আনিস আলমগীর
ভাষার সংগ্রাম করতে গিয়ে আমরা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। এটাই বাঙালি জাতির জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ পাওনা। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করেছিলাম ভাষার জন্য। বাঙালির কী সৌভাগ্য ভাষাও পেল, রাষ্ট্রও পেল। যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাভাষীদেরই রাষ্ট্র। অন্য ভাষায় কথা বলে তেমন কোনও লোক নেই এ জাতির মাঝে। সুতরাং এক জাতির এক ভাষা-এটাও সৌভাগ্য। ভাষা নিয়ে অনৈক্য সৃষ্টির কোনও উপাদান নেই আমাদের মাঝে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন। উর্দু কিন্তু পাকিস্তানের কোনও প্রদেশের ভাষা ছিলো না। সিন্ধু প্রদেশের লোক সিদ্ধিতে কথা বলতেন, পাঞ্জাবিরা পাঞ্জাবি ভাষায় আর পাঠান আর বেলুচরা পশতু ভাষায় কথা বলতেন। বাঙালিরা কথা বলতেন বাঙলা ভাষায়। সুতরাং জিন্নাহ কিন্তু যে পাঁচ জাতি নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন তাদের কারও ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেননি। জিন্নাহ বলেছিলেন- তৃতীয় একটা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা।
ভারত উপ-মহাদেশে কোনও জাতির ভাষাই উর্দু ছিলো না। উর্দু ভাষাটা সামরিক ছাউনির ভাষা হিসেবে মোঘলেরা সৃষ্টি করেছিলো। কারণ সামরিক বাহিনীতে বিভিন্ন জাতির লোক থাকে। সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাষার প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য উর্দুকে কমন ভাষা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। এ ভাষাটা এতই সুন্দর ছিল যে অল্প দিনের মাঝে সামরিক ছাউনির বাইরে এসেও ভাষাটা প্রসার লাভ করে।
ভারতের গো-বলয়ের সব মানুষই এ ভাষাটাকে তাদের নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলো এবং অসংখ্য কবি সাহিত্যিকও এ ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে সমৃদ্ধ একটা সাহিত্যও সৃষ্টি করেছিলো। সে কারণে উর্দু ভাষাটা গো-বলয়ে দৃঢ় ভিত্তিও পেয়ে গিয়েছিলো। গো-বলয়ে যখন উর্দু প্রসার লাভ করছিলো তখন কিন্তু রাষ্ট্র ভাষা ছিল ফার্সি। রাজভাষা ফার্সি হওয়ার পরও এমনকি মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও কাব্য চর্চা করেছিলেন উর্দুতে। মুঘল সম্রাট জাফর একজন উচ্চমানের কবিও ছিলেন। তখন হিন্দি ছিল একটা কথ্য ভাষা। হিন্দি ভাষার কোনও লিখন পদ্ধতির প্রচলন ছিল না।
লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকই নাগরী ভাষার হরফ এনে হিন্দির লিখন পদ্ধতি চালু করেন। পরবর্তীতে হিন্দিও শক্তিশালী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন হিন্দি ও উর্দু ভারতের গো-বলয়ের দু’টি শক্তিশালী ভাষা। জিন্নাহ চেয়েছিলেন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। বাঙালিদের শক্তিশালী আন্দোলনের পর পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ও উর্দু স্বীকৃতি পেয়েছিলো। বাংলা ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাংলায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিলো। সে জাতীয়তাবাদী চেতনাকেই লালন পালন করে বৃহত্তম স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত।
উর্দু ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে যে বাংলা ভাষার চর্চা-উন্নতি ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যেতো তা নয়। ব্রিটিশের সময়ে ১৯০ বছর রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। সে কারণে কিন্তু মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দীন, মীর মোশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ প্রমুখের সাহিত্য চর্চা বন্ধ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার সুন্দর বিকাশমান ধারার সূত্রপাতই হয়েছিলো তাদেরই হাতে। ব্রিটিশ রাজত্বের সময়েই রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উত্তম ফসল হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যাহতি পরপরই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা কঠিন ছিল কারণ, ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাষ্ট্রভাষার আঘাত না খেলে বাঙালিরা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার দিকে অগ্রসর হতো না।
ভাষা আন্দোলনে কিন্তু মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, ভাষা আবদুল মতিন, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, গাজীউল হক প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর কেউই উন্মেষিত জাতীয়তাবাদের পরিচর্যা করেননি। শুধু শেখ মুজিবুর রহমানই সুপরিকল্পিতভাবে জাতীয়তাবাদের পরিচর্যায় আত্ম-নিয়োগ করেছিলেন এবং কঠোর পরিশ্রম ও নির্যাতন ভোগ করে তিনি তা অব্যাহতও রেখেছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২০ বছর ছিল শেখ মুজিবের সু-পরিকল্পিত পথ চলা, বিশেষ করে ১৯৬৬ সালের পর ইডেন কাউন্সিলে ৬ দফা গৃহীত হওয়ার পর তিনি সমগ্র জাতির সামনে স্বাধীনতার স্বপ্ন তুলে ধরে জাতিকে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নূরুল আমিন, মৌলভী ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আযম এরা ছিলেন স্বাধীনতার বিরুদ্ধের লোক। সুতরাং তারা ৬ দফাকে কখনও মেনে নিতে পারেননি। প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগই এককভাবে ৬ দফা আন্দোলন করেছিলেন এবং ৬ দফার পক্ষে খুব দ্রুত জনমত সৃষ্টিতে সক্ষমও হয়েছিলেন। জনমতের চাপে বিভ্রান্ত হয়ে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা করতে বাধ্য হয়েছিল। তারা মনে করেছিল ভারতের সঙ্গে যোগসাজস করে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের কথা শুনলে জনগণ শেখ মুজিবুর রহমান আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, কিন্তু ফল দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ তার বিপরীত।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামি করে ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভ করার পরই সমগ্র বাঙালি জাতি শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আওয়ামী লীগের সব প্রবীণ নেতাকে কারারুদ্ধ করার পরও নবীনেরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারকের বাসগৃহ জনতা আগুন দিলে প্রধান বিচারক পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত আগরতলা মামলাও আইয়ুব খান প্রত্যাহার করে নেন। আইয়ুব খানও ক্ষমতাচ্যুত হন আর সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সংখ্যার ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন এবং ইয়াহিয়া খান তা মেনে নেন। এখানেই শেখ মুজিবের বিজয়ের সূচনা পর্ব শুরু। সংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের কারণে পাকিস্তান গণ-পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব-বাংলার অংশে আসে ১৬৪টি আসন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬২ আসনে বিজয়ী হয়ে গণ-পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হয় এবং পার্লামেন্টারি পার্টিরও নেতা নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তান সরকার ও অন্যান্য দল মিলে নির্বাচনের ফলাফল বানচালের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তারা আলাপ-আলোচনা করে দিন কাটায়। ২৫ শে মার্চ রাত্রে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর সশস্ত্রবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা আরম্ভ করে। শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাত স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবকে সে রাত্রেই গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব সুপরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিন সাধনা করে সুদক্ষ নেতৃত্ব এবং সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন, তারাই বিপ্লবের কাজ এগিয়ে নেন।
একজন নেতার অনুপস্থিতিতে তার সহকর্মী নেতা আর কর্মীরা বিপ্লব সফল করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন আর নেতার অনুপস্থিতিতে নেতার হুকুম পালন করার জন্য অকাতরে ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২১শের ভাষা আন্দোলনের সফল পরিণতি এটিই।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে ক্ষমতা গ্রহণ করে সোনার বাংলা গড়ার দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘোষণা দেন। যেটি হওয়ার কথা ছিল সাম্যের দেশ, দরিদ্রতা মুক্ত দেশ, অবকাঠামোয় উন্নত এবং সর্বাঙ্গীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন। এ ষড়যন্ত্রের নেতা ছিল আমেরিকা আর বাংলাদেশের মাটিতে তাকে সহযোগিতা করে জাসদ আর পিকিং এবং ১৯৭১ সালে পরাজিত পাকিস্তানপন্থীরা।
বঙ্গবন্ধুর অকাল মৃত্যুতে তার দ্বিতীয় বিপ্লব সোনার বাংলা গড়ার কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এখন শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায়। তিনিই এখন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত বিপ্লবের কাজ করছেন এবং সফলতাও আছে প্রচুর। বঙ্গবন্ধুর এই ‘আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ সফল করতে রাজনৈতিক বিরোধ আমাদের যাই থাকুক, জাতি হিসেবে লড়তে হবে এক সঙ্গে।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক