শুভ কিবরিয়া
প্রতিবছর বেশ আয়োজন করেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতির ধারণা প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। সেই ধারণা সূচকে বিশ্বের নানান দেশের দুর্নীতির একটা মোটামুটি অবয়ব ধরা পড়ে। দুর্নীতির ওপর ও নিচ র্যাংকিং তাতে থাকে। এই সূচক প্রকাশিত হলে, দুর্নীতিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ কততম স্থানে থাকে, তার চিত্রটা বোঝা যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই ধারণা সূচক, ক্ষমতাসীন সরকারকে কখনও স্বস্তি দেয় না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারাই টিআই-এর এই জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। উদ্দেশ্য নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে। সরকারি মন্ত্রীজন, সাংসদ, সরকারি কর্মকর্তা প্রায় সবাই এই দুর্নীতির সূচক নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করেন, সন্দেহ প্রকাশ করেন। ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশে দুর্নীতি ছিল না কখনও, এখনও নাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নতুন করে এটা আবিষ্কার করছে! কিন্তু আসলে কি তাই? যখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠান ছিল না তখন দেশের দুর্নীতি নিয়ে কি কথা হয়নি? আমরা ইতিহাসের পাতা নেড়েচেড়ে দেখতে পারি।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংসদে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। দ্বিতীয়টি বিপ্লব, জাতীয় ঐক্য গঠন ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দেন। ওইদিন বাকশাল কর্মসূচি সংসদে গৃহীত হয়। সে উপলক্ষ্যেই এই কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে দেওয়া ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান- করাপশন। খাদ্য কিনতে যান করাপশন, জিনিস কিনতে যান- করাপশন, বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি।’
বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি নানান সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব দাবি করে। কেননা এই বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে তিনি দেশের করাপশনের ক্ষেত্র সম্পর্কেই প্রকাশ্যে ওয়াকিবহাল শুধু করেননি বরং তথাকথিত শিক্ষিত সমাজই যে দুর্নীতির মূল উদ্যোক্তা এই সত্যটুকুও অবলীলায় বলে ফেলেছেন। আবার আমাদের শিক্ষিত সমাজের হিপোক্রেসি সম্পর্কেও সহজ সত্যটা প্রকাশ করেছেন যথাযথভাবে।
এটা তো গেল ১৯৭৫ সালের কথা। তারও বহু বছর আগে দুর্নীতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে জেলহাজতে দিন কাটিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৫০ সালে তাজউদ্দীন আহমদের বয়স ২৫ বছর। তখন তিনি ছাত্র। ছাত্রাবস্থায় এলাকার বন বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জেল খেটেছেন। এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ১৯৫০ সালের ২৬ মে শুক্রবার তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘বন কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার পদক্ষেপের সমস্ত কিছু বিস্তারিত জানিয়েছি। কিন্তু এর প্রতি আন্তরিকভাবে কোনও খেয়াল করা হয়নি। আমি নিজেই এখন দুর্নীতির বিষাক্ত শিকার। এখন থেকে এই আন্দোলন হবে রক্ষণাত্মক।’
বাংলাদেশের রাজনীতির দুই মহীরুহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমদের নিজের বয়ান থেকে দুর্নীতি বিষয়ক উপলব্ধির কথা আপাতত থাক। এবার টিআইবির বর্তমান রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
দুই.
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী ২০১৫ তে ০-১০০ স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২৫। এ হিসেবে ১৬৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বাংলাদেশের সঙ্গে এই একই অবস্থানে রয়েছে গিনি, লাওস, কেনিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, উগান্ডা। দুর্নীতির জায়গায় বাংলাদেশের ১৩তম অবস্থান এবারই প্রথম নয়। ২০১০, ২০১১, ২০১২ তিন বছর এই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের বিবেচনায় দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটানকে বিবেচনায় নিলে ২০১৫ সালে দুর্নীতির হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চাইতে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে নাম এসেছে আফগানিস্তানের। স্কোর হিসেবে বাংলাদেশ যেখানে পেয়েছে ২৫ নম্বর, আফগানিস্তান সেখানে পেয়েছে ১১ নম্বর। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির এ ধারণা সূচকের স্কেল হচ্ছে ০-১০০। এখানে ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণার মাপকাঠিতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ এবং ‘১০০’ স্কোরকে সর্বাধিক সুশাসিত দেশ বলে বিবেচনা করা হয়। ২০১৫ সালে, এ ধারণা সূচক হিসাবে ৯১ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। এরপরে আছে ফিনল্যান্ড, সুইডেন। যথাক্রমে এদের স্কোর ৯০ ও ৮৯। মাত্র ৮ স্কোর পেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত শীর্ষ দেশের তালিকায় আছে উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়া। এর পরে আছে যথাক্রমে আফগানিস্তান ও সুদান।
টিআইর বক্তব্য মতে, দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী।
তিন.
দুর্নীতি সূচকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ যেখানেই অবস্থান করুক না কেন একটা কথা পরিষ্কার, দুর্নীতি আমাদের সমাজে শক্তিশালী জায়গা করে নিয়েছে। দুর্নীতি আজ আর কোনও গোপনতর বিষয় নয়। রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত সর্বত্র দুর্নীতি খোলা চোখেই দৃশ্যমান। তার চেয়েও বড় কথা দুর্নীতির বিষয়ে সমাজতত্ত্ব এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে ভীষণতরভাবে। এখন দুর্নীতিবাজকে মানুষ ঘৃণা করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই সমীহের চোখে দেখে। দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবানকে সমাজ এখন সমাদর করে। কেননা সমাজ জানে দুর্নীতি করা ক্ষমতাহীনের কাজ নয়। যে ক্ষমতাবান কেবল সেই শক্তিমত্ত দুর্নীতি করার সুযোগ পায়। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করেই দুর্নীতি সংঘটিত হয়। কাজেই দুর্নীতি ও ক্ষমতা প্রায় সমান্তরালে হাঁটে। দুর্নীতি কমাতে হলে তাই ক্ষমতার অপব্যবহার রোধের উপায় বের করতে হবে। এখানেই ‘রাষ্ট্র’-এর ভূমিকা জরুরি।
রাষ্ট্র যদি ন্যায়ানুগ হতে পারে তবে তার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়বে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি ন্যায্যতার ওপর দাঁড় হয় তবে তার পক্ষেই কেবল দুর্নীতিকে মোকাবিলা করা সম্ভব। শুধু ডিজিটাইজেশন দিয়ে দুর্নীতিরোধ সম্ভব নয়। ডিজিটাইজেশন দুর্নীতি রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে কেবল। যন্ত্রের পেছনে যে মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করে, কিংবা যন্ত্রকে যে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে দুর্নীতিমুক্ত করা না গেলে সমাজ-রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি নির্মূল সহজ কাজ নয়।
আর সত্যিকার দুর্নীতি রোধ কোনও তৃণমূল পর্যায়ের কাজও নয়। দুর্নীতিরোধ করতে হবে শীর্ষ থেকে। মাথা থেকেই দুর্নীতি উচ্ছেদের কাজটি সারতে হবে। তাহলে ‘পা’ পর্যায়ে দুর্নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
এখন দুর্নীতি রোধ করা দরকার কেন? দরকার শুধু এ কারণেই নয় যে দুর্নীতি নির্মূল ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। দুর্নীতি নির্মূল এ কারণেও জরুরি যে দুর্নীতি দূর না হলে যতই উন্নয়ন করা যাক না কেন অন্ধকারের ভূত তার সিংহভাগ খেয়ে ফেলবে। এই অন্ধকারের ভূত থেকে বাঁচতে হলেও দুর্নীতি দূর করা খুব জরুরি কাজ। এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি কাজ। কাজেই দুর্নীতি কমানোর কাজটি গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে দুর্নীতি দমন শুধুমাত্র ব্যক্তি সততার ওপর নির্ভরশীল নয়। রাষ্ট্রকাঠামোর সক্ষমতার ওপর তা বহুলাংশেই নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা যদি ন্যায্যতার ওপর না দাঁড়ায়, তবে দুর্নীতি নিজের গতিতেই চলতে থাকবে। আর দুর্নীতি জিইয়ে রেখে উন্নয়ন কখনও কাঙ্ক্ষিত ফল আনবে না। দুর্নীতিযুক্ত উন্নয়ন গুটিকতকের ভাগ্যবদল করলেও অধিকসংখ্যক জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। পারবেও না কখনও।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক