হিটলার এ. হালিম
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সরাসরি রেডিওতে প্রচার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বেতার, ডিএফপি ও ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের’ কয়েকজন কর্মকর্তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভাষণের অডিও ও ভিডিও পৃথকভাবে রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তীতে তা প্রচারের ক্ষেত্রেও বিদ্রোহী ভূমিকা নিয়েছিলেন রেডিও পাকিস্তানের কর্মকর্তারা। তাদের কর্মবিরতি থেকে ফেরাতে তৎকালীন সরকার ৮ মার্চ সকাল সাড়ে 8টায় ভাষণটি রেডিও পাকিস্তানে প্রচার করতে দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ যে ৮-১০ জন কর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন তাদের একজন ছিলেন আশফাকুর রহমান খান। তিনি সেসময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সংগঠক। জনাব খানের কাছে সেদিনের মহাযজ্ঞের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে প্রচারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল সামরিক সরকারের। ৭ মার্চ বেলা ২টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা। দুপুর ১২টা থেকে রেডিওতে কিছুক্ষণ পর পর ঘোষণা দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়ে। বঙ্গবন্ধু ৩টা ২০ মিনিটের দিকে মঞ্চে আসেন। এর আগে ৬ মার্চ রাতে রেডিওর প্রকৌশলীরা রমনার রেসকোর্স ময়দানে যে মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন সেখানে টেলিফোনের তার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসান।’
৭ মার্চের ভাষণ
তিনি জানান, “ওই সময়ে শাহবাগ বেতার ভবনের ডিউটি রুমে ফোন আসে। ফোন করেন সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক। টেলিফোনে তার আদেশ ছিল ‘নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন দ্য এয়ার আনটিল ফারদার অর্ডার’। রেডিওর সবাই ওই আদেশের প্রতিবাদে কাজকর্ম বন্ধ করে অফিস ছেড়ে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চলে যান। তখন সাভারে একটি বিকল্প শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিল। সেখান থেকেও যাতে অনুষ্ঠান প্রচার করা না হয় সেজন্য ফোন করে সব রেডিও কর্মীকে আত্মগোপনে চলে যেতে বলা হয়।”
বাংলাদেশ বেতারের উপ-মহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) হিসেবে অবসরে যাওয়া আশফাকুর রহমান খান বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করার বিষয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে (সরাসরি প্রচার) হওয়ার কথা ছিল। ভাষণ রিলে করার বিষয়ে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতিও নেওয়া ছিল। কিন্তু রিলে করা সম্ভব হয়নি। আমরা কোনও অনুষ্ঠান রিলে করলেও তা টেপ রেকর্ডারেও রেকর্ড করে রাখতাম। সেদিনও আমাদের কাছে টেপ রেকর্ডার ছিল। যেহেতু রিলে করা যাচ্ছিল না সেহেতু আমরা একটা ইএমআই মেশিনে ভাষণটি রেকর্ড করে রাখি।’
৭ মার্চ প্রচারিত না হওয়া ভাষণ কীভাবে ৮ মার্চ রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচার করা সম্ভব হলো সেই ইতিহাসও জানালেন আশফাকুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘ভাষণটি বেতারের কর্মকর্তারাই রেকর্ড করেন। তারা মঞ্চের নিচের দিকে অবস্থান নিয়ে সম্পূর্ণ ভাষণ রেকর্ড করতে সক্ষম হন। পরে সেনাবাহিনী রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ প্রচার করতে দিতে রাজি হয়। তাদের শর্ত ছিল, রেডিও কর্মীদের কাজে যোগ দিতে হবে। ৮ মার্চ সকাল ৭টায় সবাই কাজে কাজে যোগ দেয়। সকাল সাড়ে ৮টায় প্রচার হয় বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণ।’
আশফাকুর রহমান খান আরও জানান, ‘ইএমআই মেশিনে রেকর্ড করা ভাষণের দৈর্ঘ্য ছিল ২১ মিনিট। রেডিওতে প্রচারিত হয় ওই ২১ মিনিটই। পরবর্তী সময়ে ভাষণটি সম্পাদনা করে গ্রামোফোনে রেকর্ড করা হয়। ভাষণের সময় যেসব জায়গায় এমনি শব্দ ছিল বা ফাঁকা ছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে যেটা রাখা হয় সেটার দৈর্ঘ্য হয় ১৮ মিনিট।’
৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও রেকর্ড হলো যেভাবে
৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে প্রচারের ক্ষেত্রে যেমন বাধা ছিল, তেমনি ভিডিওতে ধারণের চেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সব বাধা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচএম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের। তারা আগেই সিদ্ধান্ত নেন, যেভাবেই হোক ভাষণের রেকর্ড করতে হবে। ভাষণ ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করার সময় ক্যামেরাম্যান হিসেবে যুক্ত ছিলেন ডিএফপির কর্মকর্তা অভিনেতা (মরহুম) আবুল খায়ের।
সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হয়েছিল, মঞ্চের একপাশে ভিডিও ক্যামেরায় চিত্র ধারণ করা হবে। তবে ক্যামেরা বড় হওয়ায় এবং ক্যামেরাম্যানের নড়াচড়া করা সম্ভব না হওয়ায় একটা দূরত্বে অবস্থান নিয়ে একই জায়গা থেকে বক্তৃতার দৃশ্য যতটুকু সম্ভব ধারণ করেন আবুল খায়ের। পরে দেখা যায়, ১০ মিনিটের বক্তৃতার ভিডিও রেকর্ড হয়েছে।