মোজাফফর হোসেন
দেশের সব রাজনৈতিক দলের ছাত্রকর্মীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত হতে পারে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। একজন আদর্শ ছাত্রনেতা বা রাজনৈতিক ছাত্রকর্মী কেমন হতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক-কর্মী জীবনে আছে। ছাত্ররাজনীতির স্কুলিংয়ের জন্য এমন অপরিহার্য বই বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ
জেলখানায় বসে বা রাজনৈতিক নির্বাসনে থেকে বিশ্বসাহিত্যে বেশ কিছু অমূল্য রত্ন সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা সামাজিক আন্দোলনকর্মীদের হাত দিয়ে। বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপন্যাস ‘দন কিহোতে’ সার্ভেন্তেস লিখেছিলেন জেলে বসে। ইংরেজি সাহিত্যের আদি উপন্যাস জন বিনিয়ানের পিলগ্রিমস প্রগ্রেসও রচিত হয়েছে জেলের মধ্যে। মাক্সিম গোর্কি ‘মা’ লিখেছিলেন রাজনৈতিক নির্বাসনে থেকে। এগুলো বিশ্বসাহিত্যের মহৎ সংযোজন। সাহিত্যের বাইরে সমাজনীতি-রাজনীতি-দর্শন প্রভৃতি-বিষয়ক বইও জেলে বসে লেখা হয়েছে, যেগুলো পরবর্তীকালে বিশ্বমানবতা, মুক্তি বা মানবসভ্যতা দর্শনের নতুন পথ বাতলে দিয়েছে। যেমন, ইতালির বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী আন্তনিও গ্রামসির ‘প্রিজন নোট’ বইটি লেখেন জেলখানায় বসে। অবিভক্ত ভারতে জওহরলাল নেহরু জেলখানায় বসে লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু লেখা। আফ্রো-আমেরিকান রাজনৈতিক নেতা ও মানবাধিকারকর্মী ম্যালকম এক্স তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীর সূচনা করেন তাঁর সাতবছরের কারাজীবনে। মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র) কারাগারে বসে লেখেন ‘বার্মিংহাম জেল’। মার্কো পলো তাঁর জগদ্বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনি লেখেন জেলে বসে। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য জেলসাহিত্য বা রাজনৈতিক ভাষ্যের সর্বশেষ সংযোজন হল বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এটি তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সময়কালে রাজবন্দি হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকাকালে লেখেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও উদ্যোগে ২০১২ সালে পাণ্ডুলিপিটি আত্মজীবনী-গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এখানে মোটা দাগে, বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর, পরিবারের কথা, ছাত্রজীবনের আন্দোলন, পাকিস্তান-আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা চক্রান্ত, দুরভিসন্ধি ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে।
বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ তো বটেই, তথা সমগ্র বাংলা ভাষায় লিখিত অতি উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীও এটা। বইটির বহুমুখী বিস্তারের কারণে একে নানা দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। অবিভক্ত ভারতের ইতিহাস, এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মকথা প্রভৃতি বিষয়-সংশ্লিষ্ট ইতিহাস-চর্চায় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন এই আত্মজীবনী। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বইটি আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ কারণে। বর্তমান ছাত্ররাজনীতির জন্য এটি একটি আদর্শপাঠ বলে বিবেচিত হতে পারে। একজন ছাত্রনেতার মহান রাজনৈতিক নেতা ও একটি জাতির প্রধান রূপকার হয়ে ওঠার ইতিহাস এখানে লিপিবদ্ধ আছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনবৃত্তান্ত পড়ে একজন আদর্শ ছাত্রনেতার ‘মডেল’ আমরা পেয়ে যাই।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ যত পরিণত হয়েছে, দেশের ছাত্ররাজনীতি তত ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র রাজনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এরপর ’৭১-পরবর্তী বাংলাদেশে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনে ছাত্ররাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আমরা জানি। তারপর থেকে দেশের ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেন মিথে পরিণত হয়েছে। সরকার এবং বিরোধীদল সমানভাবে ছাত্ররাজনীতিকে তাদের ক্ষমতার ঢাল এবং তলোয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ-সুযোগ্য নেতারও গলা টিপে ধরেছে। যে কারণে ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনীতি বা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে একটা শক্ত অবস্থান জনগণের ভেতর তৈরি হয়েছে। কিন্তু অস্বীকার করার জো নেই, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেয়া সংকটের কোনো সমাধান নয়। এক্ষেত্রে একটাই পথ খোলা, দেশের ছাত্ররাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। ছাত্ররাজনীতিকে ঐতিহ্যমুখী করা। এজন্য দেশের সব রাজনৈতিক দলের ছাত্রকর্মীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত হতে পারে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। একজন আদর্শ ছাত্রনেতা বা রাজনৈতিক ছাত্রকর্মী কেমন হতে পারেন, তার দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক-কর্মী জীবনে আছে। ছাত্ররাজনীতির স্কুলিংয়ের জন্য এমন অপরিহার্য বই বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
রাজনৈতিক ছাত্রকর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। কিশোর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। চোখের সমস্যাও দেখা দেয়। এ-কারণে পড়াশুনায় একটু ছেদ পড়ায় তিনি স্বদেশী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। শুরু হয় তাঁর ছাত্ররাজনীতির প্রস্তুতিপর্ব।
পারিবারিকভাবে মুজিব ব্রিটিশ-বিরোধী ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁদের সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘শেখদের দুর্দিন আসলেও তারা ইংরেজদের সহ্য করতে পারত না।’ গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের সহযোগিতা করার জন্যে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। কিশোর মুজিব সেখানে অবদান রাখতে শুরু করলেন। নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টিচাল সংগ্রহ করে আনতেন। কাজী আবদুল হামিদ মাস্টারের মৃত্যুর পর তিনি এই সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
ছাত্ররাজনীতিতে হাঙ্গামা-মারামারিও কিছুটা থাকতে পারে; কিন্তু তার একটা মানবিক বা মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে। যেমন : তরুণ মুজিব ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ পরিচালনার সময় কোনো সচ্ছল মুসলিম পরিবার অর্থ বা মুষ্টিচাল দিতে আপত্তি জানালে অনেকটা জোর করে তাদের বাধ্য করতেন সহযোগিতা প্রদানে। সচেতন ছাত্র অবশ্যই পেপার-পত্রিকা পড়বেন। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম।’ পড়ার পাশাপাশি দলের মুখপাত্র হিসেবে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। হকারি করে রাস্তায় তা বিক্রিও করে বেড়াতেন। আজকালকার রাজনৈতিক ছাত্রনেতা-কর্মীদের ভেতর এই বিশেষ গুণটি নেই বললেই চলে।
বাবা বলেছিলে পড়াশুনা করতে; মা বলেছিলেন, শেরে বাংলার বিরুদ্ধে কথা না বলতে, তাঁকে অসম্মান না করতে; মুজিব তাঁদের কথা শুনেছেন। যখনই টাকার প্রয়োজন হয়েছে, চাঁদাবাজি না করে বাবা, মা, বোন কিংবা স্ত্রীর কাছে হাত পেতেছেন। তাঁরা নিরাশ করেননি
কিশোর বয়স থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৩৮ সালে বাংলার দুই অগ্রগণ্য নেতা বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে এলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবের ওপর। তিনি তখন লক্ষ্য করলেন হিন্দু ছাত্ররা তাঁর সঙ্গে আসছে না, কারণ কংগ্রেস থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের এই আচরণে আশ্চর্য হলেন সাদা মনের মুজিব, কেননা তিনি হিন্দু-মুসলিম আলাদা করে দেখতেন না। আত্মজীবনীতে তিনি বলছেন, ‘হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গানবাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান- সবই চলত।’ তাঁর এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের আরো দৃষ্টান্ত আমরা পাই ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সেই ভয়াবহ দাঙ্গায় একজন মুসলমান ছাত্রনেতা হয়েও তিনি সমানভাবে মুসলমান ও হিন্দুদের পাশে দাঁড়ান। মুসলমান অঞ্চলে আটকেপড়া হিন্দুদের পৌঁছে দেন নিরাপদ এলাকায়। ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন হিন্দু এবং মুসলমান ত্রাণ শিবিরগুলোতে।
১৯৩৯ সালে কলকাতায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ গঠন করলেন মুজিব; তিনি তার সম্পাদক হলেন। এবং মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি হলেন। বিশ বছর বয়সে পা দেয়ার আগেই তিনি প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেও লেখাপড়াটা তিনি গুরুত্ব দিয়ে চালিয়ে গেলেন। ১৯৪১ সালের মেট্রিক পরীক্ষায় বাংলা পরীক্ষার আগে ভীষণ জ্বর হল মুজিবের। বাবা পরীক্ষা দিতে নিষেধ করলেন। তারপরও আত্মবিশ্বাসী মুজিব বিছানায় শুয়ে পরীক্ষা দিলেন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পাসও করলেন।
১৯৪১ সালে সালের ভেতর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্সে শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। উপস্থিত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, ইবরাহীম খাঁ। ১৪৪ ধারা জারি হলে সেই কনফারেন্স হল হুমায়ূন কবিরের বাড়িতে। কনফারেন্সে নজরুল গান করলেন, রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা হলো না, আলোচনা হলো শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্পর্কে। এ থেকেও তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবের বুদ্ধিদীপ্ত পরিচয় ফুটে ওঠে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হল। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মুজিব লিখেছেন, ‘এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।...মা মরে পড়ে আছে, ছোট্ট বাচ্চা সেই মার দুধ চাটছে।’ ইংরেজরা তাদের সৈন্যদের জন্য খাদ্যমজুদ রেখে বাংলার মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে তুলল। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ইংরেজদের কথা হল, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে।...ট্রেনে আগে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে মরে ইংরেজ আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।’ ওদিকে ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করে খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে তুলল। এ সময় লেখাপড়া ছেড়ে মানুষের জন্য রাস্তায় নেমে পড়লেন মুজিব। বেশ কয়েক জায়গায় লঙ্গরখানা খুলে সাহায্যের ব্যবস্থা করলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান সদা সত্য কথা বলতেন বলে শিক্ষকরা তাঁকে স্নেহ করতেন। মুজিবও তাঁদের পিতার মতো মান্য করতেন। আজকের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে শিক্ষকদের কেমন সম্পর্ক, তা আমরা সকলেই জানি। এখনকার ছাত্রদের মতো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি রাজনীতি করেননি। বাবা-মায়ের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। বাবা বলেছিলে পড়াশুনা করতে; মা বলেছিলেন, শেরে বাংলার বিরুদ্ধে কথা না বলতে, তাঁকে অসম্মান না করতে; মুজিব তাঁদের কথা শুনেছেন। যখনই টাকার প্রয়োজন হয়েছে, চাঁদাবাজি না করে বাবা, মা, বোন কিংবা স্ত্রীর কাছে হাত পেতেছেন। তাঁরা নিরাশ করেননি।
সহকর্মী ও দলের নেতাদের প্রতি উদার আচরণ তাঁর বরাবরই ছিল। শেরে বাংলার সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভেদ তৈরি হলেও তিনি তাঁকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁর বাসায় গেছেন। মুসলিম ছাত্রলীগ ভেঙে দুই দল হলে বিপক্ষ দলে চলে যান মওলানা আকরম খাঁ। তাঁকেও তিনি সমান শ্রদ্ধা করতেন। তিনি কখনো কখনো হয়তো কোনো নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। সহিষ্ণুতা ও মানবিক বিবেকবোধ তাঁর ভেতর সবসময় ছিল। পদের লোভে তিনি রাজনীতি করেননি। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘আনোয়ার সাহেব আমার কাছে লোক পাঠালেন এবং অনুরোধ করলেন তার সাথে এক হয়ে কাজ করতে। তিনি আমাকে পদের লোভও দেখালেন। আমি বললাম, আমার পদের দরকার নাই। তবে সবার সাথে আলোচনা করা দরকার।” অর্থাৎ মুজিব কখনো নিজের স্বার্থের কথা ভেবে দলের অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁর কাছে দলই চূড়ান্ত কথা। পদের জন্য যে তিনি রাজনীতি করেননি, তার আরো একটি প্রমাণ হল, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের জনপ্রিয় ছাত্র হওয়ায় একবার (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে মাত্র তিন মাসের মাথায় অন্য আরেকজনকে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি পার্টির কাজে কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। চাইলে পদ ধরে রাখতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। সততা এবং কর্মনিষ্ঠা থেকে মুজিবের ভেতর একটা একরোখা ভাব গড়ে উঠেছিল। আত্মবিশ্বাসী মনোভাব থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আপসহীন নেতা। যে কারণে অন্যায় মনে হলে তিনি তাঁর রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গেও তর্কে লিপ্ত হয়েছেন। তবে লক্ষ করেছেন সেটা যেন বেয়াদপি পর্যায়ে না যায়।
শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু
এত ব্যস্ততার ভেতরও প্রতিরাতে নিয়ম করে পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। কলেজে পার্সেন্টেজ রাখতেন। রাজনৈতিক নেতা ছিলেন বলে অন্যায় সুযোগ নিতে চাননি। যে কারণে তিনি উচ্চারণ করতে পেরেছেন, ‘আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম...।” তাঁকে যে কাজ দেয়া হত, তা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করতেন। ভীষণ পরিশ্রমী ছিলেন। ছাত্রদের বিপদ আপনে তিনি পাশে দাঁড়াতেন। এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ দলের কর্মীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হলের সিট পান, তখন সেখানে শেখ মুজিব কেবলমাত্র গরিব ছাত্রদের ফ্রি থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাদের অর্থ সাহায্যেরও বন্দোবস্ত করতেন। দলের নেতাকর্মীদের থাকার সমস্যা হলে তিনি নিজের রুম ছেড়ে দিতেন। আত্মীয়করণের ব্যাপার তাঁর মধ্যে একদমই ছিল না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালোর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।’ আজকাল যেখানে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বা চূড়ান্তভাবে বহিষ্কৃত হন, মুজিব সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের আন্দোলনে শরীক হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
দেশ ও আদর্শিক রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য নিজের পরিবারের চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের দলকে। গোটা বাংলায় তাঁর কাছে পরিবার হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ নিবন্ধে লিখেছেন, “আমার জন্মের সময় বাবা কলকাতায় পড়তেন, রাজনীতি করতেন। খবর পেয়েও দেখতে আসেন বেশ পরে।...কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা ডাকি’।” একজন ত্যাগী নেতার আদর্শচিত্র (আর্কিটাইপ) এই অল্পকথার ভেতর ফুটে ওঠে।
এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুখোড় ছাত্রনেতা থেকে জাতির মহানায়কে পরিণত হওয়ার ইতিহাস আমাদের ছাত্ররাজনীতির জন্য শাশ্বত এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দল-মত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের ছাত্রদের জন্য এটির পাঠ অপরিহার্য, যদি সেই ছাত্র রাজনীতি প্রকৃতপক্ষেই হয় দেশ ও জনগণের জন্য। বিশেষ করে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ছাত্র-অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পাঠের বিকল্প কোনো বিকল্প নেই