ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ও পাকিস্তানের মিথ্যাচার


লীনা পারভীন 
একই দিনে বিপরীতধর্মী দু’টি ঘটনা কিন্তু প্রেক্ষাপট একই। একটি ঘটনা হচ্ছে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করেছে।
কী এই ডকুমেন্টারি হেরিটেজ? এগুলো হচ্ছে, সেসব নথি বা প্রামাণ্য দলিল, যেগুলো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্ব বহন করে। সেসব দলিল সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের লোকজন যেন এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে, সে উদ্দেশ্যে ইউনেস্কো ১৯৯২ সালে এই উদ্যোগটি নেয়।  এতদিন এই তালিকায় বিশ্বের মোট ৪২৭টি নথি ও প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষিত থাকলেও এবার ২০১৬-১৭ সময়ের মধ্য থেকে কর্তৃপক্ষ আরও মোট ৭৮টি দলিল যুক্ত করেছে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগেও বিশ্বের কাছে নানাভাবে ঐতিহাসিক বক্তব্য বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। কী ছিল সেই বক্তব্যে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সবাইকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে বক্তব্যটি। তবে এটুকু বলা যেতে পারে কী ছিল না সেই বক্তব্যে। পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রকে ছিনিয়ে আনতে যেসব দিক নির্দেশনা তিনি দিয়েছিলেন, সেগুলো প্রতিটাই ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াইয়ের প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বক্তৃতার বর্ণনা যারাই দিয়েছেন তাদের প্রতিটা মানুষের বক্তব্য সাক্ষী দেয় সেদিনের সেই মহেন্দ্রক্ষণের। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যেন উপস্থিত ছিল গোটা দেশের সাত কোটি মানুষ। সারাদেশ থেকে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে করে দলে দলে লোক এসে জড়ো হয়েছিল সেই ময়দানে। কেবল একটি ক্ষণের প্রতীক্ষা ছিল। কখন আসবেন তাদের প্রাণের নেতা? কখন তিনি নির্দেশ দেবেন কী করতে হবে? কেমন করে ছিনিয়ে আনতে হবে আমাদের স্বাধীনতা। ১৯ মিনিটের সেই ছোট ভাষণে ছিল না কোনও লিখিত নথি। সম্পূর্ণ তাৎক্ষণিক সেই বক্তব্যের মাঝ দিয়েই তিনি জাগিয়ে ছিলেন স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের স্বপ্নকে। পাকিস্তানের জন্য ছিল হুঁশিয়ারি বার্তা।

হয়তো তিনি জানতেন সেদিনের সেই বক্তব্যের পর হতেও পারে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন বা আর এভাবে মুক্তমঞ্চে তার প্রাণের জনতার সামনে দাঁড়াতে সুযোগ নাও পেতে পারেন। মার্চের সেই ভাষণের পরবর্তী সময়ে তার গ্রেফতার অবশ্য তার আশঙ্কাকেই প্রমাণ করে। তাই উচ্চারণ করেছিলেন, যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বানের মধ্যেই ছিল গোটা দেশকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান। তিনি বলেছিলেন,  ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে’।

জনতা তখনও হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত কথাটি শুনতে চাইছিল। অপেক্ষায় ছিল নেতা কেন এখনও সেই কথাটি বলছে না? সবশেষে এলো সেই অমোঘ বাণী। তিনি উচ্চারণ করলেন সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। গুলির জবাব সাত কোটি জনতা বুকের রক্ত দিয়ে দেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন তার দেশের জনতা মরতে ভয় পায় না। রক্ত দিয়ে হলেও স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়ের কথা তিনিই তো জানিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে।  

এসব সবই ইতিহাসের অংশ। এগুলো কারও মুখের বানানো ঠাকুর মা’র ঝুলি নয় বা কোনও কাল্পনিক ইতিহাসও নয়। যেখানেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষিত আছে, সেখানেই আছে এসব প্রমাণিত ইতিহাস। আর শেখ মুজিব যে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ করার মতো অপরাধ কেউ করতে পারে এটা চিন্তারও বাইরের কিছু।

কিন্তু আশ্চর্যজনক ও অতি ঘৃণ্যভাবে পাকিস্তানিরা আজও আমাদের সেই ঐতিহাসিক সত্যগুলোকে মেনে নিতে পারছে না। এখনও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করার। এরই সর্বশেষ উদাহরণ ছিল ইউনেস্কো ঘোষিত ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য হিসাবে স্বীকৃতির দিনে বঙ্গবন্ধু ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা নিয়ে মিথ্যাচার করে প্রচারিত একটি ভিডিও। এই ভিডিওটি অত্যন্তহীন কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হাই-কমিশনের পেজে আপলোড করা হয়। এটি আবারও প্রমাণ করলো যে, পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের জন্মকে এই ৪৬ বছর পরও  মানতে পারছে না। আর এর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে এখনও কাজ করে যাচ্ছে তাদের এদেশীয় কিছু দোসর, যারা ৭১ সালেও ছিল ওদের ‘পেয়ারের বন্ধু’। মিথ্যাচার শুরু করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান। তিনি বিতর্ক তুলে বলেছিলেন,  জিয়াই ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, বঙ্গবন্ধু নন। যেখানে তার বাবা বেঁচে থাকতে কোনোদিন এই কথা বলার সাহস পাননি, সেখানে তিনি আজকে এত বছর পর এসে লন্ডনে বসে বিতর্ক শুরু করেছিলেন। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বিএনপি ও জামায়াত চক্র নানা সময় নানাভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

পাকিস্তানের আজকের এই মিথ্যাচার প্রমাণ করে সেদিন তারেক জিয়ার এত সাহসের পেছনে কাদের হাত ছিল? তারেক জিয়ার মিথ্যাচার আর পাকিস্তানের মিথ্যাচার যখন পার্থক্য থাকে না, তখন এটা পরিষ্কার যে বিএনপি সরাসরি পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা নয়, স্বার্বভৌমত্ব চেয়েছিলেন বলে আবারও পাকিস্তান প্রমাণ করলো, তারা মিথ্যাকেই তাদের ধর্ম বলে বিশ্বাস করে। তবে, তারেক জিয়া বা পাকিস্তান বললেই তো আর ইতিহাস পরিবর্তন হয়ে যাবে না বা সারা বিশ্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে ভুলে জিয়াকে সেই আসনে বসাবে না। অন্তত ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি তাই প্রমাণ করে। ইউনেস্কোর নথিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে গোটা বিশ্ব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাঙালি জাতির লড়াই সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার সুযোগ পাবে। বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হবে পাকিস্তানের ভূমিকাও। তারা কতটা নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল সেদিন নিরস্ত্র বাঙালিকে, সে ঘটনাও আসবে সামনে। গণহত্যার দায়ে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবিকে আরও জোরালো করার ভিত্তি দেবে। বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত হবে পাকিস্তানের খুনি চেহারার। সেদিনকে মোকাবিলায় পাকিস্তান কি প্রস্তুত? আমেরিকাও এখন আর পাকিস্তানের মিত্র নয়। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায় পাকিস্তান অন্যদিকে উন্নয়নশীল এবং উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে নাম লেখায় বাংলাদেশ। দু’টি দেশের মধ্যে পার্থক্যটা এখানেই স্পষ্ট। তবে কি পাকিস্তান গা জ্বালা থেকেই শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশকে বিতর্কিত করার? কতটা সফল তারা? সে বিচার করবে বিশ্ব।

তবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পাকিস্তানকে অবশ্যই বিবেচনা করতে পারে। কারণ তারা আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় কেবল, আমাদের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সংবিধানে যখন বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আইন করা আছে, তখন পাকিস্তান একটি বহিঃরাষ্ট্র হয়ে সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে কি?

বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে থাকা একটি দেশ। নানা সূচকে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রকে হিসেব করে চলার মতো সময় আমাদের আগেও ছিল না এখনও নেই। এ কথাটি মনে হয় পাকিস্তানকে আবারও শক্তভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।  

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

797-2.jpg