সিমিন হোসেন রিমি
বঙ্গবন্ধু বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা একটি নাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে ঘটে যাওয়া এক অনন্য ইতিহাসের মহানায়ক তিনি। বিশ্ব ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, যুগে যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেসব স্মরণীয়–বরণীয় মানুষের উপস্থিতি হয়ে যায় চিরকালের, এমনকি প্রতিদিনের, তাঁরা সবাই বিশেষ জ্ঞান ও গুণসম্পন্ন অগ্রগামী মানুষ। এই অর্জনের পেছনে থাকে তাঁদের কঠিন পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ভালোবাসা, সহানুভূতি আরও কত–কী।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই উচ্চতাসম্পন্ন মানুষ, যিনি জনগণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। যাঁর কল্পনাশক্তি, দূরে দেখার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কী নেই তা নয়, যা আছে তা থেকে নতুনের সৃষ্টি করা, অল্পতে ভেঙে না পড়া, সংকল্প বাস্তবায়নে ঝুঁকি নেওয়ার মতো অসীম সাহসী যোদ্ধা তিনি। একজন কৃষক থেকে শুরু করে সমাজজীবনের সব পর্যায়ের মানুষের মনের ভাবনাকে ধারণ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাই তো তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মানুষের আত্মার আত্মীয়। বাংলার বুকে বঙ্গবন্ধু জড়িয়ে আছেন স্মরণের অমরতায়।
কারাগারের নির্জনতায় বঙ্গবন্ধু তাঁর রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৪ জুলাই বৃহস্পতিবার লিখেছিলেন, ‘১৭৮৯ সালের ১২ জুলাই ফরাসি দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারিস নগরীর জনসাধারণ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে। ১৪ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙে রাজবন্দীদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বত্সর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সঙ্গে উদ্যাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তাই কারাগারের এই নির্জন কুঠিতে বসে আমি সালাম জানাই সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের, যারা প্যারিস শহরে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মুক্তিকামী জনসাধারণ এই দিনটার কথা কোনো দিন ভুলতে পারে না।’
বঙ্গবন্ধু সালাম জানিয়েছিলেন সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের। আমি তাঁকে অভিবাদন জানাতে চাই আজ থেকে ৭০ বছর আগে গান্ধীজির মৃত্যুতে তরুণ রাজনৈতিক কর্মী তাজউদ্দীনের ডায়েরির কিছু অংশ উদ্ধৃত করে, ‘সূর্য অস্তমিত হলো এবং অস্তমিত হলো মানবতার পথের দিশারি আলোকবর্তিকা। তাহলে কী অন্ধকার নেমে এল। আলো এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলো। দিনের পরে তো রাত্রির আগমন এবং দিনের আগমনে নিশার অপসারণ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তারপরে তো সূর্যের কিরণ। ক্ষীণতনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপরে তো আনন্দময় পূর্ণচন্দ্রের আবির্ভাব। হতাশার শেষ আশাতে। সংকটময় মুহূর্তে তো তিরোহিত হয় বিস্মৃত অতীতে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তো বর্তমানের সৃষ্টিতে রূপায়িত হয়। জগৎ তো থেমে থাকে না। অনির্বার তার এই চক্র। যে মানুষটির শোকে আজ আমরা মুহ্যমান, সে লোকটি তো অন্ধকারের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আলোতে পৌঁছেছিলেন। তঁাকেও তো অন্ধকারে আলোর অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কী বিস্ময় তিনি নিজেই তো ছিলেন একটি আলোকবর্তিকা। আলোককে কি তুমি ধ্বংস করতে পারো? আলোর কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কী? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সেই–ই তো একমাত্র দিকনির্ধারক। যুগ থেকে যুগে। তাঁর চোখের ক্ষুদ্র কম্পনটিও আমাদের পথের দিশা প্রদান করে। তাহলে বেদনা কেন? বহু যুগের এই ধ্রুবতারার কাছ থেকে আমরা নির্দেশ গ্রহণ করব। তাঁর ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে আমরা অগ্রসর হব। তিনি শান্তি লাভ করুন। “আমিন”।’
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলার মানুষ যখন প্রাণপণে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত, যুদ্ধের শেষ প্রান্তে যখন বাংলাদেশ জগৎ সভায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, সেই উপলক্ষে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন পরম ভালোবাসায়, যা হয়ে থাকে চিরকালের। তিনি বলেন, ‘স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদেরকে জগৎ সভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।...ভারতের পরে ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায়। বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হলো, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক। যে রূপকাহিনি ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে জোগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনির অংশ। তবু এই মুহূর্তে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।’
বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনা আজ শক্তির উৎস হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে নবরূপে রূপায়িত করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে পদচিহ্ন রেখে গেছেন, তা আমাদের সব প্রেরণার ভিত্তিস্থল। বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি দার্শনিক ও কবি রালফ ওয়ালডো এমারসনের একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি দিয়ে—পথ তোমাকে যেদিকে নিয়ে যেতে চায় সেদিকে যেয়ো না, তার বদলে যাও সেখানে, যেখানে কোনো পথ নেই। সেখানে এঁকে দাও পদচিহ্ন।
সিমিন হোসেন রিমি সংসদ সদস্য, লেখক ও সমাজকর্মী