উদিসা ইসলাম
২৬ শে মার্চ ১৯৭১। সকাল হওয়ার পর সারারাতের যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখতে ঢাকার রাজপথে যারাই বের হয়েছিলেন, তারাই হয়েছেন হতভম্ব। এতো লাশ, এতো ধ্বংসস্তুপ আগে কখনও দেখেনি বাংলা। তবে বাংলার মানুষকে বলে দিতেও হয়নি এর পরবর্তী ধাপে তার করণীয় কী? কেবল প্রাণের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ কন্ঠে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে-এবার যুদ্ধ হবে।
মুক্তিযোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদ সে সময়ের তরুণদের (২৬ মার্চের) ভাবনা বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২৫ মার্চের ভয়াবহ কাণ্ডের পর আমরা ২৬ তারিখ পথে বেরিয়ে হতভম্ব। এ কোন ঢাকা শহর। তখনও আমরা সবার আগে পরিচিতরা যে যার বাসায় ঠিক আছেন কিনা, গিয়ে গিয়ে সে খবর নেওয়ার চেষ্টা করছি। আর স্বাধীনতার ঘোষণা? সেই দিনটিতে আমরা বুঝে গিয়েছি আগামীতে কি করতে হবে- সেটাইতো স্বাধীনতার ঘোষণা, আর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশনাতো ছিলই।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
সেই ২৬ মার্চ, জয় বাংলা শ্লোগান কন্ঠে নিয়ে বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব বলেন, আমরা সেইদিন ২৬ মার্চ জানতামও না আগামী দিনগুলোতে ঠিক কতদিন লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে হবে। সবার ভেতর তাগিদ ছিল যেকোনও ভাবে দেশ স্বাধীন করতে হবে, তা যতদিনই লাগুক। আর এই স্পিরিটটাকে ধারণের দিন ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। তিনি বলেন, ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান কেবল ছিল না, আমাদের পরিচয় ছিল। আমরা একে অপরকে জয় বাংলা বলে সম্বোধন করার পাশাপাশি, যারা আমাদের বিরোধী শক্তি ছিল তারাও আমাদের ডাকত ‘জয় বাংলার লোক’। জয় বাংলা আমাদের পরিচয়।
১৯৭১ সালের এদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে একাত্তরের এই দিনে যে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের মানুষ, পরবর্তী ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। যার ভিত্তি ছিল ২৫ মার্চের কালরাত্রি।
শেখ মুজিব
২৫ শে মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। মধ্যরাতেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ডাক দেন। ইংরেজিতে ঘোষণার বক্তব্য ছিল ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ একই সঙ্গে তিনি বাংলায় যে বার্তা পাঠান সেটি হলো,‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি।
শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়ে খবর
এই আহ্বান যাদের কানে পৌঁছায়নি তাদের জন্য ছিল ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কর্নেল সাজ্জাদ বলেন, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র পেতে অনেকটা সময় লেগেছে। ভারতে ক্যাম্প হয়েছে, খোঁজ নিয়ে তারা সেখানে গিয়েছে, প্রশিক্ষণ নিয়ে তবেই অস্ত্র হাতে ফিরে এসেছেন দেশকে বাঁচাবেন বলে। কিন্তু তার আগেই তাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে এই মানসিকতায় বিশ্বাসী হতে হয়েছে। আর সেই বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে এনে দিয়েছিলেন।
হতভম্ব জাতি সারারাত গুলির শব্দের পরদিন সকালে ঢাকাকে অনিরাপদ ভেবে গ্রামের দিকে বা ঢাকার চারপাশের নদীর ওপারের কোনও জায়গায় আশ্রয় খোঁজেন। পাকিস্তানী আর্মি ঢাকার আশেপাশের এলাকায় ২৭-২৮ তারিখের দিকে আক্রমণ চালায়। ফলে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষ আবারও ঢাকায় ঢুকে পড়ে বলে জানান রাইসুল ইসলাম। তিনি বলেন, এরপর দিনই শুরু হয় তাদের পরস্পরের মধ্যে আলোচনা এবং যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি।