তরুণদের বঙ্গবন্ধু

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। তারুণ্যের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশাকে তিনি নিজের ভেতর ধারণ করতেন, তারুণ্যের ক্ষোভ এবং দ্রোহের সঙ্গে একটা তাৎক্ষণিক সংযোগ তিনি ঘটাতে পারতেন। তাঁর সক্রিয়তা তিনি তরুণদের ভেতর সঞ্চারিত করতে পারতেন। তরুণ রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার তাঁর যে ক্ষমতা ছিল, তা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন ঘটানোর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে শক্তি নিয়ে তিনি এগোতেন, সে জন্য তিনি পথ ভুল করেননি। ১৯৫৪-এর নির্বাচন তরুণদের বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছিল।

১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয় এবং বাঙালিদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার জন্য তরুণদেরই সংগঠিত করেন; তিনি কারান্তরীণ থাকলে তাঁর তরুণ সহকর্মীদের সেই কাজ করার দায়িত্ব দেন। ষাটের দশকে একটির পর একটি ছাত্র আন্দোলন যে পাকিস্তানের সেনাশাসকের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেয়, তার পেছনে ছিল তারুণ্যের জাগরণ। এই জাগরণ শুধু রাজনৈতিক ছিল না, ছিল সাংস্কৃতিক এবং মৌলিকভাবে মুক্তিকামী। ষাটের দশকে সারা বিশ্বেই প্রথা এবং অচল নানা পদ্ধতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হয়, তার প্রভাব ঢাকায়ও পড়েছিল। বাঙালি এই প্রথম নিজেদের এক বৈশ্বিক মাত্রায় দেখতে অভ্যস্ত হলো। এর ফলে বাঙালির মুক্তি আন্দোলন বিশ্বের মুক্তিকামী নানা আন্দোলনের সঙ্গে একটি যোগসূত্র স্থাপন করল। একাত্তরে এটি মূল্যবান একটি সংযোগ হিসেবে দেখা দিল।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর ছয় দফার ঘোষণা দেন, যাকে ছাত্রসমাজ বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণদের ভেতর এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। আমি সে বছর স্কুল পাস করে কলেজে ঢুকেছি। স্কুলের ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হতো, পত্রপত্রিকাও পড়ার সুযোগ পেত হাতে গোনা কয়েকজন। তারপরও কী ঘটছে, আমাদের জানা হয়ে যেত। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে তখন মুখের কথা, চিঠিপত্র এবং মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক জনসভায় শোনা বক্তৃতা। এর বাইরে অবশ্য ছিল পরিবারগুলোর প্রতিদিনের কথা-চর্চা, ফলে কোথায় কী ঘটছে, আমাদের জানা হয়ে যেত। ওই বছরই বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক জীবনে এক অনিবার্য উপস্থিতি হয়ে দাঁড়ান। তিনি যেখানেই যেতেন, তরুণেরা তাঁকে দেখার জন্য, তাঁর কথা শোনার জন্য ভিড় জমাত। তারুণ্যের যে জাগরণের কথা শুরুতে বলেছি, আমি ছিলাম তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী, তাতে অংশগ্রহণকারীও।

ষাটের দশকের শেষের দিকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম, আমার মনে হয়েছিল একটা ভূমিকম্পের মাঝখানেই যেন নিজেকে আবিষ্কার করলাম। প্রতিটি দিন আসত নতুন কোনো বার্তা নিয়ে, নতুন কিছু করার উদ্দীপনা নিয়ে। সময়টা ছিল অগ্নিঝরা। রক্ত ঝরানোরও। আন্দোলনের পর আন্দোলন হচ্ছে, দমানোর সর্বময় চেষ্টা করছে সরকারের পুলিশ আর পেটোয়া নানা বাহিনী। কিন্তু সব বাধাবিপত্তি এড়িয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল স্বাধীনতার পথে।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিলেন, দেশের মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার বার্তা দিলেন, তা সারা দেশে সব মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। অনেক দুর্গম জায়গায় সেই বার্তা নিয়ে গেল তরুণেরা। পরিবারকে আর প্রতিবেশীদের জাগাল তরুণেরা। প্রতিটি ঘর একেকটি দুর্গ হয়ে দাঁড়াল।

তরুণদের সঙ্গে একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি তাঁদের সংগ্রামের বাণী দিতেন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায় উৎসাহিত করতেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার আদর্শগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তরুণদের তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, অসত্য, অর্ধসত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে, বঞ্চনা-অনাচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্দীপনা জোগাতেন। তিনি চাইতেন বাঙালি তরুণ যুগের আদর্শগুলো ধরে রেখে বিশ্বমানব হোক।

বঙ্গবন্ধুর যে দুটি বই এখন অনেক পাঠকের হাতে দেখতে পাই—অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা, সে দুটিতে তারুণ্যের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস এবং তাঁর নিজের তরুণ জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে তিনি লিখে গেছেন। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, অভয় মানো—তিনি তরুণদের বলছেন; যেখানে অন্যায়, অবিচার সেখানে প্রতিবাদ করো; মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার এবং স্বার্থের ঘর বড় করে, তাদের প্রতিরোধ করো। তিনি নিজে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন, তরুণদেরও সেই প্রয়াস নিজের মতো করে নিতে বলেছেন। এ দুই বই পড়ে তরুণেরা জানে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে তিনি ঘৃণা করতেন, দল থেকে দেশটাকে সব সময় বড় করে দেখতেন এবং শিক্ষার আদর্শকে সম্মান করতেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনে বিশ্বাস করতেন না, তাঁর দর্শন ছিল এক বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের।

২.

১৯৭৫-এর শোকাবহ দিনটিকে ভুলে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু এক চরম অমানবিক বীভত্সতার জন্য ভুলে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে হয়। তবে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডকে স্মৃতির ভেতরে পাঠিয়ে দিলেও বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাওয়া কোনো দিন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলে অনেক দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও তাঁর অবস্থানকে একচুল নড়াতে পারেনি তাঁর হত্যাকারী ও তাদের অনুসারীরা।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টেই দেখেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রয়াসে শামিল হয়েছেন তাঁরই অনেক ‘পরীক্ষিত’ সহকর্মী ও অনুবর্তী। তাঁদের পেছনে ছিল ভয়, সামনে ছিল সুরক্ষা এবং উন্নতির হাতছানি। যাঁরা প্রতিবাদ করতে পারতেন, তাঁরাই যদি চুপ হয়ে যান এবং অনেকেই সুর পাল্টে নতুন গান গাইতে শুরু করেন, বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠানোর কাজটা নিশ্চয় সহজ হয়। সে রকমই অবস্থা দাঁড়াল ১৯৭৫-এর পর সামরিক ও আধা সামরিক শাসনের সময়।

কিন্তু যুগ পাল্টাল। যোগাযোগের, তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন পথ এবং সম্ভাবনা তৈরি হলো। বঙ্গবন্ধুর নানা ভাষণ, স্মৃতি, চিঠিপত্র ইত্যাদি যাঁরা নিজেদের সংগ্রহে রেখেছিলেন, রাষ্ট্রীয় নানা সংগ্রহশালায় বন্দী ছিল, সেগুলো পাওয়া যেতে শুরু করল। ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলন এবং অন্তর্জালের বিপুল পৃথিবীর দরজাগুলো খুলে যেতে থাকলে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ সহজ হয়ে পড়ল।

তরুণেরা বঙ্গবন্ধুকে পুনরাবিষ্কার করল। দেশ যতই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করল, তরুণেরা ইতিহাসের সত্য আর সংস্কৃতির সঞ্জীবনী শক্তির জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। ‘সত্য যে কঠিন,’ তারা জানল, কিন্তু সত্যকে ভালোবাসলও। বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করে যেসব অসত্যের প্রচার চলছিল, সেগুলো তারা চিহ্নিত করল এবং বঙ্গবন্ধুর দুটি বই যখন বাজারে এল, তারা নতুনভাবে তাঁকে কাছে পেল।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ছাত্র আন্দোলন সারা দেশের তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তরুণেরা বঙ্গবন্ধু থেকে প্রেরণা নিয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন হলো, তাতেও শিক্ষার্থীরা পোস্টার লিখে জানাল, তারা প্রতিবাদী হওয়ার সাহস বঙ্গবন্ধু থেকে নিয়েছে।

৩.

আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। পেছন ফিরে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখি আর তাঁর কথা শুনি। তাঁর কথাগুলো এখন তরুণেরা শুনছে, পড়ছে। তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তারা যে বাংলাদেশ চায়, বঙ্গবন্ধুও সেই দেশটি চেয়েছিলেন এবং তার একটি বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন, ‘সোনার বাংলা।’

এই আগস্টে আমরা, বয়স্করা, রাজনৈতিক নেতারা, প্রশাসনের কর্তারা, সেখানে যত মানুষ আছেন যাঁরা পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে পারেন, তাঁরা কি একটি শপথ নিতে পারি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে পারি, তিনি যে তারুণ্যকে সম্মান করতেন, তাকে আমরাও সম্মান করি? অবিচার, অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, সত্য প্রকাশে সাহসী হই? মিথ্যাকে ঘৃণা করি?

যদি তা করতে পারি, বঙ্গবন্ধুকে আমরা সত্যিকার সম্মান দেখাতে পারব।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

SUMMARY

81-1.jpg