আনিস আলমগীর
২৬ মার্চ ২০১৮, ৪৭তম স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উদযাপন করছে বাংলাদেশ। দেশটি যখন স্বাধীন হলো, অনেকে বলতেন অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। অনেকে সরাসরিই বলেছেন, ভারতের অধীনে চলে যাবে। কিন্তু গত ৪৬ বছর বাংলাদেশ সগৌরবে টিকে আছে।
পাকিস্তান যখন সৃষ্টি হয়, তখন বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, পাকিস্তান ২৫ বছর টিকবে। মওলানা আজাদ বলেছিলেন ২৩ বছর, আর জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন ১৫/১৬ বছর। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশকে মাথায় নিয়েই ছিল তাদের এসব ভবিষ্যদ্বাণী। তাদের কথার একাংশ সত্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই বিচিত্র ভৌগোলিক রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির অদূরদর্শিতার কারণে টিকে থাকতে পারেনি। তবে ভারতে মিশে যায়নি। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশটি টিকবে না বলে যারা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছেন, তারাও সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশ শুধু টিকে নেই, পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে সব অর্থে ভালোভাবে টিকে আছে।
১৯৭১ সালে ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকার বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৯ লাখ টন। এখন বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ১৬ কোটি, অথচ খাদ্য ঘাটতি নেই। কিন্তু জমির পরিমাণ বাড়েনি এক ছটাকও। বরং বসতি বিস্তারের ফলে চাষযোগ্য জমি কমেছে প্রচুর।
বিশ্বে ২৫ কোটি বাংলাভাষী লোক রয়েছে। ১৬ কোটি বাদ দিলে অবশিষ্টরা রয়েছে বাংলাদেশের বাইরে। পশ্চিম বাংলার লোকও বাঙালি। কিন্তু তারা ভারতীয় নাগরিক। পশ্চিম বাংলা ভারতের ২৯টি অঙ্গরাজ্যের মাঝে একটি। বাংলা পূর্বে অবিভক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতের স্বাধীনতা দিয়ে চলে যায়, তখন বাংলা বিভক্ত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান নাম নিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালিদের অবদান বেশি ছিল। কিন্তু বাঙালিরা ২৩ বছরের বেশি পাকিস্তানের সঙ্গে টিকে থাকতে না পারার প্রধান কারণ ছিল ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বড় ভাইসুলভ আচরণ ও অর্থনৈতিক শোষণ।
বাংলাদেশ যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই শেখ মুজিবুর রহমানই পাকিস্তান সৃষ্টির একজন জুনিয়র পর্যায়ের নায়ক। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায়, কত কঠোর পরিশ্রম তারা পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতেছিল অথচ তারা ক্ষমতা পেলো না। বরং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে তারা হত্যার শিকার হলেন।
যশোর থেকে নির্বাচিত এক সংসদ সদস্য ছিলেন শহীদ মশিউর রহমান। তিনি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভারও একজন সদস্য ছিলেন। তাকে পাকিস্তানি সেনারা জিপের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় টেনে টেনে হত্যা করেছে। এ নির্মমতা ছিল বাংলাদেশের সর্বত্র এবং এ হত্যাকাণ্ড চলেছিল দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এই সময়ে সর্বমোট ৩০ লাখ বাঙালি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে জীবন দিয়েছে। ১ কোটি বাঙালি ভিটামাটি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে পালিয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্যাম্প করে দীর্ঘ ৯ মাস তারা বসবাস করেছে। এই এককোটি লোক বেঁচেছিল ভারতের বধান্যতায়। অযত্ন, অবহেলায় ক্যাম্পে ক্যাম্পে ৯ লাখ শিশু মরেছে বলে সিনেটর কেনেডি মার্কিন কংগ্রেসে উল্লেখ করেছিলেন। যুদ্ধ চলার সময় সিনেটর কেনেডি ভারত সফরে এসে সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেছিলেন মাসব্যাপী। মার্কিন সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসের সহানুভূতি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি। তাদের কারণেই আমেরিকার জনগণও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট নিকসন ও কিসিঞ্জার সপ্তম নৌ-বহর পাঠানোর পরও যে বঙ্গোপসাগরে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল শুধু এ কারণেই। জনমতকে যেকোনও সরকার সমীহ করে চলতে হয়। ২৫ মার্চেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ৩২নং রোডের বাড়ি থেকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করেছিল। তিনিও ৯ মাস পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন।
কিসিঞ্জার তার বই ‘হোয়াইট হাউস ইয়ারস’- এ লিখেছেন ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু কিসিঞ্জারের পরামর্শে নাকি তারা বিরত হয়েছিল। কিসিঞ্জার নাকি বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে না থাকলে কোনও সমাধানেই পৌঁছানো যাবে না। ক্রুশবিদ্ধ হওয়া যার নিয়তি ছিল, সেই শেখ মুজিবুর রহমান ভাগ্যের ফেরে বেঁচে গিয়ে ৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নিন্দুকেরা বলে থাকেন তিনি নাকি ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আন্দোলনের মুখ্য নেতা ভারতে পালিয়ে গেলে দেশের মানুষ সেটাকে কিভাবে গ্রহণ করবে, তা সুনিশ্চিত না হয়ে গ্রেফতার হওয়াই তো ছিল উত্তম।
বঙ্গবন্ধু সহজ সরল মানুষ হতে পারেন তবে প্রখর বুদ্ধিমান ছিলেন। সরলতা অনেক সময় বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিভ্রান্ত হননি বরং তার ভারতের না গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার সিদ্ধান্তটাই ছিল সেদিনের প্রেক্ষাপটে উত্তম সিদ্ধান্ত। নিন্দুকেরা যা বলুক সুকীর্তি কখনও বিফলে যায় না। বঙ্গবন্ধুকে ম্লান করা, বঙ্গবন্ধুর আমরত্ব কেড়ে নেওয়া কালেরও সাধ্য নেই।
চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন করেনি। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতের সামরিক সামর্থ্য পরীক্ষিত হয়েছিল। নেহরুর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি সব কৌশল বদলিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি সামরিক খাতে প্রচুর ব্যয় বৃদ্ধি করে ভারতের সামরিক ভিত্তিকে মজবুত করেছিলেন। জেনারেল কাউল তার বই ‘আনটোল্ড হিস্ট্রি’তে লিখেছেন ৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধের সময় নাকি ভারতের সাধারণ সৈনিকেরা কাপড়ের জুতা পায়ে দিত। ইন্দিরা গান্ধী সে অবস্থা রাখেননি।
সম্ভবত চীন সে কারণে ভারত আক্রমণ করে বাংলাদেশেরও স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপর্যস্ত করতে উদ্যত হয়নি। সর্বোপরি ভারতের সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়নের সামরিক চুক্তি ছিল, যাতে লেখা ছিল উভয় রাষ্ট্রের মাঝে কোনও রাষ্ট্র তৃতীয় রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে উভয় রাষ্ট্র আক্রান্ত বলে গণ্য হবে। তখন সোভিয়েট ইউনিয়ন চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছিল। অবশ্য এ পর্যন্ত দেখা গেছে বন্ধুর জন্য গা নেড়ে কিছু করার রাষ্ট্র চীন নয়। চীন তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বাইরে পা বাড়ায় না। তবে তখন ইন্দিরা গান্ধীর কৌশলগুলোও ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কাজ করেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশে সবাই নেতা। কেউ কারও অনুগামী হতে চায় না। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সবাইকে নিয়ে পথ চলা ছিল কঠিন কাজ। তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। তিনি স্বাধীনতা অর্জন করা পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পেরেছিলেন। এবং সফলতাও পেয়েছিলেন। এটাই তার ঐতিহাসিক সফলতা।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন তার নিজের কাছে রেখে তাজউদ্দিন আহমদকে কঠিন দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন। প্রবাসী সরকারের সফল নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তার প্রমাণও রেখেছেন। অথচ উভয়ের মাঝে সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মত-পার্থক্য ছিল। অবশ্য মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তা কখনও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেনি। বঙ্গবন্ধু বিরাট এক সহযোদ্ধার দল সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সৃষ্টির পর থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত তিনি এক বিরাট সহযোদ্ধার দল সৃষ্টিও করেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে তার সহকর্মীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো একটা কঠিন কাজ সম্পন্ন করে তাদের উপযুক্ততার প্রমাণ দিয়েছেন। কেউ তার সঙ্গে বেইমানি করেননি।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে জাতি কী পেলো আর কী পেলো না, তারও একটা নিকাশ হওয়া প্রয়েজন। দেশটা খুবই দরিদ্র ছিল, ক’দিন আগে জাতিসংঘ হিসাব করে বলেছে বাংলাদেশ ধনী হওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক যখন যাত্রা শুরু করে তখন রিজার্ভ ছিল শূন্য। এখন আমাদের রিজার্ভ হচ্ছে ৩৫০০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ জাহাজের অভাবে শিপিং লাইন প্রতিষ্ঠা করতে পারছিল না। ইন্দিরা গান্ধী তা শুনে একটি পুরনো জাহাজ অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার সে জাহাজের নাম রেখেছিল ‘বাংলার দূত’। আরও তিনটি ছোট জাহাজ নিয়ে অর্থাৎ ‘এমভি বাংলার দূত’, ‘এমভি চট্টগ্রাম’ ও ‘এমভি ফরিদপুর’ নিয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ শিপিং করপোরেশনের কত জাহাজ। এমনিভাবে শূন্য থেকে সব কিছু সূচনা করেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। দেশের উন্নতি ৪৭ বছরে এসে কম হয়নি।
স্বাধীন হওয়ার পর্ব শেষ। এখন স্বাধীনতা রক্ষাই আমাদের জন্য মুখ্য কাজ। আমাদের দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারত চুলাচুলিতে ব্যস্ত। আমাদের স্বাধীনতার কালে তারা বিশ্বের টপ টেন অর্থনীতির রাষ্ট্র তালিকার মধ্যে না থাকলেও এখন চীন দ্বিতীয় আর ভারত চতুর্থ অবস্থানে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মতো ছোট দেশ নিয়ে উভয় রাষ্ট্র খেলবে বেশি। কারণ উভয় রাষ্ট্র চাইবে নিজ নিজ করায়ত্তে রাখার জন্য। বর্তমানে আমরা তেমনই একটা সময় অতিক্রম করছি।
সুতরাং বাংলাদেশের জনগণকে এখন খুবই সতর্কতার সঙ্গে নেতা নির্বাচন করা উচিত। দৃঢ়চেতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্বই এখন জাতির প্রয়োজন। শেখ হাসিনা সাহসী মানুষ। নিজের জীবনবাজি রেখে তিনি দেশের উন্নয়নে মনোযোগী আছেন। দেশের মানুষও তার প্রতি মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। একটি জাতিকে টেনে উন্নতির শেখরে নেওয়ার জন্য একজন নেতার প্রয়োজন হয়। দেশে এখন শেখ হাসিনার বিকল্প এমন কোনও নেতা আছে কিনা, নিজেকেই প্রশ্ন করুন।
লেখক: সাংবাদিক