজিব ক্যান্ট্রি। মুজিব বড় নেতা ছিলেন। তোমরা তাকে মেরে ফেলেছো।’ আমি অনেকটা নির্বাক। বলি, তাঁকে আমাদের দেশের কিছু শত্রু হত্যা করেছে। কারণ, তারা বাংলাদেশ স্বাধীন হোক তা চায়নি। হ্যারি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগ দিলো।
এটি ছিল আমার প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্র সফর। যেখানেই যাই বাংলাদেশের নাম বা অবস্থান বোঝাতে বলতে হতো ‘আমি শেখ মুজিবের দেশের মানুষ’। তখন চিনতে পারতো। তখনও বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্যনির্ভর। দেশটি যখনই একটু নিজ পায়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে ঠিক তখনই যে মানুষটি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, নিজের সুখ-শান্তি উৎসর্গ করেছেন, স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁকে ঘাতকরা হত্যা করেছিল। দেশ আবার দীর্ঘ একুশ বছরের জন্য অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিল।
২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার জন্মের ৪৮তম বার্ষিকী পালন করবে। দু’বছর পর সুবর্ণজয়ন্তী। কেমন ছিল শুরুর বাংলাদেশ? দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজকের প্রজন্মকে তা বোঝানো খুব কঠিন। কারণ, এই প্রজন্মের শিশু জন্মেই দেখে ডাক্তার বা নার্সের মুখ। হয়তো তার জন্ম যেই ঘরে সেখানে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলে আত্মীয়-স্বজন আসবে নানা ধরনের উপহার নিয়ে। আর উচ্চবিত্ত হলে তারও অনেক বেশি। কেউ সোনার চামচ, মেয়ে হলে গলার ছোট্ট হার। সেই শিশু ফিডার বোতলে দুধ খেতে খেতে বড় হবে। স্কুলে যাওয়ার আগেই মিলে যেতে পারে একটা দামি মোবাইল ফোন। বেড়ে উঠবে আয়ার কাছে। বাবা-মা হয়ে যাবেন ‘ড্যাডি’ আর ‘মাম্মি’। একদিন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হবে। মাসে বেতন পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর যারা মধ্যবিত্ত তাদের তো অত টাকা নেই, তাদের বাচ্চারা ভর্তি হবে সরকারি স্কুলে। মা-বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলবেন, ‘ইস আমাদের যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে আমরা আমাদের বাচ্চাদের পাঠাতাম কোনও এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে’।
ফিরে যাই শুরুর দিকে। হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া বাঙালির কোনও মধ্যবিত্ত ছিল না। নিম্নবিত্ত বা তারও নিচে। আমাকে রিলিফের কাপড় আর জুতার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। বাবা এক কৌটা এক পাউন্ডের গুঁড়োদুধের জন্য জেলা প্রশাসকের অফিসে লাইনে দাঁড়িয়ে বিফল হয়ে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসেছেন। বাড়িতে কোনও ওয়াসার (তখন ওয়াটার ওয়াকর্স) সংযাগ ছিল না। কোনও বাড়িতেই না। পাড়ায় দু’টি কলতলা। পাড়ার লোকের একমাত্র ভরসা। দিনে দু’বার সীমিত সময়ের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়। স্কুল হতে ফিরে কলসি বা বালতি দিয়ে বাড়ির পানির ড্রাম ভরা নিত্যদিনের কাজের অংশ। তারপর মাঠের খেলাধুলা। বাড়িতে তখন বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল বলে সন্ধ্যার আগে হারিকেন পরিষ্কার করে কেরোসিন তেল ভরে পড়ার টেবিলে বসার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়নি। অনেককে তা করতে হয়েছে। এরমধ্যে শুরু হলো চৈনিক বামপন্থীদের উৎপাত। তাদের সঙ্গে জুটলো পলাতক রাজাকার আলবদররা। আজ এই পাটের গুদামে আগুন দেয় তো কাল ওই কারখানায়। অনেক জায়গায় শুরু হলো গুপ্তহত্যা। বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর সামনে পাহাড়সম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। তাঁর অন্যতম প্রথম অঙ্গীকার যে করেই হোক স্বাধীন বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলবেন। ১৯৭২ সালে ঢাকার এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, পরিশ্রম না করলে, কঠোর পরিশ্রম না করলে সাড়ে ৭ কোটি লোকের ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার এই দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করা যাবে না। ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে। শ্রমিক ভাইদের কাছে আমার অনুরোধ। তোমাদের বারবার বলেছি এখনো বলছি, প্রোডাকশন বাড়াও’।
শুরুর বাংলাদেশ আর বর্তমানের বাংলাদেশের মধ্যে তফাৎ অনেক। যদিও এ দেশের মানুষের কাছে, বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ এখনও মুজিব কান্ট্রি, ৪৮ বছর পর বলতেই হয় বাংলাদেশ তার একান্ত সত্তা সৃষ্টি করতে পেরেছে। পেয়েছে নিজস্ব পরিচয় বা আইডেন্টিটি। এখন বাংলাদেশ আর রিলিফ নেয় না। কখনও কখনও সীমিত আকারে রিলিফ দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যে দেশ তার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে অন্ন জোগাতে পারতো না সেই দেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্ন জোগায় সতেরো কোটি মানুষের। কোনও কোনও বছর বাড়তি উৎপাদনও করে। এই কৃতিত্ব এই দেশের কৃষক আর কৃষি গবেষকদের। দেশের নব্বইভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সংযোগ ভোগ করেন। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলে বিদ্যুতের উৎপাদনও বেড়ে যাবে অনেকগুণ। গড়ে উঠবে নতুন কলকারখানা। শতভাগ শিশু এখন স্কুলে যায়। শুরুতে যেখানে মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল একশ ডলারের নিচে সেখানে এখন মানুষের গড় আয় ১ হাজার ৯০০ ডলার। নিম্নবিত্তের সংখ্যা নেমে ১২ শতাংশের নিচে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বাংলাদেশের ওপর একটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। একটি ছবিতে দেখা গেছে ঢাকার নবাবপুর রেলক্রসিংয়ে এক ট্রাফিক পুলিশ খালি পায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। নিচে লেখা ছিল স্বাধীন দেশের ট্রাফিক পুলিশ। বাংলাদেশের পুলিশ এখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করছেন। পাড়ার কলতলা এখন নেই বললেই চলে। শুরুতে যুদ্ধে বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট আর ব্রিজ কালভার্ট মেরামত করার অর্থ ছিল না। এখন পদ্মার ওপর বাংলাদেশ নিজের অর্থেই বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সেতু বানায়। যে মেয়েদের শুরুতে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ ছিল না তারা এখন বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমান চালায়। যে দেশের মানুষ এতদিন একটি জামা বানানোর কাপড়ের জন্য দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো, তার পরবর্তী প্রজন্মকে আর তেমন লাইনে দাঁড়াতে হয় না। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। প্রথমে যখন বিদেশ গেলাম তখন পাসপোর্টে এন্ডোর্স করা যেত পাঁচ ডলার। এখন যে কেউ ১২ হাজার ডলার এন্ডোর্স করতে পারেন। বাড়তি লাগলে কিছু কাগজপত্র সই করতে হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন দেশে ফিরেন তখন দেশে কোনও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বত্রিশ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অবাক বিস্ময়ে বলেন– যে বাংলাদেশকে আমরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতাম তারা কেমন করে এখানে পৌঁছে গেলো? একাত্তরের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আল-বদরদের হাতে নির্যাতিত হয়ে এক কোটি শরণার্থী উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আজ সেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের এগারো লক্ষ নির্যাতিত নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের মুখে অন্ন জোগাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে ঢাকা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে গরুর গাড়ি আর লক্কড়ঝক্কড় মুড়ির টিন বাস ছিল পণ্য আর যাত্রী পরিবহনের প্রধান বাহন। আজ এই দু‘টির কোনোটাই আর দেখা যায় না। বাংলাদেশ আজ মহাশূন্যে নিজেদের উপগ্রহ পাঠায়। আর এসব চমকপ্রদ ঘটনার অনেকগুলোই ঘটেছে গত দশ বছরে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। না, এটা কোনও কোনও সুশীলের মতে কোন ‘দলদাসের’ বক্তব্য নয়, এটা বাস্তব। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর অনেক সরকারই এসেছে গেছে, কোনও সরকারই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার তেমন একটা প্রয়োজন মনে করেনি। দেশের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ছিল না বললেই চলে। যারা দেশ পরিচালনা করেন তাদের যদি দেশের প্রতি অঙ্গীকার না থাকে, তারা যদি দেশকে নিজের মনে না করেন, তাহলে সেই দেশ খুব বেশিদূর যেতে পারে না। শেখ হাসিনা এই দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমী ছিলেন। কারণ, তিনি তাঁর পিতাকে আজীবন বাংলার মানুষের জন্য লড়াই করতে দেখেছেন। তাঁকে দেখেছেন বছরের পর বছর কারাগারে কাটাতে। মৃত্যুর দুয়ার হতে ফিরতে দেখেছেন দু’বার। এক রাতে ঘাতকের বুলেটে পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বেদনা বুকে লালন করছেন। যেই দেশটার জন্য একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের এত ত্যাগ সেই পরিবারের কন্যা হয়ে তিনি দেশটাকে নিজের বলে ভাববেন তা-ই স্বাভাবিক। তাই তো তিনি দেশকে দিতে পেরেছেন সম্মান আর পরিচয়, যেমনটি তাঁর পিতা স্বপ্ন দেখতেন। অনেক দিন পর শিকাগো শহরের সেই ট্যাক্সি চালক হ্যারির কথা মনে পড়লো। ফ্ল্যাসব্যাকের মতো চিন্তা করতে লাগলাম, কোথায় ছিলাম শুরুতে আর কোথায় পৌঁছেছি। তবে তারচেয়ে বড় বিষয় এখান হতে কোথায় যাবো? কীভাবে যাবো? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে বর্তমান প্রজন্মকে।