লীনা পারভীন
আমি পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের একজন। নিজেকে অভাগা মনে করি এজন্য যে, আমি কেন ৭১ দেখিনি? আমার পরিবারে আমার বড় চাচা একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি পরবর্তী সময়ে আমারই আরেক মুক্তিযোদ্ধা ভাই, যিনি সেই চাচার হাত ধরেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প মানে আমার চাচার কাহিনি শোনা, যুদ্ধের সময় আমার মা, চাচিরা কেমন করে পাকিস্তানি মিলিটারি আসছে, সেই খবরে নিজেদের লুকিয়ে রাখতেন, যে যেখানেই পারতেন, পালিয়ে থাকতেন। যুদ্ধের কাহিনি মানে ৭১ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নেওয়া আমার মেঝো বোনকে নিয়ে আমার মায়ের দৌড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যাওয়া।
আমার বাবা তার কাজের সুবাদে থাকতেন ঢাকা শহরে, আমার আরেক চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। থাকতেন বর্তমান শহীদুল্লাহ হলে। আব্বা ছিলেন তার কাছে বন্ধুর মতো। আর তাই আব্বার বেশিরভাগ সময় থাকতেন চাচার কাছে হলে। সেই চাচাকে হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে মেরেছেন। নাম বললে অনেকেই চিনতে পারার কথা। শহীদ শরাফত আলী। তাই যুদ্ধের কাহিনি মানে আমার কাছে কেমন করে আমার বাবা বেঁচে ছিলেন? ছোটবেলা থেকেই আব্বা আম্মার কাছ থেকে শুনেছি ৭১ সালের কথা, ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা। আমার দাদা ছিলেন সেই ব্রিটিশ সরকারের গ্রাম্য বিচারক। তাই আমাদের পরিবারে অভাব শব্দটার সঙ্গে কেউ পরিচিত নয়। কিন্তু ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কথা এলেই শুনতাম, তখন আমাদের বাড়ির সামনে মানুষের লাইন ধরে সাহায্য চাওয়ার গল্প। সামান্য ভাতের মাড়ের জন্য মারামারি লেগে যেত। আমি জানতাম শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু তারপরের শেখ মুজিবুর রহমান কেমন ছিলেন তার সম্পর্কে শুনতে গেলেই শুনেছি ৭৪-এর কথা, শুনেছি তার ছেলে শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতির গল্পের কথা, শুনেছি বাকশাল করে কেমন করে তিনি দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন, সেই গল্প।
আমার বাবা আওয়ামী লীগ সমর্থন করতেন। তাই বলে ৭১-পরবর্তী মুজিব নিয়ে যে তিনি খুব বেশি কথা বলতেন তাও না। তবে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক কিছু শুনলেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। তবে তার এই চুপ থাকার কারণ পরে বুঝেছি, আব্বা সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন।
স্কুলে কখনোই স্বাধীনতার ইতিহাস পড়তে গিয়ে বেশি কিছু আলোচনা শুনিনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমি যা জানার জেনেছি মা বাবার মুখে শুনে-শুনে। স্কুলে কেবলই কিছু গদবাঁধা চ্যাপ্টারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ৫২, ৬২, ৬৯, ৭১ সম্পর্কে যা ছিল তা কেবলই যতটুকু না দিলেই নয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে কখনোই আমাদের ইতিহাস জানানোর তাগিদ দেখিনি। তাই যা পড়েছি, তা কেবলই পরীক্ষার খাতায় লেখার জন্য। আমার মনে আছে ১১ দফা থেকে ৬ দফা যখনই পড়ানো হতো তখন আমরা ভাবতাম ইশ কী কঠিন কঠিন জিনিস, আরে বাবা, একেবারেই ৬ দফা দিলেই তো আমাদের আর এতগুলো মুখস্থ করতে হতো না। ১১ দফাকে কেন ৬ দফা করা হয়েছিল, তার যৌক্তিকতাও পড়েছিলাম বিরক্তি নিয়ে, কেন বুঝতে হবে, কেন পড়তে হবে? আমার মনে হয় আমাদের সময়কার বা পরবর্তী অধিকাংশের একই অবস্থা ছিল হয়তো!
এভাবেই গড়ে উঠেছি আমরা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। আমি সবাইকে ঢালাওভাবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বেড়ে উঠেছে সেটা বলব না, মোটামুটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোতে অধিকাংশই এভাবে বেড়ে উঠেছে। আবছা আবছা জ্ঞান নিয়ে বেড়ে উঠেছিলাম আমরা। আমি বাবা, মামা উভয়ের দিক থেকেই একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্মেছিলাম। তাই পারিবারিক আবহে ছিল রাজনৈতিক শিক্ষা। আর সেই শিক্ষা পেয়েছিলাম সম্পূর্ণ আমার পরিবার থেকে।
আমার নানা ছিলেন একজন বাম্পন্থী রাজনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে আইন পেশায় নেমেছিলেন এবং ছিলেন বাংলাদেশের একজন তুখোড় আইনজীবী। তাই নানার সূত্রে আমার বড় ভাই জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতিতে। এসব পরিবেশ আমাকে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে।
আমার আগ্রহের জায়গা পড়ালেখা থেকে সবচেয়ে বেশি ছিল রাজনীতির দিকেই। রাজনীতি করতে এসেও দেখলাম শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নানা বিশ্লেষণ। ‘জাতির পিতা’ কেন বলা হবে, সে নিয়ে অনেক তর্ক-আলোচনা-বিশ্লেষণ। মুক্তিযুদ্ধ আসলে কোন প্রকারের যুদ্ধ ছিল, সেটা নিয়েও চলে পাঠচক্র। শেখ মুজিবুর রহমান কেবলই একজন নেতাই ছিলেন, তবে তিনি দূরদর্শী ছিলেন না। এরকমটাই আমাদের জানানো হয়েছিল, ব্যাখ্যায় যেন এ কথা প্রমাণেরই যত চেষ্টা। কেন দূরদর্শী ছিলেন না? শেখ মুজিবুর রহমান নিয়ে খুব ভালো কোনও বইও তখন দেখিনি, বা থাকলেও আমাদের পড়ার তালিকায় এসে ঢুকতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাম্পন্থীদের মধ্যে ছিল প্রচুর তর্ক-বিতর্ক। তবে বেশিরভাগই ছিল নেতিবাচক।
দেশে তখন আওয়ামীবিরোধী আবহাওয়া। শেখ মুজিবুর রহমান কেবলি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, তাই সারাদেশে তাকে নিয়ে কোনও আলাপ-আলোচনা কিছুই হতো না। আগস্ট মাস মানে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। আর সেটা সমাজের আর দশজনের মতোই পালন করা হতো। পার্থক্য কেবল, এলাকায় এলাকায় যেখানে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ শক্তিশালী বা সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল সেসব জায়গায় সামান্য আলোচনা সভা। ১৫ আগস্টের দিনে কাঙালিভোজে খিঁচুড়ি বিতরণ। আমাদের বাসার পাশেই ১৫ তারিখে সারাদিন চলতো শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণের কী গুরুত্ব তখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তাই সারাদিন মাইকে ওই আওয়াজ কেবলি বিরক্তির বিষয় ছিল। তবে হ্যাঁ আওয়ামীবিরোধী হওয়ার পেছনে এই মাইকেরও একটা অবদান ছিল। দিন নেই, রাত নেই, মানুষের কানের কাছে মাইক বাজালেই যে নেতার প্রতি সম্মান দেখানো হয় না, সে বিষয়ে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের নেতাদেরও জ্ঞানের অভাব আগেও ছিল, এখনও আছে।
বাজারে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কয়টা বই কয়জন লিখেছেন জানা নেই। ১৫ আগস্ট কেন শেখ মুজিবকে এমন নির্মমভাবে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছিল, তা নিয়ে কোথাও কোনও আলোচনা শুনেছি, বলে মনে করতে পারি না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শুধু গুজব আর গুজবই রটেছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। কেউ আলোচনা করেনি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে কেমন করে তিনি নিজের দক্ষতায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। কী করে আবার সবাইকে ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্য অভিভাবকের মতো শাসন করছিলেন।
আমার কাছে তো মনে হয় বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান তিনি আমাদের অসাধারণ একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। একটি রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করা অতটা সহজ কাজ তখন ছিল না।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন দরদি নেতা। নিজের দেশের মানুষকে তিনি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এত ভালোবাসা আজ পর্যন্ত কোনও রাষ্ট্র নেতা আমাদের দেননি। শুধু তাই নয়, জনগণের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। বিশ্বনেতাদের অনেকেই যখন তাকে সাবধান করেছিলেন, তিনি তা এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছেন।
তার সম্পর্কে যেখানেই পড়ি, যত স্মৃতিচারণই পড়ি, সবজায়গাতেই তার উদারতার ছাপ পাই। সেদিন পত্রিকায় পড়ছিলাম এক নাপিতের সাক্ষাৎকার—যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন, চুল কাটার পর বঙ্গবন্ধু তাকে দুটি দশ টাকার নোট দিয়েছিলেন। নাপিত নিতে না চাইলে তিনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, 'রাখ ব্যাটা'। বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রপতি।
একজন রাষ্ট্রপতির কাছে এইরকম আন্তরিকতা কবে কে পেয়েছেন জানি না। ফেসবুকে একজনের শেয়ার করা একটি চিঠির খামের ওপর ঠিকানার জায়গায় লেখা দেখলাম 'শেখ মুজিব ভাই'। তিনি রাষ্ট্রপতি নয় জনমানুষের কাছে ভাই হিসেবে ছিলেন। এই মহান নেতাকে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে যেন অন্ধকার ঘরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে বিতর্কিত করতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যেমন ইচ্ছামতো ইতিহাস রচনা করা যায়। বোঝাই যায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচারণা কেবল প্রচারণা ছিল না, তারচেয়েও বড় কিছু করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই সেসব করা হয়েছিল।
তবে আশার কথা হচ্ছে এখন তার হত্যার এত বছর পর এসে নতুন প্রজন্ম আবার তাকে জানতে চাচ্ছে, বুঝতে চাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে চলছে একজন শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির পিতা হয়ে ওঠার আলোচনা। লেখা হচ্ছে বই। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার। তিনি সাহস করে যদি এই হত্যার বিচার নিশ্চিত না করতেন, তবে হয়তো এখনও শেখ মুজিব একজন ‘স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র নায়ক’ই থেকে যেতেন।
বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিবুর রহমান—এই সত্য অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। যে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করাটাই ছিল একপ্রকার অপরাধ, সেই তাকে নিয়েই এখন হচ্ছে প্রচুর সভা সেমিনার। আজ কেউ পিতাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারে না। সাংবিধানিকভাবে তিনি আজ আমাদের জাতির পিতা।
হে পিতা তুমি বেঁচে থাকো অনন্তকাল, যতদিন এই দেশ থাকবে, দেশের সীমানা থাকবে ততদিন তুমি রইবে এই বাঙালির রক্তে। আজ বুঝি তুমি চলে গেছ খুব অসময়ে, ঠিক যে সময়টাতে বাংলাদেশে তোমার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে দেখে নিয়ো পিতা, তোমার রক্তে ভেজা এই মাটি তোমার সঙ্গে বেঈমানি করতে পারে না, পারবে না কোনও দিন। জয় হোক লড়াকু বাংলাদেশের। জয় হোক শেখ মুজিবের বাংলাদেশের।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়