বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘১৫ আগস্ট’ প্রসঙ্গ


শামছুজ্জামান সেলিম 
  
আমরা আরও স্মরণ করতে পারি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আলজিয়ার্স সম্মেলনে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে এক মঞ্চ থেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ শোষক আর শোষিত এই দুভাগে বিভক্ত। আমি শোষিতের পক্ষে’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের জন্যে ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এ দিন থেকে বাংলাদেশ ‘উল্টো পথে’ যাত্রা শুরু করে। ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’ ত্রিশ লক্ষ শহীদের অর্জনকে হারিয়ে ফেলে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে এই দিন।
বাংলাদেশের ১৫ আগস্ট ’৭৫-কে বুঝতে হলে বৃটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনামলকে বিবেচনায় নিতে হবে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষকে ১ শত ৯০ বছর শাসন করেছে। আর আমাদের বাংলাদেশের ওপর ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন ছিল ঔপনিবেশিক ধরনের। বাস্তবে তদানিন্তন পূর্ববাংলায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবশেষ বজায় ছিল ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এই শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্ব যুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের চরিত্র হয়ে উঠেছিল চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী। পূর্ববাংলার জনগণকে এই ঔপনিবেশিক শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। সশস্ত্র লড়াই করে জিতে নিতে হয়েছে স্বাধীনতাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানের স্বাধীনতার মতো ছিল না। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে উত্তরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের চরিত্রই পাল্টে যায়। ধর্মভিত্তিক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক র‌্যাডিক্যাল চরিত্রের বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমরা পাই। এটা ছিল একটা নতুন চরিত্রের রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর লুটেরা বুর্জোয়া ছিলেন না। শাসক শ্রেণি ছিলেন নিছক মধ্যস্তরের পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি।
গত শতাব্দির ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ থেকে মুক্তির ঢেউয়ে এশিয়া আফ্রিকার সদ্যস্বাধীন দেশ সমুহের শাসক শ্রেণির চরিত্র মোটাদাগে এ ধরণেরই ছিল। রাষ্ট্র চরিত্রের সাধারণ এই ধারার বাইরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর একটা বড় ধরনের অর্জন ছিল হিন্দু-মুসলমান দুই জাতিতত্ত্বকে পরাজিত করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। সর্বপোরি নবীন বাংলাদেশ ছিল সেক্যুলার রাষ্ট্র।
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতিও ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যুক্ত থেকে বাংলাদেশ ঐ সময়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান নিয়েছে এবং এই নীতির পক্ষে জোরাল সমর্থন দিয়েছে। রাষ্ট্রের চরিত্র এবং সরকারের গৃহিত নীতি উভয়ই ছিল প্রগতিশীল এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। এই নীতি অবস্থানকে ইতিবাচক বলে বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা আরও স্মরণ করতে পারি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আলজিয়ার্স সম্মেলনে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে এক মঞ্চ থেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ শোষক আর শোষিত এই দুভাগে বিভক্ত। আমি শোষিতের পক্ষে’।
’৭২ থেকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের দেশ শাসনে ব্যর্থতার সমালোচনাগুলো অবশ্যই ন্যায্য এবং যথার্থ। কিন্তু ‘৭২-৭৫’ কালপর্ব ছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের কালপর্ব। এই কালপর্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল সময়ের দাবি। শুরুতেই আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠন করায় দেশ পুনর্গঠনের কাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আওয়ামী লীগের সরকার বিধ্বস্থ দেশ পুনর্গঠনে একাই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। তাছাড়া দুর্ণীতি ও ব্যর্থতা জাতিকে হতাশ করে তুলছিল।
’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবাবে নৃশংসভাবে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মোস্তাক, জিয়া এবং এরশাদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র এবং সরকারের প্রগতিশীল নীতিসমুহ পাল্টে দেয়, বাস্তবে ধ্বংস করে দেয়। জিয়া এবং এরশাদ দ্বিজাতিতত্ত্বের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়। কার্যত মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যায় জিয়া এবং এরশাদের শাসনামলে।
আজকের বাংলাদেশে ‘১৫ আগস্ট’কে আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্তির দিন(!) বলে প্রচারণা চালানো হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটা সুচতুর মহল থেকে। সাধারণভাবে আমাদের অনভিজ্ঞ তরুণ প্রজন্মকে আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা থেকে এই প্রচারণায় বিব্রান্ত হতে দেখা যায়। এই মহল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাকে আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে মুক্তিযুদ্ধকেও আক্রমণ করে এবং আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ যে এক নয় এ কথা তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে দিতে চায় না। জাতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকার অর্থ আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকা নয় এই গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটাকেই ওরা আড়াল করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করলে বিএনপি-জামায়াতের বাইরে থাকা এই লবি থেকে প্রচারণা চালানো হয় যে, এটা আওয়ামীপন্থী রাজনীতি।
বিএনপি-জামায়াত জোট এ ধরণের প্রচারণার মধ্যে প্রকাশ্যে রয়েছে। এরা আরও বলে থাকে যে, মুক্তিযুদ্ধের ‘পক্ষ-বিপক্ষ’ বললে জাতিকে ‘বিভক্ত’ করা হয়! দ্বিতীয়ত: যারা ’৭১ সালে পিকিং পন্থার নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে তাদের মূল্যায়ন ছিল এটা ‘দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি’। আজও তারা বাম অবস্থানে থেকে নতুন বয়ানে প্রায় একই ধরনের প্রচারণা চালান। এই বিভ্রান্তিকর তৎপরতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার ক্ষেত্রে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ ‘ইউ টার্ন’ নেয়ার ফলে জাতি হিসেবে বাঙালির সব অর্জন ‘মরুপথে’ হারিয়ে যায়। মূলত: জিয়া এবং এরশাদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের  হাতে তুলে দেন। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় নিরঙ্কুশভাবে। এইকাল পর্বেই দেশের রাষ্ট্রখাতকে তাদের অনুগত কিছু ব্যক্তিকে লুট করে নেয়ার অবাধ সুযোগ করে দেয় বিশ্বব্যাংক। এই লুটেরা গোষ্ঠিই দু’দশকের মধ্যে দানবীয় শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং দেশের রাজনীতির দখল এদের হাতেই চলে যায়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং বহুজাতিক কোম্পানি সমুহের তৎপরতা এক ধরনের ‘বৈধতা’ অর্জন করে এ সময়কালে। এরা সক্ষম হয় এদেশের ঐতিহ্যবাহি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সমুহের নেতৃত্বে লুটেরা ধনীক শ্রেণিকে প্রতিস্থাপন করতে। ফলে ‘আশির দশকে’ নতুন করে জেগে ওঠা গণতান্ত্রিক শক্তি এবং শ্রেণি সমুহের আন্দোলন ও সংগঠন জাহাজ ডুবির মতো সময়ের সাগরে ডুবে গেছে।
এই অবস্থান থেকে আমরা যদি বর্তমান বাংলাদেশকে দেখি তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মনে হয় সহজ হয়ে যায়। যেমন, আজকের আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য, গণতান্ত্রিক বলে দাবিদার দল সমুহের আচরণ এবং তাদের মধ্যেকার অস্থিরতা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লক্ষ্যহীনতা এবং দীনতা, নতুন করে জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে ’৭১ সালে পরাজিত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে জাতিকে বিভক্ত করেন।
অনেক জ্ঞানপাপী ‘সেনা ছাউনিতে’ বিএনপি’র জন্ম বলে বিএনপি’র আসল চরিত্রটা হালাল করে দেন। কেউ কেউ আর এক ডিগ্রি অগ্রসর হয়ে বলেন বিএনপি হলো ‘মধ্যপন্থী’ দল। প্রকৃত বিচারে বিএনপি হলো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নির্ভরযোগ্য আধার। জামায়াতকে ‘পরিত্যাগ’ করলে বিএনপি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে, এই ধারণা ভুল। বিএনপি’র রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন আনা না হলে বাঙালির জন্যে বিএনপি গ্রহণযোগ্য দল হতে পারে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী গড়ে ওঠা নতুনপ্রজন্ম দেখেছে বাংলাদেশ বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত একটি দেশ। দেখেছে লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণকারী আওয়ামী লীগকে। দেখেছে গণতান্ত্রিক শক্তির মেরুদণ্ডহীনতা। দেখেছে প্রকৃত বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে বেদনাদায়ক বিভাজন এবং বিভ্রান্তিকর ভুমিকা। রাজনীতির এই অধঃপতনের গতি জাতিকে নিয়ে এসেছে আজকের বাংলাদেশে।
১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময়ে রাজনীতি সাম্রাজ্যবাদ এবং লুটেরা ধনীক শ্রেণির মুক্তবাজার নীতির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় সেক্যুলার গণতান্ত্রিক এবং বামশক্তি রাজনীতিতে হীনবল হয়ে পড়ে। এই শূন্যস্থান পুরণ করতে থাকে ইসলামপন্থী মৌলবাদী জঙ্গিবাদী শক্তি। এরা রাষ্ট্রের মদত পেতে থাকে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ খুব সঠিকভাবেই অনুধাবন করতে পারে যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে’ পরাজিত করতে না পারলে বাংলাদেশকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এই অবস্থান থেকেই তারা ইসলামী মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার নীতি গ্রহণ করে।
মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের মদতে গড়ে ওঠা আল্ কায়দা, আইএস, তালেবান, বোকো হারাম, আল্ শাবাব, হুজি, জেএমবি, আনসারুল্লা, হিজবুত তাহরির সবই সেক্যুলার গণতান্ত্রিক শক্তির শূন্যস্থান পুরণ করার ভয়ঙ্করধরনের নানা রূপ। এই মহূর্তে আমাদের মাতৃভুমি এই ভয়ঙ্কর দানবের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টকে ইতিহাসের যথার্থ অবস্থানে দাঁড়িয়ে না দেখতে পারলে আজকের ‘টার্গেট কিলিং এবং জঙ্গি হামলাকে’ বুঝতে পারা অধরাই থেকে যাবে। নতুন নতুন বিভ্রান্তি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে দেউলিয়া করে পথে বসিয়ে ছাড়বে। নতুন নতুন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে জাতিকে।

SUMMARY

804-1.jpg